শিমুল শহর হতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল ছুটি কাটাতে। তার বন্ধু অর্ক দুপুরে ফোন দিয়ে জানালো অর্কের বোনের আজ সিজারিয়ান অপারেশন হবে। শিমুল যেন অবশ্যই হাসপাতালে থাকে, যদি রক্তের প্রয়োজন হয় শিমুলের রক্ত কাজে আসবে। শিমুলকে হয়ত রক্ত দিতে হবে না, অর্কের বোনের রক্তের গ্রুপের সাথে অর্কের নিজের এবং তাদের ছোটভাইয়ের রক্তের গ্রুপের মিল আছে। তারপরেও বন্ধুর অনুরোধে শিমুলকে আসতে হচ্ছে।
মোটরসাইকেল নিয়ে শিমুল রওয়ানা হয়। এখনো দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসেনি, কিন্তু আকাশে ঘন মেঘের জন্য মনে হচ্ছে যেন এটা শেষ বিকেল। শিমুল যথাসম্ভব দ্রুত যাচ্ছে, বৃষ্টি নেমে পড়ার আগেই সে গন্তব্যে পৌছাতে চায়।
কিন্তু নিয়তি আজ শিমুলের অনুকূলে নেই। শিমুল শহরের উপকন্ঠে পৌঁছাতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে একটি পুরনো বাড়ির কাছে বাইক থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে বাড়িটির বারান্দায় উঠে। বাইকের সাথে ব্যাগে রেইনকোট আছে। বৃষ্টির ঝাপটা একটু কমলেই রেইনকোট পরে রওয়ানা দিতে হবে। আপাতত কিছুক্ষণ এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় দেখা যাচ্ছে না।
আসা যাওয়ার পথে শিমুল অনেকদিন এই বাড়িটাকে দেখেছে। কিন্তু কখনো ভাবেনি এই বাড়ির বারান্দাতে কোন একদিন এমন বেকায়দায় এসে দাঁড়াতে হতে পারে। কে জানে কতক্ষণ এখানে থাকতে হয়!
পুরনো বাড়ির পুরনো দরজা খোলার শব্দে শিমুল পেছনে ফিরে তাকায়। দরজায় এক অষ্টাদশী মেয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুল অবাক হয়, এই পুরনো বাড়িতে মানুষ থাকে? মেয়েটার বেশভূষা আর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হতে পারে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে এই পুরনো বাড়িতে মেয়ের পরিবার থাকে তা তো মনে হচ্ছে না। মেয়েটা এতো সুন্দর, শিমুল চোখ ফেরাতে পারছে না। মায়াবিনী ঠোঁটে হাসি ছেড়ে মেয়েটি বলল, ‘ভাইয়া কি কোথাও যাচ্ছিলেন?’
শিমুল সম্বিৎ ফিরে পায়, ‘হ্যাঁ, বাইকে যাচ্ছিলাম তো, হঠাত বৃষ্টির কবলে পড়ে গেলাম। বাধ্য হয়ে আপনাদের বারান্দায় উঠেছি। কোন আপত্তি নেই তো?’
মেয়েটা সশব্দে হেসে উঠলো। বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়েও শিমুল অষ্টাদশীর হাসির সুর শুনতে পায়, এ যেন হাসি নয়, ঝর্নার ধ্বনি। হাসি থামিয়ে অষ্টাদশী বলল, ‘এখন যদি আপত্তি করি আপনি কি আমাদের বারান্দা থেকে নেমে গিয়ে ভিজবেন?’ বলেই আবার ঝর্নার মত হেসে দিল মেয়েটা। সে ভালোই হিউমার জানে। শিমুলও লজ্জা পেয়ে হাসিতে যোগ দেয়।
মেয়েটা আবার বলল, ‘খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে, আপনি তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেও বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। ভেতরে এসে বসুন।’
শিমুল প্রথমে একটু ইতস্তত বোধ করে। তবে শেষমেশ এমন আহ্বানে না করা যায় না। মেয়েটার পিছু নিয়ে ভেতরে ঢোকে। আবছা আলোয় শিমুল দেখতে পায় ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো। অথচ বাইরের ভাঙ্গা দশা দেখে অনুমানই করা যাবে না ভেতরটা এমন। মেয়েটা বলল, ‘বৃষ্টি আসার আগেই কারেন্ট চলে গেছে । এই অন্ধকারে ভয় পাবেন নাতো?’
শিমুল ত্রস্তকন্ঠে বলল, ‘না না, অন্ধকার কোথায়? আমি তো সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’
ঝর্নার সুর আবার বেজে ওঠে, ‘ওহ, তাহলে তো ভালো। বসুন। চা দিই?’
-‘না, আমাকে বসতে দিয়েছেন এটাও আপনার অনেক বড় উদারতা। আমার জন্য আর কোন কষ্ট করতে হবে না।’
-‘বাহ, আপনি খুব কার্টিয়াস। এক কাপ চা অবশ্যই আপনি ডিজার্ভ করেন। চা করতে কষ্ট হবে না। এখুনি নিয়ে আসছি। আপনি আরাম করে বসুন।’
শিমুল মনে মনে বেশ খুশি হয়। মেঘ না চাইতেই যদি এভাবে বৃষ্টি এসে যায় কে খুশি হবে না? দেবীর প্রতিমার মত এমন একটি মেয়ে তাকে ডেকে নিয়ে আতিথেয়তা করছে, ভাগ্য প্রসন্ন না হলে এমন হয়? মনে মনে এই দুর্যোগপুর্ন আবহাওয়াকে সে ধন্যবাদ জানায়।
পুরো ঘরে একবার নজর বুলিয়ে নেয় শিমুল। শিমুলের কেন যেন মনে হচ্ছে এটা অপরিচিত বাড়ি নয়, এরকম একটা বসার ঘরে শিমুল হয়তো আগে কখনো গিয়ে বসেছিল। বিশেষ করে ঘরের ডেকোরেশন খুব পরিচিত। তিনটা সোফা, দুটি ছোট, একটি বড় সাইজের। মাঝে পুরনো স্টাইলের টি টেবিল। পাশে ছোট একটা খাট। ঘরে আসবাব বেশি নয়। কিন্তু এই অল্প কিছু জিনিসেই বড় রুমটা ভর্তি হয়ে আছে। ব্যপারটা কিঞ্চিত অদ্ভুত।
এক মিনিটেরও কম সময়ে মেয়েটা চা হাতে ফিরে আসে। শিমুল বলল, ‘এতো তাড়াতাড়ি চা হয়ে গেলো?’
-‘জী, চা তো আগেই চুলায় ছিল। কাপে ঢেলে নিয়ে এলাম।’
-‘ধন্যবাদ মিস.... ইয়ে আপনার নাম তো জানা হল না।’
-‘আমি রিয়া, আর আপনার নাম শিমুল।’
শিমুল রীতিমত অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘আশ্চর্য। আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে ?’
রিয়া হেসে জবাব দেয়, ‘বলব। আগে চা খেয়ে দেখুন তো কেমন লাগে ।’
শিমুল খুব সৌজন্যময় ভঙ্গীতে চায়ের কাপ তুলে নেয়। চায়ে চুমুক দিতেই তার নাকমুখ কুঁচকে গেলো। চায়ের গন্ধ এতো বাজে হয় ? এটা চা নাকি ড্রেইনের পচা পানি! চায়ের কাপের দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় । কাপের তরলের রঙ কালচে খয়েরী, চায়ের রঙ তো এমন হবার নয় । শিমুলের হতবিহ্বল চেহারা দেখে রিয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে । রিয়ার চোখে চোখ রেখে শিমুল কঠোর ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে আপনি এটা কি দিয়েছেন ?’
হাসি থামিয়ে রিয়া খুব স্বাভাবিকভাবে বলে, ‘রক্ত দিয়েছি ভাইয়া। খেয়ে নিন ?’
শিমুল কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটা কি পাগল? পথের পথিককে অতিথির মত ঘরে ডেকে এনে কেউ এমন আচরণ করে! হতবিহ্বল শিমুল অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, ‘রক্ত?’
-‘জি ভাইয়া, রক্ত। ব্লাড বলে ইংরেজিতে। তবে একটু পচে গেছে রক্তটা। কি করব বলুন? পুরনো রক্ত তো তাই নষ্ট হয়ে এসেছে। আমার কিন্তু আপনাকে একদম তাজা রক্ত খাওয়াতে মন চেয়েছিল। তাজা রক্ত নেই, এটা আছে। একঢোক খেলে গন্ধটা সয়ে যাবে, তখন আর কোন সমস্যা হবে না, একদমে ঢকঢক করে গিলে ফেলতে পারবেন।’
শিমুল এখনো বিস্ময় ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শিমুল বলে, ‘রক্ত দিয়েছেন মানে ? এটা কোন ধরনের মশকারি ?’
রিয়া আবার হাসিতে মেতে উঠে । তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, ‘মশকারি করব কেন বলুন ? আপনি তো নরম মাংস খেতে ভালোবাসেন । কিন্তু মাংস খেতে গিয়ে জীবনে কত যে রক্ত ঝরিয়েছেন তার হিসেব কে দেবে জনাব ? এতো রক্ত তো বৃথা যেতে পারে না । সব খেয়ে নিন ।’
এবার শিমুল রেগে যায়, উচ্চস্বরে বলল, ‘এভাবে ডেকে এনে অপমান করার কোন মানে হয় না । আমি আপনাকে ভালো মানুষ ভেবেছিলাম, এখন বুঝতে পারছি আপনি একটা আধাপাগল মেয়েমানুষ। আপনার বারান্দায় এসে দাঁড়ানোটাই আমার ভুল ছিল । আমি এখনি বের হচ্ছি।’ হাতের কাপ রাখতে গিয়ে শিমুল যেন হোঁচট খায় । তার সামনে সুন্দর যে টি-টেবিল ছিল এখন সেখানে কোন টেবিল নেই । শুধু তাই নয়, এতক্ষণ যে সোফাতে সে বসেছিল সেই সোফাটা পুরনো ঘুনে ধরা একটা চেয়ারে পরিণত হয়েছে । চেয়ার ছেড়ে সে উঠতে চাইছে, কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তি শিমুলকে যেন অক্টোপাসের মত চেয়ারটাতে চেপে ধরে রেখেছে ।
ভোজবাজির মত চারপাশের এই হঠাত পরিবর্তন দেখে শিমুল ভয় পায় । তার সামনে ঘরজুড়ে চমৎকার আসবাবপত্র ছিল । কিন্তু এখন পুরো ঘরে ভাঙ্গা কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে । আর তার নাকে কাপের খয়েরী তরলের গন্ধের মত একটা বাজে গন্ধ এসে ধাক্কা দিচ্ছে । মাত্র মিনিটখানেক আগেও এই ঘরটা চমৎকার পরিপাটি ছিল । আর এখন মনে হচ্ছে যেন এটা বৃটিশ আমলে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া কোন গুদাম । ঘরের চারদিকে বিহ্বল শিমুল নজর বুলিয়ে নেয় । বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা ঘরে শুধু পুরনো জিনিস, রিয়া মেয়েটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না ! বসে যাওয়া ভয়ার্ত গলায় শিমুল ডাক দেয়, রিয়া । শিমুলের নিজের কানেই নিজের আওয়াজটাকে বিড়ালের ডাকের মত শোনালো । গলায় জোর এনে আবার সে রিয়াকে ডাকে, কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেলো না ।
শিমুল বুঝতে পারে না তার সাথে এসব কি হচ্ছে । সে কোনদিন অতিপ্রাকৃতিক ব্যপারে বিশ্বাস করেনি । এখন যা হচ্ছে তা কি বাস্তব নাকি কোন দুঃস্বপ্ন । হয়তো এটা একটা দুঃস্বপ্ন, এখনি ঘুম থেকে জেগে উঠে শিমুল দেখবে সে তার নিজের ঘরে প্রতিদিনের মত ঘুমুচ্ছিল । শিমুল মনে প্রাণে কামনা করছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন হোক । রিয়ার কথাটি মনে পড়ল, ‘মাংস খেতে গিয়ে জীবনে কত যে রক্ত ঝরিয়েছেন তার হিসেব কে দেবে জনাব ? এতো রক্ত তো বৃথা যেতে পারে না ।’ হ্যাঁ, শিমুল কিছু অপরাধ করেছিল। সেই অপরাধবোধ হতেই আজ এই দুঃস্বপ্নের জন্ম । নিজেকে শিমুল প্রবোধ দিতে থাকে, এটা দুঃস্বপ্ন, এটা আমার গিল্ট হতে উদ্ভূত দুঃস্বপ্ন, এখনি আমার ঘুম ভেঙে দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে।
চলবে....
( এই গল্পের পরের অংশ পড়তে চাইলে ক্লিক করুন- চুরেল ২য় (শেষ) অংশ )
[গল্পটা অনেক আগের লিখা। এই গল্পের পরের অংশ এখনো লিখিনি। আজ একটা বিশেষ কারণে আমার মন খুব ভালো। চাইলাম এই ভালো লাগার দিনে ব্লগে একটা কিছু পোস্ট করে ফেলি। কিন্তু আজকের উপযোগী কোন লেখা আমার ল্যাপটপে পেলাম না। তাই এটাই পোস্ট করলাম। পরের অংশ এক সপ্তাহ পরে আসবে।
লেখাটা একজন ব্লগারকে উৎসর্গ করেছি, তবে এখানেই গল্পটি শেষ নয়। তাই উৎসর্গিত ব্যক্তির নাম আজ উল্লেখ করলাম না, পরের অংশ যেদিন পোস্ট করব সেদিন নামটাও উল্লেখ করে দেব।]