মেডিটেশন বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। আমাদের দেশে তেমন একটা জনপ্রিয় না হলেও পশ্চাত্যের দেশগুলোতে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। মেডিটেশনের উৎপত্তি আমাদের প্রাচ্যের দেশগুলোতে। আরব-চীন, জাপান, ভারতের সুফি-লামা-সাধু-মুণি-ঋষিরা কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই এই ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছেন। মুসলমানদের নামাজও একধরনের মেডিটেশনই বটে। আমরা সাধারণ লোকজন মেডিটেশনকে মনের প্রশান্তির জন্য বা অস্থিরতা দূর করবার একধরনের চর্চা বলে মনে করি। এরযে নানা ব্যবহারিক দিক থাকতে পারে তার অনেকেই ভেবে কুলাতে পারি না। আমাদের বোঝা উচিত, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যে ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে তার ব্যবহারিক দিক না থেকে পারে না। আর যার ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব তার অবশ্যই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকবে।
সহজ ভাষায় মেডিটেশন কি? মেডিটেশন হল নিজের মনকে নিয়ন্ত্রনের রাখবার একধরণের চর্চা। মন দিয়েই জীবন চালিত হয় অতএব, মেডিটেশনের আসলে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রনের একটা উপায়। অস্থিরতা, রাগ, শোক, উচ্ছাস বা অন্যান্য মানবীয় ব্যাপার মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মনের যেমন পার্থিব অস্তিত্ব নেই (যতদূর জানি) তেমনি রাগ, শোক, অস্থিরতা, উচ্ছাস আনন্দ ইত্যাদিও অপার্থিব। একটি অপার্থিব সত্ত্বা অন্যান্য অপার্থিব গুনাবলীকে নিয়ন্ত্রন করবে তা ভাবতে আমাদের কষ্ট হয় না। কিন্তু যখনই দেখি অপার্থিব সত্ত্বা পার্থিব জগতের উপাদানকে নিয়ন্ত্রন করছে তখন আমরা কেউ এটাকে বলি আলৌকিক এবং অন্যরা বলি কাকতলীয়। উভয় পক্ষই এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের খুব একটা ধার ধারি না অথবা, নিজেরা কিছু কিছু যুক্তি বানিয়ে নেই।
বাস্তব হল, অপার্থিব মন দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত পার্থিব জগতের উপাদান গুলোকে নিয়ন্ত্রন করছি। এর কারন আমাদের মানবিক গুনাবলী এই রক্ত-মাংসের শরীরের অদ্ভুতসব জৈব অণুর জটিলসব পারস্পরিক সম্পর্কের ফসল। দেহের জৈব রাসায়নিক গঠন যদি মনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে তবে মনের পক্ষেও উল্টোটা করা সম্ভব। মন ও শরীরের এই আন্তঃসম্পর্ক সব চাইতে সহজে বোঝানো যায় মানুষের যৌন প্রবৃত্তির দ্বারা। যেমন যে কোন সুস্থ সাধারণ পুরুষ শুধু চিন্তার মাধ্যমে তার sexual system কে উত্তেজিত করতে পারে। sexual organ তো আর এমনি এমনি উত্তেজিত হ্য় না এর জন্য অনেক biochemical signaling pathway আছে, অনেক gene eর expression এর সাথে জড়িত। এটা একটা বড় উদাহরণ যে আমরা আমাদের চিন্তার দ্বারা দেহের জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম। আবার অনেক ড্রাগ আছে যা আমাদের মানসিক অবস্থায়র উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম। যেমন antidepressant ড্রাগ। আবার দেখুন সিগারেটের নিকোটিন আমাদের এর অভাবে অস্থির করে ফেলে। সিগারেট ছেড়ে দেবার অনেক দিন পরেও সিগারেট দেখা বা এর গন্ধ পাওয়া মাত্র মন চঞ্চল হয়ে উঠে। এগুলো মনের উপর chemicals এর প্রভাবের উদাহরন। আবার প্রেমের ক্ষেত্রেই দেখা যাক। পুরুষ মাত্রই প্রেমে পড়লে ভাবুক হয়, ঠিক যেন পাগলা ঘোড়া শান্ত হবার মত। অন্য দিকে শান্ত লাজুক মেয়েটি প্রেমে পড়ে লাজুকতার আবরণ ছেড়ে চঞ্চল হয়ে উঠে। বাবা-মায়ের কাছে এসব সন্দেহজনক আচরণই ধরা খাইয়ে দেয়। দেখা গেছে প্রেমে পড়া পুরুষের দেহে নারীর হরমোন প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা তার আচরণে কোমলতা আনে। অন্য দিকে নারী দেহে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়ে যা তার মাঝে চঞ্চলতার সৃষ্টি করে।
মানুষ মনের শক্তির সাহায্যে তার জৈব পদার্থে নির্মিত শরীরকে দিয়ে এমন সব কাজ করে দেখিয়েছে যা আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানকে অনেক সময় প্রশ্ন বিদ্ধ করে। যেমন একবার এক ব্যক্তি অনেক্ষ বরফে ডুবে থাকবার বিশ্বরেকর্ড করেছিল। সে যতক্ষণ বরফে ডুবে ছিল তা তাপগতিবিদ্যার সূত্র মতে অসম্ভব, কিন্ত বহু বৎসরের সাধনা বা মেডিটেশন তাকে ঐ অসাধ্য সাধনে সমর্থ করে। বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই কাচা মাছ মাংস খাওয়া সম্ভব নয়। সেই একই মানুষকে সমুদ্রে নৌকাতে করে ছেড়ে দিন খাবার ছাড়া এক সময় সে ঠিকই কাচা মাছ খেয়ে বেচে রইবে। পার্থক্য কি দুইটি পরিস্থিতিতে? প্রথমটিতে ব্যক্তি বাধ্য নয়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে বাধ্য। কিন্তু সেই বাধ্য হবার ক্ষেত্রে তার কিছু জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া কাজ করে। মেডিটেশনের মাধ্যমে চরম খাদ্য সংকটের মত অবস্থা না এলেও মানুষের পক্ষে তার দেহে একই জৈবরাসায়নিক ঘটনা ঘটানো সম্ভব যা তাকে কোন প্রকার চাপ ছাড়াই কাচা মাংস মাছ খেতে সাহায্য করবে। এর ফলশ্রুতিতেই আমরা অনেক মানুষকে এহেন বিশ্রী সব কাজ করতে দেখি।
এবার রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে আসি। আমরা যদি শুধু চিন্তার মাধ্যমে দেহের তাপমাত্রা সহ্য ক্ষমতা, হরমোনের নিঃসরণের মাত্রা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রন করতে পারি তবে কেন ইমিউনো কেমিক্যাল যেমন cytokines, ILs, IFN ইত্যাদির মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে পারব না? আপাত দৃষ্টিতে এসব কথা খুব জটিল বা অবান্তর মনে হতে পারে। যারা cell biology সম্বন্ধে জানেন তারাদের কাছে এগুলো খুব একটা জটিল নয়। কারন তারা জানেন যে দেহের সব ক্রিয়াই মূলত কিছু সাধারণ নিয়মের ভিত্তিতে চলে। এসব উদাহরণের মাধ্যমে বোঝা যায় শুধু মনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে শরীরের অনেক কিছুই শুধু মনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা যায়। শুধু গভীর ভাবে জানতে হবে শরীর মনকে কি করে নিয়ন্ত্রন করে। অর্থাৎ মেডিটেশনের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব। নিউরোলজির উন্নয়নের সাথে সাথে হয়ত meditation একদিন medication এর বিকল্প হতে পারবে। আধুনিক যুগে জীব মস্তিস্কের জটিল গঠনের যতই সমাধান হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি মস্তিস্ক দিয়ে শুধুমাত্র নতুন নতুন উদ্ভাবন নয়, সরাসরিই এটাকে কাজে লাগানো সম্ভব। নিউরোলজির জ্ঞান যতই সমৃদ্ধ হবে ততই এর প্যাচ আরো খুলবে।
মেডিটেশনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। তবে মেডিটেশন শিখতে হয়, ঠিক যেমন মার্শাল আর্ট। মার্শাল আর্ট আসলে Human anatomy এর জ্ঞান ভিত্তিক একটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি। আর মেডিটেশন Neurology এর জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। অন্য সব ব্যবহারিক শিক্ষার মতই মেডিটেশন শিখবার জন্য ট্রেইনার প্রয়োজন। এর চাইতে বেশি কিছু না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:৫৮