somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওই ছোটোলোকের পোলাটা কিন্তু বীরপ্রতীক ছিল

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভোর ৫:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ বছরের ২৫ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করছিলেন শহীদুল ইসলাম। দুটো কিডনিই অকেজো, পানি এসে গেছে গোটা শরীরে। আশে পাশে মুমূর্য রোগী এমন শ’খানেক প্রতিদিনই ছটফট করে। ডাক্তার-নার্স-ওয়ার্ডবয়দের চোখ সওয়া। নতুন করে টানে না। ছটফটানি একসময় থামে। স্বজনদের আহাজারি বলে দেয় শহীদুল ইসলাম আর নেই। কুকুরের মতো জীবন যাপন করে, কুকুরের মতো মৃত্যুবরণ করা শহীদুল ইসলামের দাফনটা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের হাতে হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবরে শুয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার-নার্স-ওয়ার্ড বয়রা হয়তো খবরের কাগজ পড়ে জেনেছেন সেটা। জেনে আশ্চর্য হয়েছেন। কারণ ওই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় ছটফট করা, আর্তনাদ করা লোকটা নাকি নামকরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। শহীদুল ইসলাম ওরফে লালু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক ছিলেন।

পরদিন দেশের সর্বোচ্চ প্রচার হওয়া দুটো বাংলা ও ইংরেজী দৈনিকে পুরো পাতা জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের চিঠি সংকলনের বিজ্ঞাপন ছিলো। বাংলা কাগজে শহীদুল ইসলাম লালুর জায়গা হয়েছিলো একদম ভিতরের দিকে ১৯-এর পাতায় এক কলাম কয়েক ইঞ্চির একটা খবরে। ইংরেজী পত্রিকাটির হয়ে সংবাদটি যোগান দিয়েছেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা। তারপরও মিডিয়াকে সার্বিকভাবে দুষবার জো নেই। এ বছর ২৭ মার্চ প্রেস ক্লাবে শহীদুল ইসলাম লালুকে চিকিৎসা বাবদ থোক টাকা দিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। শেরে বাংলা নগর কিডনী হাসপাতালে তাকে ভর্তি ও চিকিৎসা খরচ চালিয়েছেন দুই টিভি সাংবাদিক খন্দকার ইসমাইল ও হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। কিন্তু ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা কতদিন আর ব্যক্তি উদ্যোগে সম্ভব। ঢাকা মেডিকেলে ট্রান্সফার করা হয় তাকে। সেখান থেকে ফিরে যান বাড়িতে। বাড়ি বলতে মীরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ময়লার ঢিবির ওপর কোনোমতে চালা টাঙ্গিয়ে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকা। সেটাও কর্তৃপক্ষের দয়ার দান। লালু আদায় করে নিতে পারেননি তার বীরপ্রতীক সনদের জোরে। খুব ক্লেশভরেই বলেছিলেন- আমার থিকা অল্প বয়সী লোকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে। কিভাবে তুলে! আমি ১২ বছর বয়সে যুদ্ধ করছি, তারা কত বছর বয়সে করছে? রাজনীতির কারণে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুইকা গেছে, তারা ভাতাও তোলে। আর আমার পোলাপাইন না খাইয়া থাকে। কি করুম, আমি মূর্খ মানুষ। ছোটো লোকের পোলা।

লালুর কণ্ঠে বিস্ময় নয়, মেনে নেওয়া ছিলো। তিনি নিজেই কি জানতেন তার কৃতিত্বের কথা! ‘৯৮ সালের দিকে ছাপড়া হোটেলের কড়াইয়ে হাতা নাড়তে নাড়তে টিভির দিকে নজর যায়, শোনেন যুদ্ধে বীরত্বের জন্য খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার ভাতা বরাদ্দ করেছে। ক্যাশে বসা মালিকের ছেলের কাছে জানতে চান বিস্তারিত। বাবুর্চির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কি সম্পর্ক থাকতে পারে তা হয়তো হোটেল কর্তার মাথায় ঢোকে না। সে হুড়ো দেয়। কাজে যেতে বলে। টিভিতেই চোখে পড়ে কাদের সিদ্দিকী। তার একসময়কার কমান্ডার। একাত্তরে এই বাঘা সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীর তান্ডবেই গোটা টাঙ্গাইল আর মধুপুর অঞ্চল জুড়ে তটস্থ থাকতো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। লালু গোছগাছ সারেন, কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

দীর্ঘদিন পর লালুকে দেখে অবাক হন কাদের। তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। লালু জানতে পারেন তার বীর প্রতীক খেতাবের কথা। তাৎক্ষণিক কিছু পদক এবং অর্থ জোটে। জোটে পরের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তরফেও। কিন্তু খেতাব আর পদক ধুয়ে তো পেট চলে না। সংসার চলে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ভাতার একটি পয়সার মুখও তার দেখা হয়নি। তার জোটেনি। ‘আমি ভাই স্বীকৃতির জন্য কিংবা ভাতা পামু বইলা যুদ্ধ করি নাই। দেশরে ভালোবাইসাই করছি। আমার চাওয়া বলতে আমার সন্তানগুলান যেন মাথা উচু কইরা এই সমাজে চলতে পারে।’ সেই সম্ভাবনা ক্ষীন। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে থেকেই বেতন দিতে না পারায় স্কুল থেকে নাম কাটা গেছে লালুর ছেলের। সে হয়তো বাবার মতোই বাসন ধোয়, গ্লাস মাজে। দিন শেষে কিছু খাবার এনে মা আর তিন ভাইবোনের সঙ্গে ভাগ করে খায়। শহীদুল ইসলাম লালু বীরপ্রতীকের সন্তান।

লালু নিজেও এর ভেতর দিয়ে গেছেন। পড়াশোনা জানেন না। যুদ্ধের পর ওয়ার্ডবয়ের চাকুরী নিলেন টাঙ্গাইল হাসপাতালে। ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সব এলোমেলো হয়ে গেলো। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের তখন খোঁজা হচ্ছে। কাদের সিদ্দিকী ফেরার। কমান্ডারের নির্দেশনা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। লালুও পালালেন। নরসিংদি-চট্টগ্রাম-ময়মনসিং-নারায়নগঞ্জ-ঢাকা। কখনও রেলস্টেশনের কুলি। কখনও ৩০ টাকা মাসকাবারিতে গ্লাসবয়ের কাজ, কখনও রাধুনি। এই দারিদ্রতার মাঝেই মুন্সীগঞ্জের মালা বেগমকে ঘরে আনেন। একে একে জন্ম নেয় চার সন্তান-দুই ছেলে, দুই মেয়ে।

পাকিস্তানী কয়েদ থেকে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর কোলে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধারই। শহীদুল ইসলাম লালু। কি তার বীরত্ব? একটু পেছন থেকেই বলা যাক। যুদ্ধের সময় ভেঙ্গুল কেরমাজানি বাজারে লালুর চোখে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ির দল। ‘আমারে আপনাগো লগে লন’-আব্দার তার। এত ছোটো ছেলে যুদ্ধ করবে কি। লালুর তাতে কিছু যায় আসে না, সে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ফাইফরমাশ খাটা শুরু করে দেয়, অস্ত্রশস্ত্র পরম যত্নে পরিষ্কার করে। পাহাড়ি এরপর সদলে সীমান্ত পাড়ি দেন। মেঘালয়ের তুরাতে ট্রেনিঙ নেন। লালুও জুটে যান। তার কাজ ছিলো ভোরে উঠে হুইসেল বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্যারেডের জন্য ডাকা। এরপর জাতীয় পতাকা টাঙ্গানো আর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। তার সঙ্গী ছিলো সমবয়সী আরেক কিশোর বুলু। দুজনকেই বিচ্ছু বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রেনাররা তাদের শেখান কিভাবে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়, অস্ত্র চালাতে হয়, গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, শত্রুর গতিবিধির খবর নিতে হয়। আসার পথেই মাইনকার চরে কাদের সিদ্দিকীকে প্রথম দেখেন লালু। ২৫ দিনের ট্রেনিং শেষ করে তার দলে ভিড়ে যান।

অপারেশন গোপালপুর থানা নামে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ঘটনাটি একান্তই শহীদুল ইসলাম লালুময়। যুদ্ধের উত্তুঙ্গ দিনগুলোতে গ্রুপ কমান্ডার পাহাড়ি তাকে নির্দেশ দেন গোপালপুর থানার হালহকিকত জেনে আসতে, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে তা দখল করতে পারে। লালু গিয়ে সেখানে তার এক দূর সম্পর্কের তুতো ভাই সিরাজের দেখা পান। সিরাজ পাকিস্তানী সেনাদের দালালী করে, তাকেও একই কাজ করার প্রস্তাব দেয়। লালু রাজী হয়ে যান। পরের দফা তিনটি গ্রেনেড নিয়ে থানায় হাজিরা দেন তিনি। অল্পবয়স বলে তাকে চেক করা হয় না। মুক্তিযোদ্ধাদের আগেই জানান দিয়ে রেখেছিলেন তার অভিপ্রায়। পুরো পুলিশ স্টেশন একবার চক্কর মেরে এসে, এক বাংকারে প্রথম গ্রেনেড চার্জ করলেন লালু। ভীত ও হতভম্ব পাকিস্তানীরা আন্দাজে গুলি ছুড়তে শুরু করে লক্ষহীন। শুয়ে লালু দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ছোড়েন, কিন্তু এটা ফাটে না। এখান থেকে আর বেরুনো হবে না- এই ভয় পেয়ে বসে তাকে। তারপরও তৃতীয় গ্রেনেডটি সশব্দে ফাটে আরেকটি বাংকারে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও এগিয়ে এসেছেন। গোলাগুলির এই পর্যায়ে সিরাজ এসে লালুকে একটি অস্ত্র ধরিয়ে দেয়, জিজ্ঞেস করে চালাতে পারে কিনা। লালু তাকে পয়েন্ট ব্ল্যান্ক রেঞ্জে গুলি করেন। এই ঘটনায় কিছু পাকিস্তানী পালায়, কিছু ধরা পড়ে, মারা যায় অনেক। হতাহতের মধ্যে দিয়েও মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেন গোপালপুর থানা। বলতে গেলে শহীদুল ইসলাম লালুর একক কৃতিত্বে।

এইভাবে একদিন দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়। জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা বিরোধীরা ঠাটে ফেরে। আর লালুদের ঠাই হয় আস্তাকুড়ে। সেখানেই একদিন তারা ধুকে ধুকে মরে যায়। যে পতাকার জন্য জীবনবাজি, মরণের পর সেটা কফিনে মোড়ক হয়। এই বাংলাদেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার এটাই রাষ্ট্রীয় সম্মাণ। মরোণত্তর যদিও।

কৃতজ্ঞতা : নজরুল ইসলাম

ছবি : বঙ্গবন্ধুর কোলে শহীদুল ইসলাম লালু (আফতাব আহমেদ)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৩১
২৯১টি মন্তব্য ২৫৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×