নার্গিস পর্ব || প্রমীলা পর্ব-১
তৃতীয় বার (১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে) কবির কুমিল্লা ত্যাগের পূর্বে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। প্রমীলা (দোলন)-নজরুলের সম্পর্কের কথা কুমিল্লা শহরের তরুণ সমাজে বেশ হিংসাত্বক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুসলমান নজরুলের হিন্দু বাসায় থাকা, সেই সাথে হিন্দু মেয়ে প্রমীলার সাথে দহরম-মহরমের একটা বিষক্রিয়া সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। এক হিন্দু যুবকের নেতৃত্বে একদল হিন্দু ছাত্র নজরুল রথ দর্শনে গেলে তাকে অপমান ও লাঞ্ছিত করতে চেষ্টা করে। কুমিল্লার রক্ষণশীল হিন্দু মহলে এ ব্যাপারে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এমনকি নজরুলকে আক্রমন করতে গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়া হয়। শহরের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি নজরুলকে রক্ষা করেন এবং একরাতে আসাম-কলকাতা মেইল যোগে তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন।
তৃতীয় বার কুমিল্লায় কবি দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। অনেক বিখ্যাত গান এই সময়ে লেখা। বিজয়িনী, প্রলয়োল্লাস তার এই সময়ে লেখা বিখ্যাত কবিতা। এর মাঝে অনেক কবিতায় তিনি প্রমীলার রূপে বর্ণনা তুলে ধরেন, যেমন প্রিয়ার রূপ,দোদুল দুল প্রভৃতি কবিতা। ‘দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে দেন:
মৃণাল - হাত
নয়ান - পাত
গালের টোল,
চিবুক দোল
সকল কাজ
করায় ভুল
প্রিয়ার মোর
কোথায় তুল?
কোথায় তুল?
কোথায় তুল
... ... ... ... ...
কাকঁল ক্ষীণ
মরাল গ্রীব
ভুলায় জড়
ভুলায় জীব,
গমন – দোল
অতুল তুল্ ।
দোলন চাঁপা কাব্য গ্রন্থে সবার আগে এই কবিতাটি রয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়।
এদিকে ততদিনে নজরুল “ধুমকেতু” সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে তাতে সরকার বিরোধী বক্তব্য রাখেন। বৃটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সেই সময় গিরিবালা দেবী প্রমীলা সেনগুপ্তকে নিয়ে বিহারের সমস্তিপুরে অবস্থান করছিলেন। নজরুল বিহার হতে গিরিবালা দেবীকে প্রমীলা সহ কুমিল্লা পৌছে দেবার জন্য কুমিল্লার পথে রওয়ানা দেন। মোটামুটি, এই যাত্রাই নজরুল-প্রমীলার বিয়ের ব্যাপার পাকাপাকি হয়ে যায়। কুমিল্লায় ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর নজরুল গ্রেফতার হন। ১৯২৩ সালের ৮ জানুয়ারি তার একবছরের কারাদন্ডের আদেশ হয়।
নজরুলের কারাদন্ড হওয়ায় দেশ ব্যাপি হৈ চৈ পড়েযায়। এর আগে অবশ্য তিনি ‘ধুমকেতু’-এর স্বত্ত প্রমীলার চাচি বিরজা সুন্দরী দেবীর নামে হস্তান্তর করেন। নজরুলের গ্রেফতারের খবরে ব্যথিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বসন্ত’ নাটকটি তাকে উৎসর্গ করেন। এদিকে নজরুল কারারক্ষীদের সাথে জেল কর্তৃপক্ষের খারাপ আচরণ ও কারা নির্যাতনের প্রতিবাদে হুগলি জেলে অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে অনশন ভঙ্গের জন্য অনুরোধ করে টেলিগ্রাম পাঠান Give up hunger strike, our literature claims you। অথচ নজরুল অনশন ভাঙলেন না। নজরুলের আপন মা জাহেদা খাতুনও চুরুলিয়া থেকে অনশন ভাঙতে জেলে আসেন, কিন্তু নজরুল জেল গেটে কারো সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন। অবশেষে বিরজা সুন্দরী দেবী নজরুলের অনশন ভাঙাতে সক্ষম হন।
১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কবি বহরমপুর জেল হতে মুক্ত হন এবং সরাসরি চলে যান কুমিল্লায়। এর সম্পর্কে নজরুলের বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন লিখেছেন, “মুসলিম জগতে’র তৎকালীন সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সাথে এ আলোচনায় কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি। কিন্তু কোথায় নজরুল? বহরম পুর জেলে নজরুল আর নেই-সারা কলকাতায় নজরুল নেই। কোথায় তিনি? তাঁর অগনিত ভক্তবৃন্দক একে বারে পথে বসিয়ে তিনি সরে পড়েছেন কুমিল্লায় – এক নিভৃত পল্লীতে”।
(প্রমীলা পর্ব-৩)
সূত্র: নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম; ড. আবুল আজাদ
(ছবি সূত্র )