পরদিন দেশের সর্বোচ্চ প্রচার হওয়া দুটো বাংলা ও ইংরেজী দৈনিকে পুরো পাতা জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের চিঠি সংকলনের বিজ্ঞাপন ছিলো। বাংলা কাগজে শহীদুল ইসলাম লালুর জায়গা হয়েছিলো একদম ভিতরের দিকে ১৯-এর পাতায় এক কলাম কয়েক ইঞ্চির একটা খবরে। ইংরেজী পত্রিকাটির হয়ে সংবাদটি যোগান দিয়েছেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা। তারপরও মিডিয়াকে সার্বিকভাবে দুষবার জো নেই। এ বছর ২৭ মার্চ প্রেস ক্লাবে শহীদুল ইসলাম লালুকে চিকিৎসা বাবদ থোক টাকা দিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। শেরে বাংলা নগর কিডনী হাসপাতালে তাকে ভর্তি ও চিকিৎসা খরচ চালিয়েছেন দুই টিভি সাংবাদিক খন্দকার ইসমাইল ও হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। কিন্তু ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা কতদিন আর ব্যক্তি উদ্যোগে সম্ভব। ঢাকা মেডিকেলে ট্রান্সফার করা হয় তাকে। সেখান থেকে ফিরে যান বাড়িতে। বাড়ি বলতে মীরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ময়লার ঢিবির ওপর কোনোমতে চালা টাঙ্গিয়ে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকা। সেটাও কর্তৃপক্ষের দয়ার দান। লালু আদায় করে নিতে পারেননি তার বীরপ্রতীক সনদের জোরে। খুব ক্লেশভরেই বলেছিলেন- আমার থিকা অল্প বয়সী লোকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে। কিভাবে তুলে! আমি ১২ বছর বয়সে যুদ্ধ করছি, তারা কত বছর বয়সে করছে? রাজনীতির কারণে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুইকা গেছে, তারা ভাতাও তোলে। আর আমার পোলাপাইন না খাইয়া থাকে। কি করুম, আমি মূর্খ মানুষ। ছোটো লোকের পোলা।
লালুর কণ্ঠে বিস্ময় নয়, মেনে নেওয়া ছিলো। তিনি নিজেই কি জানতেন তার কৃতিত্বের কথা! ‘৯৮ সালের দিকে ছাপড়া হোটেলের কড়াইয়ে হাতা নাড়তে নাড়তে টিভির দিকে নজর যায়, শোনেন যুদ্ধে বীরত্বের জন্য খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার ভাতা বরাদ্দ করেছে। ক্যাশে বসা মালিকের ছেলের কাছে জানতে চান বিস্তারিত। বাবুর্চির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কি সম্পর্ক থাকতে পারে তা হয়তো হোটেল কর্তার মাথায় ঢোকে না। সে হুড়ো দেয়। কাজে যেতে বলে। টিভিতেই চোখে পড়ে কাদের সিদ্দিকী। তার একসময়কার কমান্ডার। একাত্তরে এই বাঘা সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীর তান্ডবেই গোটা টাঙ্গাইল আর মধুপুর অঞ্চল জুড়ে তটস্থ থাকতো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। লালু গোছগাছ সারেন, কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
দীর্ঘদিন পর লালুকে দেখে অবাক হন কাদের। তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। লালু জানতে পারেন তার বীর প্রতীক খেতাবের কথা। তাৎক্ষণিক কিছু পদক এবং অর্থ জোটে। জোটে পরের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তরফেও। কিন্তু খেতাব আর পদক ধুয়ে তো পেট চলে না। সংসার চলে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ভাতার একটি পয়সার মুখও তার দেখা হয়নি। তার জোটেনি। ‘আমি ভাই স্বীকৃতির জন্য কিংবা ভাতা পামু বইলা যুদ্ধ করি নাই। দেশরে ভালোবাইসাই করছি। আমার চাওয়া বলতে আমার সন্তানগুলান যেন মাথা উচু কইরা এই সমাজে চলতে পারে।’ সেই সম্ভাবনা ক্ষীন। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে থেকেই বেতন দিতে না পারায় স্কুল থেকে নাম কাটা গেছে লালুর ছেলের। সে হয়তো বাবার মতোই বাসন ধোয়, গ্লাস মাজে। দিন শেষে কিছু খাবার এনে মা আর তিন ভাইবোনের সঙ্গে ভাগ করে খায়। শহীদুল ইসলাম লালু বীরপ্রতীকের সন্তান।
লালু নিজেও এর ভেতর দিয়ে গেছেন। পড়াশোনা জানেন না। যুদ্ধের পর ওয়ার্ডবয়ের চাকুরী নিলেন টাঙ্গাইল হাসপাতালে। ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সব এলোমেলো হয়ে গেলো। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের তখন খোঁজা হচ্ছে। কাদের সিদ্দিকী ফেরার। কমান্ডারের নির্দেশনা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। লালুও পালালেন। নরসিংদি-চট্টগ্রাম-ময়মনসিং-নারায়নগঞ্জ-ঢাকা। কখনও রেলস্টেশনের কুলি। কখনও ৩০ টাকা মাসকাবারিতে গ্লাসবয়ের কাজ, কখনও রাধুনি। এই দারিদ্রতার মাঝেই মুন্সীগঞ্জের মালা বেগমকে ঘরে আনেন। একে একে জন্ম নেয় চার সন্তান-দুই ছেলে, দুই মেয়ে।
পাকিস্তানী কয়েদ থেকে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর কোলে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধারই। শহীদুল ইসলাম লালু। কি তার বীরত্ব? একটু পেছন থেকেই বলা যাক। যুদ্ধের সময় ভেঙ্গুল কেরমাজানি বাজারে লালুর চোখে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ির দল। ‘আমারে আপনাগো লগে লন’-আব্দার তার। এত ছোটো ছেলে যুদ্ধ করবে কি। লালুর তাতে কিছু যায় আসে না, সে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ফাইফরমাশ খাটা শুরু করে দেয়, অস্ত্রশস্ত্র পরম যত্নে পরিষ্কার করে। পাহাড়ি এরপর সদলে সীমান্ত পাড়ি দেন। মেঘালয়ের তুরাতে ট্রেনিঙ নেন। লালুও জুটে যান। তার কাজ ছিলো ভোরে উঠে হুইসেল বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্যারেডের জন্য ডাকা। এরপর জাতীয় পতাকা টাঙ্গানো আর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। তার সঙ্গী ছিলো সমবয়সী আরেক কিশোর বুলু। দুজনকেই বিচ্ছু বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রেনাররা তাদের শেখান কিভাবে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়, অস্ত্র চালাতে হয়, গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, শত্রুর গতিবিধির খবর নিতে হয়। আসার পথেই মাইনকার চরে কাদের সিদ্দিকীকে প্রথম দেখেন লালু। ২৫ দিনের ট্রেনিং শেষ করে তার দলে ভিড়ে যান।
অপারেশন গোপালপুর থানা নামে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ঘটনাটি একান্তই শহীদুল ইসলাম লালুময়। যুদ্ধের উত্তুঙ্গ দিনগুলোতে গ্রুপ কমান্ডার পাহাড়ি তাকে নির্দেশ দেন গোপালপুর থানার হালহকিকত জেনে আসতে, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে তা দখল করতে পারে। লালু গিয়ে সেখানে তার এক দূর সম্পর্কের তুতো ভাই সিরাজের দেখা পান। সিরাজ পাকিস্তানী সেনাদের দালালী করে, তাকেও একই কাজ করার প্রস্তাব দেয়। লালু রাজী হয়ে যান। পরের দফা তিনটি গ্রেনেড নিয়ে থানায় হাজিরা দেন তিনি। অল্পবয়স বলে তাকে চেক করা হয় না। মুক্তিযোদ্ধাদের আগেই জানান দিয়ে রেখেছিলেন তার অভিপ্রায়। পুরো পুলিশ স্টেশন একবার চক্কর মেরে এসে, এক বাংকারে প্রথম গ্রেনেড চার্জ করলেন লালু। ভীত ও হতভম্ব পাকিস্তানীরা আন্দাজে গুলি ছুড়তে শুরু করে লক্ষহীন। শুয়ে লালু দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ছোড়েন, কিন্তু এটা ফাটে না। এখান থেকে আর বেরুনো হবে না- এই ভয় পেয়ে বসে তাকে। তারপরও তৃতীয় গ্রেনেডটি সশব্দে ফাটে আরেকটি বাংকারে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও এগিয়ে এসেছেন। গোলাগুলির এই পর্যায়ে সিরাজ এসে লালুকে একটি অস্ত্র ধরিয়ে দেয়, জিজ্ঞেস করে চালাতে পারে কিনা। লালু তাকে পয়েন্ট ব্ল্যান্ক রেঞ্জে গুলি করেন। এই ঘটনায় কিছু পাকিস্তানী পালায়, কিছু ধরা পড়ে, মারা যায় অনেক। হতাহতের মধ্যে দিয়েও মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেন গোপালপুর থানা। বলতে গেলে শহীদুল ইসলাম লালুর একক কৃতিত্বে।
এইভাবে একদিন দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়। জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা বিরোধীরা ঠাটে ফেরে। আর লালুদের ঠাই হয় আস্তাকুড়ে। সেখানেই একদিন তারা ধুকে ধুকে মরে যায়। যে পতাকার জন্য জীবনবাজি, মরণের পর সেটা কফিনে মোড়ক হয়। এই বাংলাদেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার এটাই রাষ্ট্রীয় সম্মাণ। মরোণত্তর যদিও।
কৃতজ্ঞতা : নজরুল ইসলাম
ছবি : বঙ্গবন্ধুর কোলে শহীদুল ইসলাম লালু (আফতাব আহমেদ)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৩১