জুলাইর মাঝামাঝি কোনো এক সন্ধ্যা। ১৯৭১। কলকাতার সিআইটি রোডের একটি বহুতল ভবনের সাততলা। এখানেই থাকেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। মন্ত্রীসভার বাকিরা দিল্লীতে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী তলবে গেছেন। মোশতাক যাননি। দাওয়াত পাননি নাকি রাজধানী রক্ষার ভার তার হাতে- স্পষ্ট নয়। কলকাতাজুড়ে নানা গুজব ভাসছে। এর ভয়ঙ্করতমটি হচ্ছে পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার সব বন্দোবস্ত পাকা। ভারতের সাধ্য নাই সেটা ঠেকানো। এখন একটাই উপায় আপোষে যাওয়া। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে স্বাধীনতার দাবি ছাড়তে হবে। যদিও এইনিয়ে ইতিমধ্যেই শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যা বলার বলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু অনিশ্চিত সেই সময়কালে গুজবটা আরো ছানাপোনা জন্ম দিচ্ছে। এই গুজবের জনক হিসেবে যাকে সন্দেহ করা হয়, তার সঙ্গেই দেখা করতে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম এবং জেনারেল ওসমানীর পিআরও নজরুল ইসলাম।
তার ঘরে সোফায় বসতেই খন্দকার মোশতাক কিছু না বলে হু হু কান্না জুড়ে দিলেন। অতিথিরা বিব্রত। মোশতাক ডুকরে কেঁদেই চলেছেন। খানিকপর নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করলেন- মোশতাক ভাই কি হয়েছে? এতে কান্নার দমক আরো বাড়লো। প্রশ্নটা আবারও করা হলো। এবার কান্নার স্কেল চড়িয়ে মোশতাক বললেন- আমি বেচে থাকবো আর আমার নেতা শেখ মুজিব বেচে থাকবেন না-এটা আমি মেনে নিতে পারি না। এটা আমি ভাবতে পারি না নুরু। আমরা বেচে থাকবো দুনিয়ায় আর মুজিব আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে যাবেন দুনিয়া ছেড়ে। না না। এরপর পুরো বাংলা সিনেমার স্টাইলে চিৎকার করে বললেন- না, না। এটা কিছুতেই হতে দিতে পারি না আমরা।
এরপর যা বললেন, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। তাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সরাসরি বলে দিয়েছেন পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুজিবের প্রাণরক্ষা দুটো এক সঙ্গে সম্ভব নয়। যদি মুজিবের অনুসারীরা তাদের নেতার প্রাণরক্ষা করতে চান, তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকেই আপোষরফার চেষ্টা করতে হবে। ইন্দিরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। এবং মোশতাকের অভিমত একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই ক্ষমতা আছে বঙ্গবন্ধুকে সহিসালামতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার। সেক্ষেত্রে তাদের শর্তে রাজী হওয়াই উচিত। কারণ বঙ্গবন্ধুই যদি না থাকে, তাহলে কিসের স্বাধীনতা!
মোশতাক যা বলেছেন, অর্থাৎ ইন্দিরা-নিক্সনের কথাবার্তা এবং ইন্দিরা-মুজিবনগরের নেতৃবৃন্দের আলাপ, তার সত্যতা কতটুকু এ নিয়ে পরে বিস্তারিত আলাপ হবে। তবে ঘটনাটার উল্লেখ এ জন্যই যে এর কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লীতে তার পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাসে যোগাযোগ করেন। সেখানে মূলত মোশতাকের যুক্তরাষ্ট্র সফরের ইচ্ছা এবং তার ভিসার ব্যাপারেই আলোচনা হয়। এবং মাসের শেষ দিকে কুমিল্লারই আরেক সাংসদ জহিরুল কাইয়ুম কলকাতা দুতাবাসে যোগাযোগ করেন মোশতাকের প্রতিনিধি হিসেবে। এবং আলোচনায় ইঙ্গিত দেওয়া হয় মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে প্রয়োজনে স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ করতে রাজী মুজিবনগর সরকার। সাদাচোখে দেখলে এখানে তীব্র মুজিবপ্রেম বেয়ে বেয়ে পড়ছে মনে হলেও বাস্তবে তা ছিলো না মোটেও। এর আড়ালে ঘনাচ্ছিলো ভয়াবহ এক চক্রান্ত এবং মোশতাক তার কর্মকাণ্ড ও তৎপরতাকে জাস্টিফায়েড করার জন্য এসব অজুহাত ব্যবহার করছিলেন মাত্র।
২.
আওয়ামী লীগের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই দলীয় কোন্দল ছিলো সীমাহীন। একমাত্র শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বের কারণেই যা খুব নোংরামী রূপ ধারণ করতে পারেনি। যুদ্ধকালে তার অনুপস্থিতিতে সেটাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো। একদিকে ছিলো চরমপন্থী তরুণ তুর্কীরা। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে এরা দাবী করছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব তাদের হাতেই দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দিন স্রেফ উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক। ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যখন বেতার ভাষণ দিলেন এবং সেটা যখন বারবার আকাশবাণীতে প্রচার করা হচ্ছিলো, তখন ক্ষুব্ধ মনি দিল্লীতে বার্তা পাঠিয়ে তা বন্ধ করার অনুরোধ জানান।
মূলত, তাজউদ্দিনের মতো লিবারেল ঘরানার নেতৃত্বই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালনা করতে পেরেছেন। এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলীয় নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে তার উপর যথেষ্টই আস্থা রাখতেন মুজিব। মোশতাক ও তার মতো চরম ডানপন্থীরা স্বভাবতই মেনে নিতে পারেননি তাজউদ্দিনের নেতৃত্ব। মুক্তিযুদধের গোটা সময়টাই তাই তার কেটেছে তাজউদ্দিনকে উৎখাত করতে। এজন্য শেখ মনিকে নানাভাবে উস্কানীও দিয়েছেন তিনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপোষ যখন ভেস্তে গেলো তখনও হাল ছাড়েননি মোশতাক। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের নেতৃত্বে ৪০জন এমপির সাক্ষর করা আবেদন পত্র দাখিল করিয়েছেন তাজউদ্দিনকে অযোগ্য ঘোষণা করে।
মোশতাকের ইগোতে লাগার যথেষ্ট কারণ ছিলো বৈকি। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি। শেখ মুজিব অন্তরীণ থাকার সময় যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের সঙ্গে মতভেদ ঘটেছে একবারই। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে ভাসানী-মুজিব যখন দলকে ধর্মনিরপেক্ষ করার দাবি তুলে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার দাবি তুললেন, মোশতাক বিরোধিতা করেছেন। এজন্য এডভোকেট আলী আমজাদ খান, আবদুস সালাম ও হাশিমউদ্দিনকে নিয়ে পাল্টা সংগঠন গড়লেন। যদিও কিছুদিন পর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফের চলে এলেন মূল দলে। পাঁড় কম্যুনিস্ট বিরোধী মোশতাক ১০ এপ্রিল কলকাতায় পৌছেই শুনলেন তাকে স্রেফ হাইকমান্ডের একজন হিসেবে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে বামঘেষা তাজউদ্দিন কিনা প্রধানমন্ত্রী! অথচ দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই দায়িত্ব তারই পাওনা। অভিমানে মোশতাক জানালেন উনি পদত্যাগ করলেন। তার ইচ্ছা মক্কা চলে যাবেন। এবং বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন। পাকিস্তানে আর ফিরবেন না। (চলবে)
সূত্র :
একাত্তরের রণাঙ্গন কিছু অকথিত কথা (নজরুল ইসলাম)
মূলধারা '৭১ (মঈদুল হাসান)
বাম রাজনীতির ৬২ বছর (ফাইজুস সালেহীন)