রোহিঙ্গা লোকটি করজোড়ে মিনতি করছেন তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়ার জন্য। দু’চোখে ঝরছে অশ্রু। এই ছবিটাই অনেক কথা বলে দেয়। তবে যে কথাটা বলে না তা হলো, শেষ পর্যন্ত এ দেশে ঠাঁই মেলেনি তার এবং তার পরিবারের। তাকে নিশ্চয়ই নতুন কোনও আশ্রয়ের সন্ধানে যেতে হয়েছে। যেখান থেকে পালাতে চাচ্ছিলেন সেখানেই কি ফিরে গেছেন?
মায়ানমারে ভয়াবহ আতংকের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন এই লোকটির মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা মানুষ। তাই তারা ভিটেমাটি ছেড়ে কোনও রকমে নিজেদের প্রাণ আর পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে এসেছেন ভিনদেশে । সামান্য একটু আশ্রয়ের জন্য।
মৃত্যু-উপত্যকা ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এটা একটা চরম হিপোক্রেসি। আমরা, এই বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি অর্জনের ইতিহাস কি ভুলে গেছি? শরণার্থী হয়ে একসময় আমরাও তো ঠাঁই নিয়েছিলাম প্রতিবেশি দেশে। সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার যে বিকাশের সুযোগ হয়েছিল, তার কথা আমরা গর্ব করে বলি। আমাদের শরণার্থীরাই ভারতের আশ্রয়ে থেকে স্বাধীনতা অর্জনে বড় একটি ভূমিকা রেখেছিলেন। আমরা এসব বলতে ভালোবাসি। এ তো গেলো আমাদের অতীতের কথা। আমাদের ভবিষ্যত কী বলে? জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ দেশ থেকে শিগগিরই অনেক লোককে জলবায়ু-শরণার্থী হিসেবে ঠাঁই নিতে হবে ভিনদেশে। তখন কী হবে?
বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক এবং একই সঙ্গে অবিবেচকের মতো একটি কাজও বটে।
মায়ানমার এমন একটি দেশ যেখানে অনেক জাতি-গোষ্ঠীর বাস। আর এসব গোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সংঘাত লেগেই আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজদের সঙ্গে বড় বড় এথনিক গ্রুপ কাচিন-কারেনদের সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা অতীতে ঘটেছে, এখনও ঘটছে। বার্মিজদের সঙ্গে অন্যদের সংঘাতের আরেকটি কারণ কচ্ছে ধর্মীয়। বার্মিজরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অন্যরা তা নয়। জাতিগত সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় বৈপরীত্য মিলে মায়ানমারের জাতি-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভয়ংকর ও রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের ঘটনা অনেকবারই দেখা গেছে।
রাখাইন বৌদ্ধ আর রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে কয়েক প্রজন্ম ধরেই সংঘর্ষ চলছে। সম্প্রতি এক রাখাইন বৌদ্ধ নারীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করার পর দু’পক্ষের মধ্যে আবার সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে। কারণ এই নারীকে রোহিঙ্গা মুসলিমরাই ধর্ষণ ও হত্যা করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।
প্রতিশোধ নিতে ওরা মুসলিম যাত্রীবাহী একটি বাস আটক করে দশজন যাত্রীকে বের করে এনে হত্যা করে। ভীত-সন্ত্রস্ত্র রোহিঙ্গারা এরপর থেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
বাংলাদেশ বা মায়ানমার, কোনও দেশের সরকারই রোহিঙ্গাদের এই মানবিক সমস্যার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেবে না। আর এ ধরনের কোনও প্রটোকলেও বাংলাদেশ কখনও স্বাক্ষর করেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে এ কথাও বললেন যে, মায়ানমারে রাখাইনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত তৈরি করার পেছনে জামাতে ইসলামীর একটি ভূমিকা রয়েছে। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি, অনেকটা মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সুরের সঙ্গে তার সুরটা মিলে গেছে। মায়ানমারের এই ধরনের জাতিগত সংঘাতের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে প্রকারান্তরে সমর্থন না দিয়ে সমাধানের কথা বলতে পারতেন তিনি। বিশেষ করে বাংলাদেশ যে বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে, সেটির সমাধানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কথা ভাবা দরকার ছিল।
১৯৭১ সালে একই পরিস্থিতিতে আমরা যখন ভারতে শরণার্থী হয়েছিলাম তখন সেখানে আমাদের সাদরে বরণ করা হয়নি। কিন্তু ওদের সরকারি নীতিমালাই অবস্থাটাকে সহনীয় করে তুলেছিল। অনেকেই মনে করেন, ভারত তো চেয়েছিলোই পাকিস্তানকে দু’খণ্ড করতে। তাই দয়া নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকেই ভারত বাংলাদেশি শরণার্থীদের সেখানে আশ্রয় দিয়েছিল। অবশ্যই ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। কিন্তু এই সত্যকে তো অস্বীকার করা যাবে না যে, নানারকম হুমকি সত্বেও ভারত আমাদের শরণার্থীদের বুকে ঠাঁই দিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারত। এমনিতে দেশের ভেতরে ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। গুম-খুন-পুলিশের হেফাজতে হত্যা ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে আবদ্ধ বাংলাদেশের ইমেজটা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে বদলে যেতে পারত। অন্তত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটুকু বুঝতে পারত যে, দারিদ্র্য আমাদের মনকে দরিদ্র করতে পারেনি। আমরা বিপদগ্রস্তকে আশ্রয় দেওয়ার মতো মানবিকও হতে পারি। আর এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের জন্য বাস্তবসম্মতও হতো। কারণ আর খুব বেশি দিন বাকি নেই জলবায়ু-শরণার্থী হয়ে আমাদেরও অন্য দেশের দরজায় কড়া নাড়তে হবে।
এর আগেও শরণার্থী হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঠাঁই নিয়েছিল। তখন কিছু আরব ও পাকিস্তানি ইসলামী চরমপন্থী গ্রুপ এই রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেছে। এ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বোমা, অস্ত্র ইত্যাদি সরঞ্জামকে সহজলভ্য করে দিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই ছিল এদের সহজ টার্গেট। আমাদের মিডিয়াতে এসব তথ্য এসেছে।
তখনকার বিএনপি সরকার বিষয়টা জেনেও নীতিগত কারণে এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলো, তারা চাইলে এসব বন্ধ করতে পারত। নিরাপত্তার অজুহাতে কাজটা করা হয়নি। এটা খুবই খোঁড়া এবং অযৌক্তিক একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল।
যে কোনও দেশেই শরণার্থীদের ঠাঁই দেওয়া এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ। আমাদের মতো দরিদ্র ও বিপুল জনসংখ্যার দেশের জন্য এটা তো আরও ঝামেলার। কিন্তু একই কারণে আমরা আবার কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায়ও আছি। আমাদের দারিদ্র্য এতটাই বিস্তৃত যে সামান্য এই জনগোষ্ঠীকে খাওয়াতে-পরাতে গেলে আমাদের ওপর এর বড় কোনও প্রভাব পড়বে না। এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার সঙ্গে আরও কয়েক হাজার লোক বাড়তি যোগ হলেও সমস্যা নেই। আর বাঙালিরাই তো বছর শেষ হওয়ার আগে আমাদের জনসংখ্যাকে আরও অনেক বেশি ভারি করে তুলবে।
আসলে এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি। তাই বিশেষভাবে একে বিবেচনা করতে হবে। কেউ তো বলেনি যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে দিতে হবে। শুধু তাদের আশ্রয় দিতে বলা হচ্ছে। যাতে তারা এ মুহূর্তে মৃত্যু আর দুর্ভোগের হাত থেকে রেহাই পায়।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর বলেছিলেন, ‘দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত আমাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছে। এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’ আর এখন আমরা সেই স্পিরিটকে ধ্বংস করছি। আশ্রয়-প্রত্যাশীকে আশ্রয় না দিয়ে।
এমনকি জামাতে ইসলামী যদি রোহিঙ্গাদের প্ররোচিত করেও থাকে, শুধু এই যুক্তিতে ওদের আশ্রয় না দেওয়ার কোনও ভিত্তি নেই। একটি রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে কী করল না করল, সে যুক্তিতে নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেওয়া হবে না কেন? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিন্তু অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর নীতি মেনেই পরস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। সবচেয়ে বড় কথা, কে বলেছে যে জামাতে ইসলামী কাজটা করছে? এর পক্ষে কী কী তথ্য-প্রমাণ আছে? রোহিঙ্গারা যে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে এটা তো মিথ্যা নয়!
অদূর ভবিষ্যতে জলবাযু-শরণার্থী হয়ে আমরা যখন অন্য দেশে যেতে চাইব, আমাদের সঙ্গে তখন কী ব্যবহার করা হবে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে ভারত বা মায়ানমারেই আমাদের শরণ নিতে হবে। ভারতে তার সীমানার চারদিকে যেভাবে কাঁটাতারের বেড়া বিছিয়েছে, এটা নিশ্চয়ই সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। তার মানে, বাংলাদেশিরা তাদের কাছে আর গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের সরকার ভালোভাবেই জানে কীভাবে শরণার্থী প্রজন্মকে ডিল করতে হয়। সুতরাং আমাদের যখন আবার শরণার্থী হওয়ার সময় হবে তখন অবস্থা কী দাঁড়াবে তা বোঝাই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে হিসেবে নিলে সবসময়ই আমাদের কিছু শরণার্থী জনগোষ্ঠী রয়েছে। ভারতে যত লোক অবৈধভাবে কাজ করে তাদের ফেরত পাঠানো হলে কী হবে? কোন মুখে আমরা বলব যে, এই সব গরীব খেটে খাওয়া লোকগুলোকে এভাবে ফেরত পাঠানো হলো!
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এমন ব্যবহারে ভারত বরং খুশিই হবে। কারণ আমরা এখন আর বলতে পারব না যে, ফেলানিদের মতো গরীব মানুষগুলোকে ওভাবে মেরে ঝুলিয়ে রাখা ঠিক নয়। আজ মায়ানমার থেকে যে রোহিঙ্গারা এখানে আসছেন তারাও ফেলানিদের মতোই। দরিদ্র, অসহায়। ভারত আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করছে, একই আচরণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে করে আমরা ভারতের হাতে একটা যুক্তি তুলে দিচ্ছি। এতটাই আনাড়ি আমরা।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করা একমাত্র আমাদের মতো দেশের পক্ষেই সম্ভব। কারণ, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এতটাই অদক্ষ যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনও ইতিবাচক নেগোশিয়েসনের ক্ষমতা রাখে না। শরণার্থীদের জন্য যে বিরাট আন্তর্জাতিক তহবিলের প্রবাহ থাকে সে সব টেনে আনার ক্ষমতাও আমাদের নেই। তাছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের সঙ্গে কোনও ধরনের দরকষাকষি করার মতো দক্ষতাও দেখাতে পারি না আমরা।
আজ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি আমরা। এই আমরাই অতীতে বিপুল শরণার্থী গোষ্ঠী হিসেবে অন্যের আশ্রয় নিয়েছি। এখনও নিচ্ছি। ভবিষ্যতেও আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে হবে আমাদের।
আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত দুটোকেই কি আমরা শেষ করে দিচ্ছি না?
আফসান চৌধুরী : নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।