শাওন তখন দশম শ্রেণীতে পড়ে। ক্লাসে প্রথম। ফিট-ফাট ভদ্র ছেলে। বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় দুই কিলোমিটার দুরে হওয়ায় প্রি-টেষ্ট পরীক্ষার কিছুদিন আগে সে স্কুলের হোষ্টেলে উঠে গেল।
.
নবম শ্রেণীতে পড়া ইতি নামের একটা মেয়েকে তার খুব পছন্দ। এতদিন কারো কাছে মুখ খুলে কিছু বলে নি। এই বয়সে কোন মেয়েকে পছন্দ করে ফেলা ভাল কথা নয়। কাজেই বন্ধু বা শত্রু কাউকেই জানতে দেয়া যাবে না এই মন্দ কথাটি....
.
হোষ্টেলে এসে ক্লাসের অন্য বন্ধুদের সাথে মিশতে মিশতে জানতে পারল এটা সাধারণ ঘটনা। সবারই দুই একটা পছন্দের মেয়ে আছে। শুধু তাই না, দুই- এক জনের আরও গভীর কিছু.......!
.
অল্প বয়সে একটা মেয়ে পছন্দ করে সে যে খুব মন্দ কাজ করেনি--বুঝতে পেরে শাওন স্বস্তি পেল কিছুটা।
.
এবার একদিন সুযোগ বুঝে হোষ্টেলে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ফেলল, ”বন্ধু........! আমি তো ক্লাস নাইনের ইতি নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করি, কথাটা তাকে কি ভাবে জানানো যায় বলত…..!”
.
ঘাঘু বন্ধুটি তাকে খুব জুতসই একটা পরামর্শ দিল….
.
”তুই যে ওকে ভালবাসিস এই কথা ভাল ভাবে বুঝিয়ে একটা চিঠি লেখে ফেল, যায়গা মত পৌছে দেয়ার দায়িত্ব আমার!”
.
বন্ধুর পরামর্শ মোতাবেক সিনেমা-নাটক, গল্প-উপন্যাস প্রভৃতি থেকে অর্জিত সারা জীবনের সমস্ত প্রেমনুভুতি ঢেলে দিয়ে একটা চিঠি লিখে ফেলল শাওন। লিখে বন্ধুকে একবার পড়তে দিল, কেমন হয়েছে জানার জন্য।
.
বন্ধু বলল, দারুণ হয়েছে! এই চিঠি পড়লে প্রিন্সেস ডায়ানাও তোর প্রেমে পড়ে যেত। আচ্ছা, আমি নিয়ে যাই, সুযোগ পেলেই ইতির হাতে দিয়ে দিব।
.
চিঠিটা ইতির হাতে গেলে যতি সে নেতিবাচক ভাবে নেয়, তাহলে সম্ভাব্য কেলেংকারী বিষয়টা হঠাৎ করে শাওনের মাথায় আসল এবং তাতে ইতিকে ভালবাসার কথা জানানোর ভুত তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করল।
.
শাওন বলল, থাক দেয়ার দরকার নাই। চিঠি দিলে খামখা কি না কি হয়।
.
বন্ধু বলল, কি বলিস! এত সুন্দর একটা চিঠি লিখলি তার জন্য, আর এখন দিতে চাচ্ছিস না?
.
শাওন বলল, না দরকার নাই। পছন্দ হয়, ভাল কথা! পছন্দ হলেই তাকে জানাতে হবে? দরকার নাই।
.
বন্ধু বলল, তুই ছাতু খা, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
.
বলে বন্ধুটা চলে গেল আর শাওন চিঠিটা নিয়ে তার টেবিলে বইয়ের ভিতর রেখে দিল।
.
কঠোর ভাবে সিদ্ধান্ত নিল তার পছন্দের কথা সে ইতিকে মরে গেলেও জানাবে না। না চিঠিতে, না সরাসরি, কোন ভাবেই না….
.
বইয়ের ভিতরে রাখা চিঠির কথা বেমালুম ভুলেই গেল শাওন।
.
তিন-চার দিন পর….
.
স্কুল টাইমে ক্লাস স্থগিত করে ছাত্র বনাম পাবলিক একটা ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে স্কুল মাঠে।
.
শাওন খেলছে।
.
তার সাথে হোস্টেলের রুমে থাকা ছেলেটি ক্লাসে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দী।নাম সাব্বির। সে আবার খেলা-ধুলার ধার ধারে না। খুবই পড়ুয়া। পড়া ছাড়া কিছু বুঝে না। প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও শাওন তার সাথে বই-নোট ইত্যাদি শেয়ার করে করে পড়ে।
.
খেলার সময় শাওন মাঠে আর সাব্বিল হোস্টেল রুমে। সে পড়ছে। হঠাৎ সাব্বিরের একটা বইয়ের দরকার পড়ল যা কেবল শাওনের আছে। শাওন খেলছে দেখে তার কাছে জিজ্ঞাস না করে নিজেই শাওনের টেবিলে খুজতে গেল।
.
বই ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ ইতিকে লেখা চিঠিটা তার হাতে পড়ে গেল।
.
চিঠিটা এক টানে পড়ে ফেলল। এর পর আর কোন দিকে না তাকিয়ে সে চিঠিটা সরাসরি প্রধান শিক্ষকের হাতে তুলে দিল……
.
খেলা শেষে হলে প্রধান শিক্ষক শাওনকে ডেকে পাঠাল….
.
শাওন প্রধান শিক্ষক সহেবের সাথে দেখা করতে গেল। সেদিন আর শিক্ষক মহোদয় তাকে কিছু বললেন না, শুধু বললেন, পরের দিন সকালে এসে আমার সাথে দেখা করবি।
.
এবং পধান শিক্ষকের বলার ভঙ্গিতে শাওন আন্দাজ করলে যে সামথিং ইজ ভেরী রং!
.
কিন্তু সে বুঝতে পারল না, রং টা কি!................
.
টেনশনে সারা রাত ঘুমাতে পারল না শাওন। সকাল বেলা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সে শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করল।
.
প্রধান শিক্ষক উৎ পেতেই বসে ছিলেন।.....
.
তাকে দেখেই হুংকার ছেড়ে বলল, হারামজাদা, স্কুলে কি পড়তে আসছিস, নাকি নষ্টি-ফষ্টি খেলতে আসছিস?
.
প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে শাওন কেদে ফেলল। আজ পর্যন্ত কোন শিক্ষক তাকে তুমি ছেড়ে তুই বলেনি। আজ শুধু তুই নয়, সাথে হারামজাদা বলে গালিও দিয়ে ফেলল। অথচ তার যে কিঅপরাধ সে তা এখনও জানে না...
.
শুধু গালিই নয়, শাওনকে কান ধরে দাঁড়াতে বলা হল!
.
প্রধান শিক্ষকের হুংকার শুনে সব ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষক মিলনায়তনের সামনে চলে এসে জটলা পাকিয়ে ফেলল।
.
সবাই একটা অতি বিনয়ী ছেলের বিনা অপরাধে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি পাওয়া দেখতে লাগল।
.
সাব্বির তখন বীরের মত প্রধান শিক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, স্যার, শুধু চিঠি লেখা নয়, ও ইতির সাথে মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে এবং চকলেট ফকলেটও কিনে দেয়।......
.
শাওন শুনে মনে মনে বলল, কারো সাথে কথা বলার অভিযোগ যে তুই এত বিভৎস অপরাধ হিসাবে উত্থাপন করবি কোনদিন, জানলে আমি এই জীবনে কথা বলাই শিখতাম না। চুপ থেকেই সারা জীবন পার কারে দিতাম রে হারামজাদা!
.
শাওন কান্না কান্না গলায় বলল, স্যার চিঠিটা আমি ওকে দিতাম না।দেয়ার জন্য লিখি নি।..........
.
তার কথা শেষই হল না........
.
তার আগেই স্যার বেত হাতে নিয়ে শপাং শপাং শাওনের পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে আবার হুংকার ছেড়ে বলল, ওরে হারামী! আমরা কি হাওয়া খাই? এই চিঠি তুমি ওকে দিবানা তো সংবাদ পত্রে প্রকাশের জন্য লিখেছ নাকি, চান্দু?
.
শাওন আর কোন কথ বলার সাহস পেল না।
.
অন্যান্য শিক্ষকেরা মিলনায়তনের সামনে থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের জটলা ভেঙ্গ দিয়ে তাদের তাড়নোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারা গেল না।
.
দশম শ্রেণীর ফার্স্ট বয় কান ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, এই দৃশ্য দেখার লোভ কয়জন ছাত্র-ছাত্রী সামলাতে পারে?
.
এতক্ষণ প্রধান শিক্ষক যা করলে তা ছিল প্রাক পানিশম্যান্ট গালা-গাল।
.
চুরান্ত ভাবে তাকে কি শাস্তি দেয়া যায় এই নিয়ে প্রধান শিক্ষক খুবই ভানায় পড়ে গেলেন। ইতির পক্ষ থেকে অভিযোগ আসলে তার কাছে মাফ চাওয়ানো যেত। কিন্তু ইতি তো কোন অভিযোগ করে নি।
.
তাহলে উপায়?
.
এতক্ষণে প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের বোধোদয় হল যে, শাওন তো আসলে কোন অপরাধ করে নি। সে যা করেছিল, এটার জন্য কেবল সস্নেহে শাসন করা যেত, শাস্তি দেয়ার মত তো কিছুই ঘটে নি। কারণ কোন অভিযোগই তো নাই!
.
বুঝেও এখন আর লাভ নাই। যা হবার হয়েই গেছে। স্কুলে সবাই জেনে গেল শাওন ইতিকে প্রেমের চিঠি লিখেছে। ছেলেটার মান-ইজ্জত গেল।
.
একবার ইতিকে খুজ করা হলো, যদি সে শাওন সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলে, তবুও প্রধান শিক্ষক একটু শান্তি পেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ইতি সেদিন স্কুলে আসে নি।
.
পরিশেষে “এরকম মজনু গিরি আর করবা না, সামনে এস এস সি পরীক্ষা, মন দিয়ে পড়াশোনা করবা” ইত্যাদি জ্ঞানবাক্য বিতরণ করে সেদিনের মত শাওন কে ছেড়ে দেয়া হল।
.
ইতির এক বান্ধবী একদিন তাকে বলল, ইতি, শাওন ভাই নাকি তোকে প্রেম-পত্র দিয়েছিল?
.
ইতি চেচিয়ে বলল, ফালতু কথা বলিস কেন খামখা? শাওন অনেক ভাল ছেলে, সে কেন এসব করতে যাবে?
.
এবং স্কুলের আরও অন্যান্যদের কানা-কনি থেকে ইতি বিষয়টা সম্পর্কে জেনেছিল। পরিশেষে সঠিক ভাবে জানতে পারল যে, শাওন তার জন্য একটা প্রেমপত্র লিখেছিল মাত্র!
.
শাওন এখন আর কারও সাথে তেমন কথা বলে না, একেবারে মাটির দিকে তাকিয়ে হাটে।
.
এ এস সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর শাওন বিকালে একা একা হেটে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ কোন ভুমিকা ছাড়াই বলে উঠল, শাওন ভাই, আপনি নাকি আমার জন্য একটা চিঠি লিখে ছিলেন……..
.
শাওন অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখে ইতি একটা পিচ্চি কোলে দাঁড়িয়ে....
.
শাওন ইতিকে দেখে খুবই লজ্জা পেল। কোন কথা বলতে পারল না।
.
ইতি আবার বলল, কিছু বললেন না যে।
.
শাওন আমতা আমতা করে বলল, না মানে……
.
ইতি বলল, চিঠিটা কি আপনার কাছে আছে, নাকি নাই?
.
শাওন বলল, না, নাই। ওইটা তো হেড স্যার নিয়া গেছে। কি সব কান্ড হলো। তুমি হঠাৎ ওইটার কথা বলতেছ কেন?
.
ইতি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আপনার কি মনে আছে ওই চিঠিতে কি লিখেছিলেন?
.
শাওন ইতির কথা শুনে ভয়ে চিমসে গেল। আবার কি জানি হয়! কোন কথা বলল না সে।
.
শাওনের কথা শুনার অপেক্ষা না করে ইতি মুচকি হেসে বলল, সব মনে থাকলে ভাল। সব মনে না থাকলেও যতদূর মনে পড়ে ততদূরই লিখে আগামীকাল এই সময়ে এখানে এসে আমাকে দিয়ে যাবেন।
.
শাওন জিজ্ঞেস করল, কি করবা?
.
ইতি ধমক দিয়ে বলল, কি করব তা জেনে আপনি কি করবেন? দিতে বলছি ,দিয়ে যাবেন, ব্যাস! অতো কথার কি দরকার?
.
বলে খুব মিষ্টি করে একগাল হেসে হন হনিয়ে চলে গেল। শাওনের তখন মনে হল এত ভাল হাসি মনে হয় সে জীবনেও দেখেনি.....
.
.
.
অনেকদিন পর……..
.
হঠাৎ শাওনের মোবাইলে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসল।
.
ফোন রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে বলল, শাওন! আমি রমিজ মাষ্টার। তোমার হাই স্কুলে হেড স্যার। চিনতে পেরেছ?
.
শাওন চিনতে পারল এবং বলল, স্যার কি মনে করে হঠাৎ?
.
-স্কুলের একটা কাজে শিক্ষা বোর্ডে আসছি। কাজটা আজ হবে না। একটা রাত থাকতে হবে ঢাকায়। তোমার বাসায় কি থাকা যাবে, বাবা?
.
-জ্বি স্যার! অবশ্যই! আপনি কোথায় আছেন বলেন, আমি গিয়ে আপনাকে বাসায় নিয়ে আসব!
.
শাওন বকশি বাজার গিয়ে স্যার কে বাসায় নিয়ে আসল।
.
রাতে খাবার সময় ইতি বলল, স্যার আমাকে চিঠি লেখার জন্য একদিন আপনি ওকে পিটিয়েছিলেন না? মনে আছে?
.
রমিজ মাস্টার এবং শাওন দুজনেই ঘটনা টা ভুলে গেছে, কিন্তু পত্যক্ষদর্শী না হয়েও এই মেয়ে মনে রেখেছে! এবং মনে পরার পর রমিজ মাস্টার খুবই আশ্চর্য হলো এই দেখে যে, সেই ইতিই আজ শাওনের স্ত্রী….
.
রমিজ মাষ্টার খুবই লজ্জিত হয়ে বলল, হ্যা মা, আমি ওর ভালর জন্যই তো মেরেছিলাম........
.
ইতি খুবই ঢং মাখা স্কর করে বলল, হুম, ওনার ভালর জন্য মেরেছিলেন ঠিকই। কিন্ত শিক্ষক হিসাবে আমার ভালটাও একবার দেখা উচিৎ ছিল স্যার!
.
স্যার অবাক হয়ে ইতির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন মা, কি হয়েছে?
.
-সেদিন এই বদমাশটাকে পিটিয়ে মেরে ফেললে আমার আর এই যন্ত্রণা হইত না!
.
-আমি তোমার কথা বুঝলাম না মা!
.
-কি আর বলব স্যার! কয় টাকা বেতনেরই বা চাকরি করে? সামান্য একটু জ্বরের মত হলেই নিয়ে যায় এ্যপোলো, ল্যাব এইড, স্কয়ার হসপিটালে! ময়লা জামা-কাপড় একদিনও আমাকে ধুইতে দেয় না, চুরি করে নিয়ে লন্ড্রীতে দিয়ে আসে। প্রতি মাসে বেতন পেলেই এক গাদা কসমেটিকস, তাও আবার সব বিদেশী। আমি বলি ভবিষ্যতেরও তো একটা ব্যাপার আছে। এত পাগলামীর কোন মানে হয়? কে শুনে কার কথা? সে আছে তার তালে। একে নিয়ে আর পারি না, স্যার! একটা কথাও আমার রাখে না সে!
.
স্যার এবার ইতির কথা বুঝতে পারলেন এবং ভাল করেই বুঝলেন……………….
.
স্যার মুচকি হেসে মনে মনে বললেন, যাক, শাসন করতে গিয়ে রাগের মাথায় যে বাড়া-বাড়িটা করে ফেলেছিলাম আজকের একটা অতি সুখী দম্পত্তির উপর সামান্য হলেও তার প্রভাব রয়েছে......
…….. আর তিনি মনে মনে ইতির মুখের কথা আর মনের কথার সম্পর্কের বৈপরিত্যের তীব্রতা পরিমাপ করতে প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন…… ইতি যাই বলুক, সব মিলিয়ে সে আসলে তার ভাল থাকার কথাটাই বলতে চাইল..........
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:২৮