নার্গিস পর্ব || প্রমীলা পর্ব-১|| প্রমীলা পর্ব-২ ||
প্রমীলা পর্ব-৩ || ফজিলতুন্নেসা পর্ব-১
১৯২৮ সাল। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিতে নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাসায় উঠেন। বেগম ফজিলতুন্নেসা কাজী সাহেবের কাছ থেকে জানতে পারেন নজরুল একজন সৌখিন হস্তরেখাবিদ। তিনি কাজী সাহেবের কাছে নজরুলের কাছে হাত দেখাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
ছোট বোনের মত ফজিলতের ইচ্ছায় কাজী মোতাহার হোসেন একদিন কবিকে নিয়ে পুরান ঢাকার হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টো দিকে ফজিলতুন্নেসার ঘরে উপস্থিত হন। নজরুল ও ফজিলতুন্নেসার খুব সম্ভবত এটাই প্রথম দেখা। কবি প্রায় আধ ঘন্টা ধরে গভীর মনোযোগের সাথে হাত দেখে বললেন, ‘এই মুহুর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না’। তিনি জ্যোতিষীর মত হাতের নানা রেখার বিবরণ টুকে নিয়ে, এগুলো রাতে পরীক্ষা করবেন বলে কাজী সাহেবের সাথে বিদায় নিলেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর কাজী সাহেব ও নজরুল শুতে যান। নজরুল ও কাজী মোহাতার হোসেন বর্ধমান হাউসের একই রুমে থাকতেন। ভোর হওয়ার আগে কাজী সাহেব জেগে দেখেন নজরুল পাশে নেই। পরদিন নাস্তার সময় ফিরে এসে নজরুল তার গায়েব হবার যে কারন উল্লেখ করেন তা কাজী মোতাহার হোসেনের ‘আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান’ প্রবন্ধ হতে সরাসরি তুলে দিলাম,
“রাত্রে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম একজন জ্যোতির্ময়ী নারী তাকে অনুসরণ করার জন্য আমাকে ঈঙ্গিত করছে। কিন্তু জেগে উঠে সেই দেবীর পরিবর্তে একটি অস্পষ্ট হলুদ আলোর রশ্মি দেখলাম। আলোটা আমাকে যেন ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে, আমার সামনে সামনে এগিয়ে চলছিল। আমি বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে কিছুটা অভিভূত হয়ে সেই আলোকরেখার অনুসরণ করছিলাম। মিস ফজিলতুন্নেসার গৃহের কাছে না পৌছান পর্যন্ত আলোটা আমার সামনে চলছিল। তার বাড়ির কাছে পৌছতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দেখলাম একটি ঘরের মধ্যে তখনও একটি মোমের বাতি জ্বলছে। রাস্তার ধারের জানালার কাছে সম্ভবতঃ পথিকের পায়ের শব্দ শুনে গৃহকত্রী এগিয়ে এসে ঘরের প্রবেশ-দরোজা খুল দিলেন এবং মিস ফজিলতুন্নেসার শয়ন-ঘরের দিকে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। কুমারী নেসা তার শয্যার উপর গিয়ে বসলেন আর আমি তার সামনে একটি চেয়ারে বসে তার কাছে প্রেম যাচনা করলাম; তিনি দৃঢ়ভাবে আমার প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য করলেন”।
সূর্য উঠার পর কোথায় ছিলেন জিজ্ঞাসা করলে নজরুল উত্তর দেন, ‘ঐ ঘটনার পর নিরতিশয় ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ি; তাই ভোর বেলা রমনা লেকের ধারে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিলাম।
কাজী মোতাহার হোসেন আরো লেখেন,
“নজরুল রমনার লেক ভালবাসতেন এবং লেকের ধারে সাপের আস্তানা আছে জেনেও সেখানে ভ্রমন করতে যাওয়া তাঁর পক্ষে আদৌ অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আরো একটি বিস্ময়ের ব্যাপার তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঐদিন দুপুরে লক্ষ করলাম ফজিলতের গলার লম্বা মটর-মালার হারটা ছিঁড়ে দুখান হয়ে গিয়েছে। পরে সেটা সোনারুর দোকান থেকে সারিয়ে আনতে হয়েছিল। অত্যন্ত কাছে থেকে জোরাজুরি ছাড়া এমন কান্ড কেমন করে ঘটতে পারে তা আমার পক্ষে বুঝে ওঠা মুশকিল। নজরুল ইসলাম আমার কাছে ও ফজিলতুন্নেসার কাছ যেসব দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এমন অঘটন কিছু ঘটেছিল যাতে ফজিলতের হৃদয় তিনি জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন”।
(চলবে…………………………………………)
------------------------------------------------------------------------
এবার আমার কিছু কথা। এই পর্বের ঘটনা গুলো যে সব স্থানে ঘটে ছিল সেগুলো আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা মডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী তাদের কাছে খুবই পরিচিত এবং অবশ্যই অন্য অনেকের কাছেও। প্রতিদিনই আমাদের আসা যাওয়া চলে এই এলাকা গুলোতে।
নজরুল যেই বর্ধমান হাউসে উঠেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় সেটি আজকের বাংলা একাডেমী ভবন। সেই রাতে নজরুল যে পথে তার ভাষায় ‘জ্যোতির্ময়ী নারীকে’ অনুসরণ করেছিলেন, সেই পথ বাংলা একাডেমী থেকে শুরু হয়ে, দোয়েল চত্তর, শহিদুল্লাহ হল অতিক্রম করে চানখার পুলের দিকে যায়। ‘নিরব হোটেল’ –যাবার পথে নাজিমউদ্দিন রোডের রাস্তার বাম দিকে আমরা একটা লাল ভবন দেখতে পাই। ভবনের মূল ফটকে শ্বেত পাথরে লেখা আছে ‘হাসিনা মঞ্জিল’, স্থাপিত ১৯২১। এরই আশে পাশে কোথাও আছে ফজিলতুন্নেসার সেই বাড়িটি। আর রমনা পার্কের কথা আলাদা বলার প্রয়োজন নেই। তবে, এই কাহিনী পড়বার পরে যখনই রমনা লেকে যাই, লেকের পাড়ের বড় বড় গাছ গুলো দেখে মনে হয় এরা সবাই সেই দিনের সাক্ষী। হয়ত খানিক্ষণ এদের কোনটির পাশেই প্রেম প্রত্যাখাত নজরুল বসেছিলেন, হয়ত নিজে নিজে গুন গুন করেছিলেন এমন কোন গান যার কলিগুলো আমাদের অজানাই রয়ে যাবে।
সূত্র:
১. 'আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান' - কাজী মোতাহার হোসেন; স্মৃতিকথা-প্রবন্ধসংকলন
২. (ছবি - ব্লগার অ্যামেটারের পোস্ট )
ফজিলতুন্নেসা পর্ব~৩
পোস্টের সাথে সম্পর্কহীন মন্তব্য এখানে না করবার অনুরোধ করা গেল। অনুগ্রহ করে এই লিংকে গিয়ে মন্তব্য করুন।