স্বাধীনতার কথা উঠলে নিজের অজান্তে আমরা আলবদরের সাথে রাজাকার, আলশামস, শান্তিকমিটি প্রভৃতিকে মিলিয়ে ফেলি। এটা ভুল শুধু নয়, বিশাল ভুল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাস এই ডিসেম্বর, সেই সাথে আমাদের অনেক কিছু হারানোর মাসও এটি। এই মাসে আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষ পাকিস্তান এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা। যখন এই দোসরদের কথা উঠে আমরা সবাই বলে উঠি রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি দলের কথা। ধরে নেই এরা সবাই এক। আমাদের ধারনা ভুল নয়, তবে হয়ত একেবারে সঠিকও নয়।
যুদ্ধ আক্রান্ত সব দেশেই আক্রমনকারীদল কিছু দেশীয় দালাল পেয়ে যায়। এটা খুবই সাধারণ একটা ঘটনা। ইরাক, আফগানিস্তান সহ প্রত্যেক দেশেই আমরা এমনটা দেখি, এদেরই ১৯৭১-বাংলাদেশ ভার্সন রাজাকার,আলশামস। তবে আলবদরের ব্যাপারটা ভিন্ন। একাত্তরের শেষ সময়টা ছাড়া আলবদরের নাম জানা ছিল না কারোরই। সম্পূর্ণ অজানা ছিল এই গ্রুপটি (কিছুদিন আগে চ্যানেল আইতে নাসিরউদ্দীন মামুনের একটা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এই তথ্য দেন)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর পাকিস্তানের শাসকদের একটা আলাদা ক্ষোভ ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একাত্তরের সেই কালরাত্রীতে ঢাবিতে ৯ জন শিক্ষক ও প্রায় ৩০০ ছাত্রকে হত্যা করা হয়। কিন্তু এই হত্যাগুলো সুনির্দিষ্ট ছিল না। যাকে সামনে পেয়েছে মেরে ফেলেছে।
টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেবার পরেই ঘোষনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে ২ জুনের মাঝে কাজ শুরু করতে হবে এবং ২ আগস্ট থেকে ক্লাস শুরু করতে হবে। এই ঘোষনার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দুইটি; এক, বহির্বিশ্বে প্রচার করা যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক, দুই, পাকিস্তান পন্থি ছাত্র ও শিক্ষকদের একত্রিত করা। তারা রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে ঢাকা নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরি তখন প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন।
তখন থেকেই ঢাকার নবাব আবদুল গনি রোডের একটি বাড়িতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামের লিস্ট করা শুরু হয় কিছু পাকিস্তান পন্থি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। সেই সাথে পাকিস্তান পন্থি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অত্যন্ত গোপনে হিটলারের গোস্টাপো বাহিনীর মত ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। একটি জাতিকে মেধাশুন্য করার ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয় সেই জাতির শিক্ষিতদের একটা অংশের সহায়তায়। এই বাহিনীর সদস্যরাই বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বুদ্ধিজীবি হত্যায়। একে একে খুঁজে হত্যা করতে থাকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এই বাহিনীর কথা কেউ জানত না এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দারাও না।
আমরা যখন স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে কথা বলব, তখন আলবদরকে অবশ্যই আলাদা রাখতে হবে। রাজাকার, আল শামসেরা সবসময় সব যুদ্ধ আক্রান্ত দেশেই থাকে, কিন্তু আলবদর সব সময় থাকে না। একটি জাতিকে মেধাশুণ্য করার এই ভয়ংকর যজ্ঞ ইতিহাসে আর কখনও হয়েছে বলে আমি শুনি নাই। ইতিহাসে যখন কোন সম্রাজ্যবাদী গোষ্টি অন্য কোন রাষ্ট্র বা জাতিকে পরাজিত করেছে তখনই তারা সেই পরাজিত জাতির শ্রেষ্ট মানুষদের আলাদা রেখে সম্রাজ্যের কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ গজনীর সুলতান মাহমুদ। আবার অনেক শাসক কোন কোন পরাজিত জাতিকে একেবারে নির্মূল করতে চেষ্টা করেছেন; এর উদাহরণ আলেকজান্ডার (পারস্যের একটি বিখ্যাত নগরীকে তিনি একেবারে ধ্বংস করে দেন)। কিন্তু একটি জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের বেছে বেছে হত্যা করে জাতিকে পঙ্গু করার নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র একমাত্র পাকিস্তানী বর্বররাই করতে পারে।
আলবদরের সদস্যদের চিহ্নিত করা সম্ভব বলে মনে হয় না। প্রায় প্রত্যেক শহিদ বুদ্ধিজীবি পরিবারের সদস্যরাই উল্লেখ করেন, কিছু ছেলে ডিসেম্বের ১৩/১৪ তারিখে বুদ্ধিজীবিদের ধরে নিয়ে যায়। তারা কারা? তাদের কি চিহ্নিত করা সম্ভয় হয়েছে? তাদের প্রধানদের হয়ত আমরা চিনি আজ, কিন্তু সদস্যরা? নিশ্চয়ই আমরা তাদের চিনি না। তারা আজো আছে আমাদের মাঝে। হয়ত, আর একটি অন্য ধরণের আক্রমনের অপেক্ষায়।