somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট্ট নিশি এবং তার হতভাগ্য পিতা

১৪ ই জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি অনেকক্ষণ হলো ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছি।মাঝে একবার ছোট্ট একটি কাজের মেয়ে এসে চা দিয়ে গেছে যাতে আবার চিনি কম।এতে অবশ্য মাইন্ড খাইনি।আমি জানি এই সামান্য চা দেয়ার ভদ্রতাটুকুও আরিয়ার থেকে আমার পাওয়ার কথা নয়।৫ বছর আগে ডিভোর্স দেয়া স্ত্রীর কাছে কোন কিছুরই প্রত্যাশা করা যায়না।আসলে ডিভোর্স দেয়া বললে ভুল শোনায়,আরিয়াই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।মনে আছে, যখন আরিয়া বাক্স-পেটরা গোছগাছ করে আমাদের মালিবাগের দুই কামরার ছোট্ট বাসা ত্যাগ করে তখন সে অসম্ভব শক্ত ছিলো।আমি হাসিমুখে আরিয়াকে বলেছিলাম, “My Dear Wife, be happy and fall in a new love soon”. আরিয়া আমার দিকে তীব্র ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। আমি এখনো সেই ঘৃণার কথা ভুলতে পারিনি,কখনো পারবো বলে আশা করিনা।

সেই দিনের পর আজ পাঁচ বছর হলো, আমি আবার আরিয়ার সাথে দেখা করতে এলাম।আজকের দেখা হওয়ার পূর্ব প্রেক্ষাপট পাঠককে জানানো দরকার।সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার।আমি প্রতি বৃহস্পতিবার নিয়ম করে নীলেক্ষেত যাই কাগজ কেনার জন্য।নীলক্ষেতের তেহারীর দোকানের পাশে বীথি পেপার হাউস নামে যে দোকানটি আছে সেটি আমার গন্থব্য। তারা আমাকে বেশ সস্তায় রেডিও বন্ড কাগজ বিক্রয় করে।আমার পেশাটাও জানিয়ে দেই।আমি একজন দুইনাম্বারী লেখক।দুই নাম্বারী এ অর্থে যে আমি অন্যের লিখা অনুবাদ করি।হ্যা, নিজেরও বেশ কিছু লিখা আছে,কিন্তু সেগুলো পাঠক নজর দেয়নি।কিন্তু তবুও লিখালিখি আমার ভালোবাসা,আমার চলার পথের একমাত্র অর্থ উপার্জনের বাহন।পাঠককে আরো জানিয়ে রাখি আমার প্রাক্তন বউ আমার প্রেমে পড়েছিলো এই লিখালিখির কল্যাণেই।সেই ঘটনা আরেকদিন জানাই।

মূল গল্পে ফিরে আসি।আরিয়ার সাথে আমার মাসখানেক আগে দেখা হয় নীলক্ষেতে(শুধুই একটি কাকতাল মাত্র)।আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই প্রথম ওর সাথে আমার দেখা।আমি জানতাম সে সাড়ে চার বছর আগে USA এর উইস্কনসিন স্টেট এর গ্রীন বে নামে ছোট্ট একটি শহরে স্থায়ী হয়েছে।ভাবিনি এভাবে দেশে দেখা হবে আবার।প্রথমে ওকে দেখে আমি অবাক হয়ে একটু ভদ্রতার হাসি দেয়ার চেষ্টা নিয়েছিলাম,কিন্তু যখন ওর ওই ঘৃণাভরা চোখের কথা মনে হলো তখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছিলোনা।বুকটা অনেকদিন পর কেমন যেন প্রচন্ড ব্যথায় মুচড়িয়ে উঠলো।আরিয়া আমাকে দেখে নিজেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো?”
আমি একটু হতভম্ব হয়েই ওকে জানালাম ভালো আছি।আরিয়া এরপর খুব দ্রুত একটা কাগজ বের করে একটি ঠিকানা লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “তোমার সাথে আমি নিজেই দেখা করতে চাচ্ছিলাম।তুমি আমার এই ঠিকানায় এসে একবার দেখা করে যেয়ো।”

ওই ঘটনার পর আমার মোট ২৬ দিন ১৬ ঘন্টা লেগেছে সাহস জোগাড় করে আরিয়ার সাথে দেখা করতে।আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কেমন যেন ফুরফুরে লাগছিলো।খপাখপ একটা বিষণ্ণ নাগরিক জীবন নিয়ে কবিতা লিখে ফেললাম এবং এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম আরিয়া ম্যাডামের সাথে আজকে দেখে করবোই করবো।আমি আমার বহুমাত্রায় প্রিয় কিছুটা ছেঁড়া নীল পাঞ্জাবী পড়ে ওর বাসায় রওনা হলাম।

কাজের মেয়ের দেয়া তিক্ত চা খেয়ে মেজাজটা গরম হলেও কিছুক্ষণ পর আবার মেজাজটা ভালো হলো আরিয়াকে আসতে দেখে।আরিয়া আমার থেকে কিছু দূরত্ব নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো।তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো, “শওকত,তোমাকে জানানো হয়নি।তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমার একটি মেয়ে হয়েছিলো।দুঃখজনক ভাবে মেয়েটা তোমারও।আমি অনেক ভাবনা চিন্তা করে দেশে এসেছি তোমাকে এবং তোমার মেয়েকে দেখা করিয়ে দেবার জন্য।আশা করি তুমি ব্যাপারটা সহজভাবে নেবে"”।

আমি মুর্তির মত বসে রইলাম আরিয়ার পাশে বহুক্ষণ।এরপর আমার বিখ্যাত কাষ্ঠ হাসি দিলাম।আমি বুঝতে পারছিলামনা আমি কি বলবো।আমি একই সাথে অস্থির এবং ক্লান্ত অনুভব করলাম।আমি জানিনা আমার এখন সুখী অথবা দুঃখী কোনটি হওয়া উচিত।আমি শুধু আরিয়াকে শান্ত স্বরে বললাম “ধন্যবাদ আরিয়া।আমার মেয়ে কোথায়?তাকে একটু দেখতে পারি”

আরিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “না পারোনা।তবে কালকে পারবে।আমি ওকে তোমার বাসায় পাঠিয়ে দেবো কাল।তুমি দুইদিন ওকে নিয়ে তোমার কাছে রাখবে।এরপর আমার কাছে দিয়ে যাবে।আমি চিটাগং যাবো চারদিন পর।ওখান থেকেই ওকে নিয়ে একেবারে ফিরে যাবো স্টেটস এ”

আমি আরিয়ার বাসা থেকে চলে এলাম এরপর।সারাদিন পল্টন প্রেস ক্লাবের আশেপাশে প্রখর রৌদ্রছায়ায় হেঁটে বেড়ালাম।আমি অনুভূতিহীন ছিলাম।আমি একটিবারের জন্যও পেটে ক্ষুধা অনুভব করিনি।আমার মনে তখন শুধু একটিই ভাবনা, আমার মেয়েটা দেখতে কেমন।সে বাংলা জানে তো?
সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন সকালে চোখা লাল করে আমি আমার বাসার ছোট্ট নোংরা বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকলাম।কখন আমার ছোট্ট চার বছরের মেয়েটি আমার কাছে আসবে এই চিন্তায় বিভোর হয়ে রইলাম।আপনাদের এর মাঝে জানিয়ে দেই, কেন আমার সাথে আরিয়ার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।

তখন আরিয়ার সাথে আমার মাত্র দুবছর হলো বিয়ে হয়েছে।আমাদের বিয়েটা ছিলো প্রেমের বিয়ে।কারো বাবা মাই কোন আপত্তি করেনি।কিন্তু বিয়ের পর দিন দিন আরিয়া বদলে যেতে থাকলো।আমার সাথে প্রতিদিন ঝগড়া করতো।ওর অভিযোগ ছিলো আমি ওকে ভালোবাসিনা,সময় দেইনা।সারাদিন লিখালিখি নিয়ে পড়ে থাকি।আমার খুব অপরাধবোধ হত।কিন্তু সংসার চালানোর জন্য প্রকাশকদের হাজার অপমান সহ্য করে আমাকে সঠিক সময়ে লিখা জমা দিতে হতো।ভালোবাসার সংসারে সুখ আসে অর্থ দিয়ে, এই ভয়ংকর সত্য বাস্তবটা আরিয়াকে কে বোঝাবে?

এক বছর পর যখন আরিয়া সন্তাসম্ভবা হয়, তখন একটু শান্ত হয় পরিস্থিতি।আমি হাফ ছেড়ে বাচি।কিন্তু দুঃসময় আমার পিছু ছাড়েনি।হতভাগ্য এই দুইনাম্বারী লেখকের জীবনে ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে আসে যখন পাচ মাসের প্রেগনেন্ট আরিয়া ডাক্তার দেখিয়ে রাস্তায় হাটতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে এবং আমাদের শিশুটি সকল স্বপ্ন নিয়ে হারিয়ে যায়।আরিয়া দোষ দেয় আমার এবং শুধুই আমার।আমিও জানতাম যে আমিই অপরাধী, আমিই সেই পাপী যে আরিয়াকে সময় দিতে পারিনি।তার এমন অবস্থায়ও তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারিনি,ছেড়ে দিয়েছি মাঝপথে একা,একেবারেই একা।

এসকল কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে দেখতে পাই আরিয়াকে একটি গাড়ী থেকে নামতে। সাথে একটি ছোট্ট দেবশিশু।আমি কোনরকমে নিচে যাই, এবং বাসার গেটের কাছে গিয়ে আরিয়া আর শিশুটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি।আরিয়া আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে নিশির(আমার মেয়ের নাম) দিকে তাকিয়ে বলে, “মামানী এটা তোমার আব্বু।তুমি তোমার আব্বুর কাছে দুদিন থাকবে,ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবে।আর রাত হলে আমাকে একবার শুধু ফোন দেবে।ঠিক আছে?”

নিশি বড় বড় চোখ করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ঠিক নাই মা।আমি থাকবোনা বাবার কাছে।আমি তো ওকে চিনিনা।”প্রথমবার মেয়ের মুখে ফুটফুটে বাক্য শুনে আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলাম।কত সুন্দর করে আমার মেয়েটা কথা বলে।আমি কখন ওকে একটু কোলে নিয়ে আদর করবো ভাবছিলাম।কিন্তু মেয়ে আমার সাথে থাকতে রাজী হবে তো!তার এই দুর্ভাগা পিতার সাথে দুটি দিনের জন্য সে থাকবে তো!

আরিয়া তার মেয়েকে কিভাবে যেন বুঝিয়ে রাজী করে ফেললো।আমি মেয়েকে নিয়ে আমার দুইরুমের নোংরা বাসায় এনে হাজির হলাম।আরিয়া গেটের বাহির থেকেই বিদায় নিলো।যাওয়ার আগে মেয়ের যা যা লাগে সব দিয়ে গেলো।আমাকেও সাবধান করে দিলো যেন মেয়ের কোন সমস্যা না হয়।আমি জ্বি আচ্ছা বলে ওর সব কথায় সায় দিয়ে গেলাম।
ঘরে ঢুকে আমার মেয়ে প্রথম যে কথাটা বললো তা হলো, “ছি! তুমি কত নোংরা, যারা লিখালিখি করে তারা তো অনেক পরিচ্ছন্ন হয়।”আমি টাসকি খেলাম এবং বিশাল ঢোক গিললাম।মেয়ের দিকে কাচুমাচু হয়ে বললাম, “মামনি কথা সত্য।কিন্তু আমি পচা লেখক তো তাই ঘর এমন অপরিচ্ছন্ন।”

এরপর বাপ মেয়ে মিলে মিশন ঘর গোছানো শুরু করলাম।টম ক্রুসের আব্বাও এমন কঠিন কাজ করতে পারতো কিনা জানিনা।আমার মেয়েটা বিশ্বাস করুন এই চার বছর বয়সেই এত সুন্দর সুন্দর সব আইডিয়া দিতে লাগলো আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।ঘর গোছগাছ করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো।আমি আরিয়া জুনিয়রকে নিয়ে গুলশান-১ আলমাস গেলাম।আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কি খাবে। ও লজ্জায় মুখ লাল করে বললো, সব খাবো।

আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমার মেয়েটা তার পিতার মত পেটুক হয়েছে।ওকে আমি যাই দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে খাবে কিনা, সে কুটকুট করে বলে খাবো।আমি একটু পরপর ওর দিকে তাকাই।ছোট্ট দুইফুটের আমার মেয়ে বড় বড় চোখ নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে থাকে, আর আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করে।আমি কখনো চিন্তাও করিনি মেয়ে এত তাড়াতাড়ি এত ঘনিষ্ট হয়ে যাবে আমার।একটু পর সে নিজ থেকেই আমাকে বললো তার পায়ে বেদনা,সে কোলে উঠে ঘুরবে।আমি ওকে নিয়ে বহু মার্কেট, বহু জায়াগায় ঘুরলাম সারা বিকাল সন্ধ্যা।গুলশানের নোংরা লেক ওর সবচেয়ে ভালো লাগলো।কি কারণে জানিনা।

রাতে যখন ডিনার করে রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম, ও আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ভালোবাসাবাসি করি কিনা।আমি এইটুক মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আবার ভিড়মি খেলাম।তাকে জানালাম আমাকে কেউ বেল দেয়না।আপনাদের অবগতির জন্য অত্যন্ত কষ্টের সাথে জানানো যাচ্ছে আমার মেয়ের সাথে আমার সব কথোপকথন ইংরেজীতে হয়েছিলো।সে বাংলা ভালো বলতে পারেনা।আমি যে ইংরেজীতে কথোপকথনে অভ্যস্ত তা কিন্তু নয়।কিন্তু চালিয়ে নিতে পারি।

এরপরের দিন আমি একেবারে ভোরে তাকে নিয়ে রমনা বটমূলে চলে যাই।তাকে আমাদের দেশের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের গল্প বলি।প্রতি ১লা বৈশাখে এখানে যে অনুষ্ঠান হয় সেটা তাকে জানাই।আমার মেয়ে সব শুনে দাবী করে তাকে পহেলা বৈশাখের শাড়ী কিনে দিতে হবে।আমি তথাস্তু বলে তাকে নিয়ে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে যেয়ে একটি ছোট্ট শাড়ি কিনে দিয়ে সন্তষ্ট করি।অনেক দিন পর আমি ঢাকা শহরে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিলাম।

কাল ও চলে যাবে একথা মনে করে রাতে প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে আমার মেয়ের সাথে নিজের হাতের খিচুরী ডিম নিয়ে ডিনার করছিলাম। নিশি মামনী হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “বাবা, মা তোমাকে কেন ছেড়ে গেল?”
আমি নিশির দিকে তাকিয়ে দেখি সে উত্তরের জন্য চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু আমি কি উত্তর দিবো আমার মেয়েকে যেটা সে বুঝতে পারবে?

আমি চুপ করে খেতে লাগলাম।আমার মেয়ে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?”

আমি চোখের জল চেপে তাকে উত্তর দিলাম, “নারে মা।আমি তোর সাথে এবার চলে যাবো আমেরিকায়।”

আমার মেয়ে হঠাৎ কেঁদে উঠে বললো, “আমাকে যখন কেউ মিথ্যা বলে আমি সেটা বুঝি।বাবা আমি তোমার জন্য প্রতি রাতে একটা করে কবিতা লিখি।আমার ক্লাসমেটদেরকে বলি আমার বাবা কবি,আমিও একজন কবি হবো।মা আমাকে প্রতি জন্মদিনে তোমার হয়ে একটা করে কার্ড দেয়।আমি তোমার দেয়া সব কার্ড ছিড়ে ফেলে দেই।কারণ তুমি পচা।কখনো তুমি আমার সাথে দেখা করোনা,গল্প বলোনা”।"

আমার চোখ ভিজে গেলো।আমি আবারো নিজেকে একজন ব্যর্থ বাবা হিসেবে আবিষ্কার করলাম।আমি জীবনের প্রতি ক্লান্ত, বিমর্ষ একজন ব্যর্থ পিতা যার নিজের সন্তানটিকে প্রতিরাতে একটু আদর করে কপালে চুমু খাওয়ার অধিকারটাও নেই।আমি নিশিকে বুকে টেনে নিয়ে বললাম, “মা আমি সত্যিই তোর সাথে নিয়মিত দেখা করবো।”

আমার মেয়েটা সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শুধু এটুকুই বললো, “You are a liar, you are a liar”

পরদিন সকালে আরিয়া তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো।আমি যাওয়ার পথে আরিয়াকে একটি চিঠি দিলাম।বারবার অনুরোধ করলাম একবার যেন সে চিঠিটা পড়ে।একটিবারের জন্য।আরিয়া কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চিঠিটা নিলো এবং আর কিছু না বলে চলে গেলো।আমি রাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমার ছেড়া নীল পাঞ্জাবী নিয়ে।আমার মেয়েটা একটা বার আমার সাথে কথা বলেনি সকালে।আমি শুধু মেয়েটাকে কোলে নিয়ে গালে একটুকরো চুমু দিতে পেরেছিলাম।একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “প্রিয় নিশি মা, তুমি কি জানো তোমার বাবা তোমাকে কতটুকু ভালোবাসে?”নিশি আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো।আহারে! আমার মেয়েটা এই ছোট্ট বয়সে কি যন্ত্রণা বুকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, আমি তার অভিশপ্ত পিতা শুধুই পারি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে।

আরিয়া কি আমার চিঠিটা পড়বে একটিবারের জন্য, আমি জানতাম না।আমার চিঠিতে আমি লিখেছিলামঃ

“আরিয়া, আমি অতীতে যে ভুল করেছি তার সাফাই আগেও গাইনি এখনও গাইবোনা।আমি ভুল করেছি, তোমার কাছে আমি অপরাধী।কিন্তু যে অর্থ কষ্টে আমি তখন জর্জরিত ছিলাম তার থেকে উত্থানের জন্য আমার পুরো সময়টুকু শুধু আমি লিখালিখির জন্য, তা থেকে সামান্য কিছু আয়ের জন্য দিয়েছি।আমি জানিনা তুমি কখনো বুঝেছিলা কিনা যখন প্রতি রাতে আমি তোমার ঘুমন্ত মুখের দিকে জোসনা থাকুক আর না থাকুক তাকিয়ে থাকতাম আমাদের ভাঙ্গা জানালার মাঝ দিয়ে বের হয়ে আসা ছোট্ট রুপালী আলোর ছটায়।তোমাকে আমি একটি কবিতাও দেইনি, যে কবিতাগুলো আমি তখন লিখতাম।আমি তোমাকে কখনো আমার ভালোবাসা জানাইনি,আজও জানাতে পারবোনা হয়ত।শুধুই বলবো, তুমি যত দূরে থাকো আমি তোমাকে প্রতি রাতে দেখতে পাই।এই পাঁচ বছরে লিখে রাখা আমার ১৮২৭টি চিঠি আমি সব তোমার মুখের দিকে চেয়ে লিখেছি।আমি আমাদের ভালোবাসার ওই ছোট্ট বাসাটি আজও ছাড়তে পারিনি।আমি ভাঙ্গা জানালাটি মেরামত করিনি।আমি এখনো রাত জেগে জানালার বাধা ভেঙ্গে বিছানায় পাঁপড়ি মেলা জোসনার আলো দেখি।

আজ এতদিন পর এই ভালোবাসার দাবী নিয়ে তোমার কাছে একটি শুধু অনুরোধ রাখবো।আমার মেয়েটাকে তুমি সারাজীবন বুকের মাঝে আগলিয়ে রেখ।কখনো ওকে কষ্ট দিয়োনা।আমি সারাজীবন অভিশপ্ত হয়ে থাকবো হয়তো আমার মেয়েকে একটি স্নেহময় বাবা দিতে না পারার জন্য।কিন্তু আমি তোমাতে বিশ্বাস রাখি।আমি জানি তুমি আমার অভাব তাকে বুঝতে দিবেনা।ওকে শুধু প্রতিরাতে একবার আমার হয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে জানিয়ো, আমার মেয়েকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসি।
ভালো থেকো”।"

এরপর দুমাস কেটে যায়।আমি স্বার্থপর লেখক নিজের পেটের ধান্দায় দুইনাম্বারী কাজ করে যেতে থাকি।হঠাৎ করে একদিন আরিয়ার থেকে একটা চিঠি পাই যা নিম্নরূপঃ

“শওকত, আমি জেনে খুব বিরক্ত হয়েছি যে তুমি আমার ঘুমন্ত মুখের দিকে প্রায় সময় তাকিয়ে থাকতে।হয়তো একারণেই আমি তোমার সাথে সংসার করার সময় কখনোই ঠিকমত ঘুমুতে পারিনি।আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করেছি তিন দিন পর ঢাকা আসবো এবং বাকী জীবন তোমাকে এই বিরক্তিকর কর্মের জন্য শাস্তি দিয়ে যাবো।অনুগ্রহ পূর্বক তোমার ভাঙ্গা জানালা সারিয়ে ফেলো।তোমার অবগতির জন্য জানাই, নিশি আমার এই সিদ্ধান্তে একটু পর পর ফুটবলের মত লাফ দিচ্ছে আবার ভ্যা ভ্যা করে কাদছে।”

এই চিঠি পাওয়ার সময় আমি তখন নিজের স্বতন্ত্র একটা প্রেমের উপন্যাস লিখছিলাম।চিঠি পাওয়ার পর থেকে আমি বারবার লিখার পাতা ভিজিয়ে ফেলেছি।চিঠিটা একটু দেরীতে পড়লেই বোধ হয় ভালো হতো।ভুল হয়েছে!
********************************************************************
আবার একটা গল্প লিখলাম।এটাও ভালোবাসার গল্প।কিন্তু ধরনটা ভিন্ন বলেই দাবী করি।বোধ করি, আবারো একটি অখাদ্যই হয়েছে।আমি যারপরনাই আনন্দিত হবো যদি আপনারা তবুও এই লিখাটি হজম করতে পারেন।বদহজম হলে ক্ষমাপ্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:১১
৬৯টি মন্তব্য ৬৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×