কেমন আছ? দীর্ঘ ১৬ বছরের জীবনে কখনও তোমাকে চিঠি লেখা হয়নি। কারণ তোমার উপস্থিতি ও ছায়া এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে আজ পর্যন্ত অনুপস্থিতিটুকু মেনে নিতে পারিনা। দেখতে দেখতে ৮টি বছর চলে গেল। ঘুরে ফিরে আরেকটি ‘বাবা দিবস’ চলে এল,৯ম বাবাবিহীন ‘বাবা দিবস’। ভালবাসার কোন বিশেষ দিন নেই। তবু প্রকাশের জন্যে মানুষ নানা উপলক্ষ খুজে নেয়। যে চিঠি লিখব লিখব করেও এতদিন লেখা হয়নি আজ তা লিখতে বসলাম। আক্ষেপ শুধু এটুকুই! এই চিঠির কোন জবাব আসবেনা!
আমার এক বন্ধু বলেছিল,এসব ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো কি ব্লগে শেয়ার না করলে হয়না? কিন্তু আমার যে বড় ইচ্ছে করে সবার কাছে গল্প করতে,এক অসাধারণ রাজার ভাগ্যবতী রাজকন্যা আমি! বাবা,তুমি কী জান যে আমার নামের আগে এখন ‘ডাঃ’ লেগে গেছে? যখন এপ্রোন পরে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াই তখন তোমার মেয়েকে ডাক্তার বলেই মনে হয়! তোমার ফাঁকিবাজ মেয়েটি এখন একজন সিরিয়াস ইন্টার্ন ডাক্তার! তখন নাহয় তোমার ব্লাড প্রেশার,ব্লাড সুগার পরিমাপ করতে পারতাম না। তাই বলে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে? এখনতো সব পারি! একবারও তোমার মেয়ের পরীক্ষা নিতে চাইলেনা? এতটাই অযোগ্য মনে হল তোমার আমাকে?
৩দিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম। তোমার সেই স্কুলে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। ৩৫০জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করলাম। তুমি থাকলে তাই করতে না বাবা? প্রতিটি ক্লাসে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম তোমার পরিশ্রমের ফল। বাবা একটা ব্যাপার কি জান যখন আমার পরিচয় দেয়া হচ্ছিল সবার কাছে তখন একজন ডাক্তারের চেয়ে তোমার মেয়ে হিসেবে পরিচয় পেতেই বেশি ভাল লাগছিল। আজ এতদূর এসেও আমি বুঝতে পারি,বাবা,তোমার বিশালত্বের কাছে আমি খুবই নগন্য। সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়,আমি তোমার মেয়ে!
স্কুলের অনুষ্ঠানে “আয় খুকু আয়” গানটি গেয়ে সবার চোখে পানি এনেছিলাম। গানটা আজ আমাকে কাঁদায় বারবার! তুমি না কথা দিয়েছিলে এস.এস.সিতে এ+ পেলে আমাকে নিয়ে কাঠমান্ডু ঘুরে আসবে। ডাক্তার হলে কী আমাকে ইউরোপে ট্রিপ দিতে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে! অনেককিছুই পাওনা রয়ে গেল যে! আমিতো কথা রেখেছি,তুমি কেন রাখলেনা? এমন শূন্যস্থান কেন তৈরি করে গেলে যা ভরাট করার ক্ষমতা কারো নেই! মা ভীষণ একা হয়ে গেছে। মুখে কিছু না বললেও তার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস আমি টের পাই। তোমাদের কোনদিন কিছুই দিতে পারিনি। মুখ ফুটে বলতেও পারিনি কতটা ভালবাসি। আজ এই আনন্দের জোয়ারে তোমার শূন্যতাটা বড় চোখে পড়ে! ১০ বছর আগে রোটারী ক্লাবের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে সবাই জানতে চেয়েছিল,দেখতে চেয়েছিল আমার বাবাকে। সেদিন তোমার চোখে যে আনন্দ দেখেছিলাম আজ তা বড় দেখতে ইচ্ছে হয়। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তোমাকে ভীষণ মিস করি বাবা। কারণ আমি জানি তোমার চেয়ে মুগ্ধ শ্রোতা আমার আর কেউ হবেনা। কেউ লাইব্রেরী ঘুরে ঘুরে আমার জন্যে সেরা বইটি খুঁজে আনবেনা। কেউ পত্রিকায় প্রকাশিত কোন ভাল প্রবন্ধ কেটে আমার জন্যে নিয়ে আসবেনা। কেউ তোমার মত নয়,কেউ তোমার মত হবেনা। পৃথিবীর সবটুকু ভালবাসা তোমার মধ্যেই সঞ্চিত ছিল তাই আজ চারপাশের ভালবাসাহীন পৃথিবীটা বড় রুক্ষ মনে হয়!
আজ তোমার সেই ছোট মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। একা একা চলতে শিখে গেছে। এখন সে ব্যালকনীতে বসে দূরের তারাটি দেখে আর কাঁদেনা। কারণ সে আজ বিশ্বাস করে,তার বাবা সবসময় তার পাশে আছে বলেই সে আজ এত আত্মবিশ্বাসী। যে স্বপ্নের বীজ তুমি তার মধ্যে বুনে গিয়েছিলে তা নষ্ট হয়ে যায়নি,বরং সেই স্বপ্ন আজ ডালপালা মেলেছে। তুমি পাশে না থাকলে তা বুঝি হতে পারত? এমন ভাগ্য নিয়ে কয়টা মানুষ পৃথিবীতে এসেছে! অনেককিছুই লেখার ছিল কিন্তু চিঠিটা লিখতে গিয়ে কিভাবে যে এত এলোমেলো হয়ে গেলাম তা বুঝতেও পারলাম না। চিঠির শেষে শুধু এটুকুই বলব,ভাল থেকো বাবা,খুব ভাল।
ইতি,
তোমার মামণি
(তুমিতো কখনও আমাকে নাম ধরে ডাকনি)