২৫ মার্চ, ১৯৭১। অপারেশনে নেমেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আনুষ্ঠানিক নাম- অপারেশন সার্চলাইট। বাস্তবে নির্বিচার হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও। স্বাধীনতাকামী বাঙালীর কণ্ঠ বুলেট দিয়ে চিরতরে স্তব্ধ করার সামরিক নকশা। সেরাতে দেড়টা থেকে পরদিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়ারলেস ট্রান্সমিশন রেকর্ড করেছিলেন আনবিক শক্তি কমিশনের ড. এম এম হোসেইন। ঢাকার খিলগাও চৌধুরীপাড়ার বি-১৭৪ নং বাড়িতে বসে প্রাণের উপর ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করেছিলেন এই পদার্থবিদ। ইংরেজি-উর্দূ মেশানো অসম্পূর্ণ এই ট্রান্সক্রিপ্টের অনুবাদ একটু কঠিন ঠেকেছে। মিলিটারি জারগন জানার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি অপারেশনে বিশেষ কোড থাকে, যা সংশ্লিষ্টরাই শুধু জানে। সেগুলো ডিসাইফার করতে সমস্যা হয়েছে খুব। কিছু বিশেষ সম্বোধনের অর্থ ধরতে পারিনি। আবার কিছু আন্দাজ করে নিয়েছি। যেমন ইমাম (ধারণা করছি এর অর্থ কমান্ডার। সেটা টিক্কা খান, আবার জাহানজেব আরবাব থেকে শুরু করে ইউনিট কমান্ডারও হতে পারে)। আবার মেইন বার্ড বলতে বোঝানো হয়েছে শেখ মুজিবর রহমানকে। টিক্কা খানের (স্ক্রিপ্টে যাকে কন্ট্রোল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে) তত্বাবধানে পরিচালিত এই অপারেশনের রেকর্ডকৃত ট্রান্সক্রিপ্টে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় অপারেশনের দায়িত্বে থাকা ইউনিটগুলোর কথাবার্তা উল্লেখযোগ্য, যদিও প্রতিটি বার্তা ধারাবাহিক এমন নয়, অনেকে কথা বলছে, অনেক সময় বেশ সময় নিয়ে বলছে। কল্পনায় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি রিসিভার হাতে এসব বার্তা বিনিময়ের সময় জ্বলছে ঢাকা, মরছে বাঙালী। একইসঙ্গে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রথম প্রহর।
সম্পূরক তথ্য পাবেন এই পোস্টে। রেকর্ডিংগুলোও আছে
: ৭৭, আমার কথা বোঝা যায়? ওভার।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না(রিডেবল)। কোনো খবর আছে ? ওভার। কারেকশন, ৭৭, অপেক্ষা করেন, ওনাকে... উনি নিজেই কল করবেন...
কন্ট্রোল : ৭৭, অপেক্ষা করো। পরে কথা বলছি তোমার সঙ্গে, হ্যালো ৯৯, তুমি যোগাযোগ রাখো নয়তো ২৬ এবং অন্যরা দুবার করে পরিস্থিতি জানাবে। তুমি স্রেফ টিউনে থাকো, এখনও নতুন কিছু ঘটেনি; রিজার্ভ লাইন দখল করা গেছে আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও লড়াই চলছে। আউট।
: ইমামের জন্য অপেক্ষা করো।
: ৭৭, ইমাম এখানে এসেছে, আর তার সঙ্গে আমার ইমাম এখন ব্যস্ত আছে, এজন্য এই মুহূর্তে আমি কিছুই বলতে পারছি না। ওভার।
: কন্ট্রোল অগ্রগতির তথ্য চাচ্ছেন, আপনি খোঁজ নিয়ে নিজেই জানান। ওভার।
: দাঁড়াও। পরে কথা বলছি, হ্যালো, ৭৭। ইমাম শুনছেন, বার্তা পাঠাও। ওভার।
: ৭৭, ৮৮র কাছ থেকে সর্বশেষ জানা গেছে যে সে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু ওখানে এত দালান যে যেসব বাড়ি থেকে ওর দিকে গুলি করা হচ্ছে ও সেগুলিকেই বেছে নিচ্ছে। ওর যা কিছু আছে সবই ব্যবহার করছে। ওভার।
: ওকে জানান যে তার বড় ভাইরা (আর্টিলারি) শিগগিরই চলে আসছে, আশা করি বড় বিল্ডিঙগুলো গুড়িয়ে দেওয়া যাবে। ওদিকে মনে হচ্ছে লিয়াকত আর ইকবাল (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস) চুপ মেরে গেছে। কি ঠিক বলেছি? ওভার।
:৭৭, কাহিনী শেষ কিনা নিশ্চিত না হলেও ওরা এ দুটো নিয়ে বেশ খুশীই মনে হলো। ওভার।
কন্ট্রোল : দুর্দান্ত। এখন ছেলেদের বলে দাও রাস্তায় রাস্তায় কারফিউর কথাটা প্রচার করতে। এটাই সবার আগে। দ্বিতীয় যেটা, ওরা যেন বাংলাদেশের সব পতাকা নামিয়ে ফেলতে বলে। আর কোনো বাড়িতে যদি বাংলাদেশের পতাকা পাওয়া যায় তাহলে বাড়িওয়ালাকে সেজন্য শাস্তি পেতে হবে। কোনো কালো পতাকা যেন না উড়ে, আর শহরের কোনো জায়গায় যেন বাংলাদেশের পতাকা দেখা না যায়। আর যদি সেগুলো নামানো না হয়, তাহলে তার ফল হবে ভীষণ মারাত্মক। এটা সবাইকে পরিষ্কার বুঝিয়ে বলতে হবে। রজার। ওভার।
: ৭৭, রজার, ওভার।
: ৭৭, এছাড়া রোড-ব্লকগুলার ব্যাপারেও ঘোষনা দিতে হবে। যদি কাউকে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বসাতে দেখা যায় তাহলে সেখানেই গুলি করে মারা হবে। এটা হচ্ছে প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে জায়গায় দেখা যাবে, সেখানকার মানুষজনকে শাস্তি দেওয়া হবে (মানে মেরে ফেলা), আরে ডানে-বায়ের বাড়ি-ঘরেরও হবে একই দশা। রোড ব্লকের আশপাশ গুড়িয়ে দেয়া হবে। এটা সবাইকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে হবে, জনগনকেও। আর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত এবং আগামীকাল সারাদিন মাইকে ঘোষনা করতে হবে এই নির্দেশ। ওভার।
: ৭৭, উইলকো। আউট অন ইউ। হ্যালো ৪১, ইমামের নির্দেশ পেয়েছো? ওভার।
: ৪১, ইমাম কি শুনতে পাচ্ছে? ওভার।
: ৪১, ইমামের নির্দেশ। প্রথম হচ্ছে, সব কালো পতাকা... এসব পতাকা বাড়ির মালিকদের অবশ্যই নামিয়ে ফেলতে হবে; কাউকে এরকম পতাকা উড়াতে দেখলে শাস্তি দিতে হবে। এই নির্দেশ কার্যকর করতে হবে (ভুল উচ্চারন করে প্রসিকিউটেডকে পারসিকিউটেড বলা হয়েছে) এবং বাড়ি ধ্বংস করে দিতে হবে। এটা মাইকে ঘোষনা করতে হবে। রজার সো ফার। ওভার।
: ৪১, ঠিক একইভাবে কোথাও কোনো রোডব্লক দেখা গেলে সেটাকে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। কাউকে এমন করতে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। রোড ব্লকের আশেপাশের বাড়ির মালিকদের শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের বাড়ি গুড়িয়ে দিতে হবে। এই ঘোষনাটাও টহলদার সেনাদের দিয়ে দেয়াতে হবে। ওভার।
: ৪১, আউট টু ইউ। হ্যালো ৮৮, বলো। ওভার
: ৮৮, ইমাম অপেক্ষা করছেন। বার্তা পাঠাও। ওভার।
: ৮৮, ইমামের নির্দেশ সব বাংলাদেশের পতাকা বা কালো পতাকা এবং যেসব বাড়িতে এগুলো উড়ছে এ মুহূর্তে তা নামিয়ে ফেলার জন্য মালিকদের সতর্ক করে দিতে হবে, নয়তো তাদের শাস্তি দেওয়া হবে (এ জায়গায় বক্তা পারসিকিউটেডকে সংশোধন করে আবার প্রসিকিউটেড বলেছেন)। রজার সো ফার। ওভার।
: ৮৮, উইলকো। ওভার।
: ৮৮, কোথাও কোনো রোডব্লক দেখা গেলে সেটাকে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। কাউকে এমন করতে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। রোড ব্লকের আশেপাশের বাড়ির মালিকদের শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের বাড়ি গুড়িয়ে দিতে হবে। এই ঘোষনাটাও টহলদার সেনাদের দিয়ে দেয়াতে হবে। ওভার।
: ৮৮। উইলকো। আর কিছু? ওভার।
: ৮৮। তোমার ইমাম কি বলেছে যে কাজটা সারতে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগবে? ওভার।
: ৮৮। হ্যাঁ। কাজটা ঠিকমতো সারতে কমপক্ষে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগবে। ওভার।
কন্ট্রোল : ৮৮, ইমাম এখন ইমাম ২৬ এর সঙ্গে আছেন। যদি আর কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে জানাতে পার। আর ব্যাদারগুলো (এম-২৪ ট্যাঙ্ক) নিরাপদ অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করেছে এবং ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তোমার সামনের সব বাধা ধ্বংস করতে তোমাকে সাহায্য করবে। ওভার।
: ৮৮, অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার আর কিছু বলার নেই। সব ঠিকঠাক মতোই হচ্ছে।
কন্ট্রোল : ৮৮, রজার। আউট টু ইউ। হ্যালো ৪১। ম্যাসেজ। ওভার।
কন্ট্রোল : ৪১, রেলওয়ে লাইনের পশ্চিম দিকে পালানোর পথগুলো তোমার এলাকায় পড়েছে। আশা করি জায়গামতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখবে যাতে ক্যাম্পাসে ২৬ ও ৮৮র হাত থেকে সেদিক দিয়ে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে। ওভার।
: ৪১, আমরা এলাকাটায় টহল জোরদার করেছি। প্রতি মিনিটেই আমরা চক্কর দিচ্ছি আর সতর্ক থাকছি। ওভার।
কন্ট্রোল : ৪১, রজার। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। ২৬ এর ওরা ডেইলি পিপলে আমাদের বন্ধুদেরও খুজে বের করেছে। খবরটায় তোমার খুশী হওয়া উচিত। আউট।
কন্ট্রোল: হ্যালো ৮৮কে ৯৯। হাইয়েস্ট কন্ট্রোল জানতে চাইছে প্রতিপক্ষ কি ধরনের গুলিবর্ষণ করেছে। ওভার।
: ৯৯কে ৮৮। অপেক্ষা করুন। আমি আমার ইমামকে ফোন করছি ,ওনার সঙ্গে কথা বলুন।
: ৯৯কে ৮৮। আমার ইমাম শুনছেন। ম্যাসেজ দিন। ওভার।
: ৮৮কে ৯৯। সর্বোচ্চ কন্ট্রোল জানতে চাইছেন জগন্নাথ, ইকবাল ও লিয়াকতে (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস) কি ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন। ওভার।
: ৯৯কে ৮৮। শুরুতে জগন্নাথ ও ইকবাল হল থেকে প্রচুর গুলি ছোড়া হয়েছে। রজার সো ফার। ওভার।
:রজার। ওভার।
: ৮৮, আমরা রোমিও রোমিও (রিকয়েলেস রাইফেল) দিয়ে হামলা করার পর আর কোনো আওয়াজ আসেনি, তবে কয়েকটাকে নিষ্ক্রিয় করেছি। রজার সো ফার, ওভার।
: ৮৮কে ৯৯। রজার। ওভার।
: ৯৯কে ৮৮। আমি এখন লিয়াকতে যাচ্ছি কারণ ওদের সেটটা অকেজো হয়ে গেছে। ওদের অগ্রগতি জানি না। খোজ নিয়ে জানাচ্ছি। ওভার।
: ৮৮কে ৯৯। ওপাশ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি কিংবা গ্রেনেড ইত্যাদি ছোড়া হয়েছিল কিনা জানিও। ওভার।
: ৯৯কে ৮৮। প্রচুর থ্রি নট থ্রির গুলি। তবে কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বা গ্রেনেডের আওয়াজ শুনিনি। ওভার।
: ৮৮, রজার আউট।
: ৯৯কে ২৬। মারখোর (এডজুটেন্ট) এসেছেন। বার্তা পাঠাও। ওভার।
: ২৬কে ৯৯। দয়া করে আমাদের বলো তোমরা এখন পর্যন্ত কি কি কব্জা করেছো। ওভার।
: ৯৯কে ২৬।২০০০ (রাজারবাগ পুলিশ লাইন) দখল, তারপর রমনা থানা দখল, কমলাপুর থানা দখল, টিভি ও রেডিও নিয়ন্ত্রনে, (টেলিফোন) এক্সচেঞ্জ দখল। প্রথম ধাক্কাতেই সব ইয়া আলী। ওভার। (চলবে)