ট্র্যাজিক উপন্যাসটির প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি, ২০১৫।
একজন দুঃখিনী মায়ের গল্প রয়েছে এতে। অসামান্য দারিদ্রপীড়িত পরিবারের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। শিশুবয়স থেকেই অন্যের বাড়িতে প্রতিপালিত হন এবং জামালমিয়ার সাথে বিবাহের পূর্বপর্যন্ত তাদের দাসীবৃত্তি করে পেট চালান। বিয়ের পর ট্রাকড্রাইভার স্বামীর নিপীড়ন আর অবহেলায় দুঃখদুর্দশার মধ্য দিয়ে কোনমতে সংসারটা টেনে নিয়ে যেতে থাকেন আম্বিয়া। স্বামীর অত্যাচারেই খুঁজে নিতে থাকেন সুখ। পতিতাগমন থেকে শুরু করে স্বামীর সিফিলিস রোগকেও মেনে নেয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ বাংলার সহনশীলা নারীর পরিচয়ই মূর্ত হয় আম্বিয়া চরিত্রে। স্বামীসুখ বঞ্চিতা আম্বিয়াও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে পরপুরুষে আসক্ত হয়ে পড়েন। মায়ের মৃত্যুশয্যায় বসে সবই জানতে পারে তার সাংবাদিক ছেলে। এমনকি তার আসল পিতৃপরিচয়ও আর গোপন থাকে না। জলেশ্বরীতে ট্রাকব্যবসায়ী আমিনুদ্দির ঔরসজাত সন্তান সে!
উপন্যাসের কাহিনীকথক আম্বিয়ার ছেলে রংপুরের চাচার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে চাচাত বোন টগরের সাথে প্রেম হয়ে আশ্রয়হীন হন। টিউশনি এবং পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। মায়ের সম্পূর্ণ জীবনাচরণের সুখদুঃখের দিকগুলি তিনি বুঝতেন। মা হয়তো তার কাছে প্রকাশ করতেন না তবুও তিনি বুঝতেন কি ব্যথা বুকে চেপে রেখে তিনি ছেলেকে মানুষ করছেন। ট্র্যাজিক এই উপন্যাসের শুরুতেই আছে “আমার মাকে আজ মাটি দিয়ে ফিরলাম। গর্ভে তিনি ধরেছিলেন। কতনা দুঃখের সহন তাঁর গেছে আমাকে নিয়ে। বুঝি তাঁর জীবনকে নিয়েই! যে-জীবনের ছবি আমি এখন আমি একটু একটু করে গড়ে তুলছি। আমি জানি এখন হবে এই আমার কাজ। তাঁর জীবনের গল্পটা শেষ পর্যন্ত যে আমারই গল্প হয়ে উঠবে, এটিও এখন আমি অনুমান করে উঠেছি।”
লেখক চমৎকার রূপক নামকরণ করেছেন উপন্যাসের। কুয়াশায় শাদা ঘোড়াটি যেন মহাকালের প্রতিচ্ছবি। ঘটনাচক্রে সেই ঘোড়া থমকে দাঁড়ায় আবার ছোটার প্রস্তুতি নেয়। বস্তুত পা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়া এক বিভ্রম সৃষ্টি করে পাঠকের মনে। উপন্যাসের শেষটুকু উদ্ধৃত করছি যাতে নামকরণের কার্যকরণ কিছুটা সহজবোধ্য হয় “হয়তো আজ রাতে স্বপ্ন আবার পাবো। সেই স্বপ্ন। কুয়াশায় শাদা ঘোড়া! কুয়াশা নয়, স্বপ্নে আমি জ্যোছনা কুয়াশা এক করে ফেলেছি। ওটি জ্যোছনাই। সেই জ্যোছনা! সেই রা পূর্ণিমার জোছনা রাতে টগরের হাতখানি হাতের ভেতরে নিয়ে চাঁদের দিকে আমাদের দুজনের অপলক তাকিয়ে থাকা।
ঘোড়াটিও আমাদেরই মতো স্বপ্নবিহ্বল হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলো পা তুলে।
আজ রাতে স্বপ্নটা যদি ফিরে আসে, হয়তো দেখবো পা নামিয়ে নিয়েছে, ঘোড়াটি চলতে শুরু করেছে।”
শুরুতে কাহিনী কিছুটা ধীরগতির মনে হচ্ছিল। তবে ধীরে ধীরে কাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম ছেলের চরিত্রে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জীবনদর্শনের নানা দিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে উপন্যাসজুড়েই। লেখনীর শক্তি টের পেলাম যখন উপন্যাসের শেষ পাতায় আমার চোখের চল টলে উঠল।
সবাইকে পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ২:০৩