আধুনিক ইংরেজী সাহিত্যের স্বনামধন্য নাট্যকার স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট( Samuel Barclay Beckett )। তিনি ছিলেন আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব এবং নাট্যকার। বেকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম ওয়েটিং ফর গডো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়া যখন এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সামনে; চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ; মানবতা পদদলিত; বেঁচে থাকাই যখন এক বেদনাদায়ক, ক্লান্তিকর, গ্লানিময় অভিজ্ঞতা আর অস্তিত্ব যখন হয়ে উঠছে এক ভীষণ অর্থহীন বিষয়; ঠিক সে সময় ফরাসি নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট তার নাটক ওয়েটিং ফর গডো গডোর জন্য অপেক্ষা নিয়ে হাজির হলেন বিশ্ব দরবারে। সেই থেকে চলছে গডোর জন্য অপেক্ষা। হাজারো নৈরাশ্যের মধ্যে একটা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় মানুষের অন্তহীন পথচলা, বিনিদ্র অপেক্ষা, তারই প্রেক্ষাপটে নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক ওয়েটিং ফর গডো। এই নাটকই তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬৯ সালে তিনি লাভ করেন সাহিত্যে সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কার। ১৯৮৯ সালের আজকের দিনেফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন স্বনামধন্য এই লেখক। আজ স্যামুয়েল বার্কলে বেকেটের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
(কিশোর স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট)
স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ১৯০৬ সালের ১৩ এপ্রিল আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস মার্ফি ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বেকেট নাৎসী বাহিনীর বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। বেকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম ওয়েটিং ফর গডো ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। মানুষের জীবনের সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, আশা-আনন্দ, উচ্ছ্বাস, অনুভূতি, ভালোলাগা, ভালোবাসা আর প্রতিনিয়ত যে বিরুদ্ধ পরিবেশ ও স্রোতের বিপরীতে চলে একদল প্রতিবাদী কণ্ঠ বার বার মানুষের মনে, মননে, হ্রদয়ে রেখাপাত করে চলেন, বার বার স্বৈরাচারী আর দুঃশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জন্য যারা পথ দেখিয়ে চলেন- সেই সব আশা-নিরাশার এই সব রোজনামচা নিয়েই যে জীবন, সেই জীবন সংগ্রামের ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের রূপকার্থে যুগোপযোগী এক নাট্যরূপ ওয়েটিং ফর গডো। এই নাটকের চরিত্রগুলো যখন কথা বলে তখন তাদের মনে হয় বাস্তবতা থেকে খানিকটা দূরের মানুষ, তারা কবিতার মতো কথা বলে। তাদের কথায় তারিখ নাই, মাসের নাম আসে না, নির্দিষ্ট বছরের উল্লেখ নাই, বারের যাও বা উল্লেখ আছে তারও ঠিক নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তাই সব চরিত্র ছাপিয়ে সময়হীনতাই এই নাটকের সবচেয়ে বড় চরিত্র। সময়কে কাটিয়ে ওঠায় এটা একটা 'গুণ', সময়কে হারিয়ে ফেলায় এর অন্য নাম হয়ত 'ত্রুটি'।
পুরো নাটকে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন অপেক্ষা করে Godot এর জন্য। বিচার না পেয়ে, বিচার পাবে না নিশ্চিত হয়ে মানুষ যেমন শত্রুর বিচারের ভার ঈশ্বরে অর্পণ করে সাময়িক সান্ত্বনা খোঁজে, অনেকটা সেভাবে ভ্লাদিমির ও অস্ট্রাগন জীবনের অকূল দরিয়ায় কোনো কূল খুঁজে না পেয়ে আকুল হৃদয়ে মনগড়া কেউ একজনের আসার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে। যে আসবে তার নাম গডো। গডো আসে না, আসে ক্ষমতাধর পোৎসো এবং পোৎসোর পোষ্য সময়ের বিবর্তনে ক্ষয়িষ্ণু লাকি। একজনের ক্ষমতার দম্ভ অন্যজনের অনুগত থাকার আনুগত্য। এই আসা-যাওয়ার ভিড়ে মনগড়া স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার অবলম্বন হয়ে আসে স্বপ্ন-জাগানিয়া বালক। মহাকালের বিবর্তনে ক্ষমতাধর পোৎসো তার ক্ষমতা হারায়, গডো আসবে আসবে বলে আসে না; কিন্তু ভ্লাদিমির-অস্ট্রাগন আশায় আশায় অপেক্ষার পর অপেক্ষা করেই যায়। অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়। আবার অপেক্ষার শুরু হয় পরের দিন। যেই গডোর (Godot) জন্যে অপেক্ষা, তার কোনই দেখা মেলেনা। প্রথম অঙ্কের মাঝামাঝি দুইজন অন্য মানুষের দেখা মেলে: পোৎজো আর লাকি । তাদের সাথে একটু ভিন্ন সময় কাটানোর পর আবার অনির্দিষ্ট পরের দিন শুরু হয়। দ্বিতীয় অঙ্কেও প্রথম অঙ্কের গতিহীনতা থেকে ভিন্ন কিছু ঘটে না। সেই অপেক্ষা , সেই না আসা । আবারও পোৎজো এবং লাকি। আবারও প্রথম দৃশ্যের শেষের মতো একজন বালক , গডোর বার্তা নিয়ে আসে। বার্তাও বরাবর একই।
He won't come this evening;
But he'll come tomorrow;
(আজকে সন্ধ্যাবেলা তিনি আসবেন না'
কিন্তু কালকে আসবেন')
Waiting for Godot নিয়ে বেকেটের প্রচেষ্টাকে অনেকেই এতটা সময়বিবর্জিত লাগায় অনেকে একে মনে করেছেন জীবনবিবর্জিত। যেখানে সমাজ নাই; বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা গীর্জা, প্যাগোডা নাই; হাসপাতাল নাই, বাজার, কারখানা বা ফসলের জমি নাই; সেখানে কীভাবে বাস্তবতা আসে, মানুষের জীবনের অস্তিত্ব কোথায় সেখানে? তাই এমন একটা নাটককে শিল্পের মর্যাদা দিতে চান নাই অনেকেই। কিন্তু সমকালীন ক্ল্যাসিক হিসেবে এই লেখার বর্তমান স্বীকৃতির পেছনে নির্দিষ্ট সময়চিন্তা ছাড়াই, যে কোন ভাবেই হোক, উজ্জ্বল হয়ে আছে সবচেয়ে বড় মানবিক দর্শন, অস্তিত্ববাদ। একে দেখা হয়েছে ১৯৯০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গণআন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। আবার হারিকেন ক্যাটরিনায় বিধ্বস্ত মানুষের দুঃখের প্রতীক হিসেবে এবং ১৯৫০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কারাগারের মানুষ একে দেখেছেন নিজেদের জীবনের গল্পের মতো।
নাটকের দুই চরিত্র পোজ্জ এবং লাকির মধ্যে সম্পর্ক খুবই গোলমালের। এটা একদিকে যেমন দমনমূলক, অন্যদিকে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। নাটকের শুরুতে দেখা যায়, ভবঘুরে ছন্নছাড়া দুই লোক ভলাডিমির ও এস্ট্রাগন তেমনি এক ছন্নছাড়া ধূসর এক প্রান্তরে কোনো এক মি. গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। নাটকের শেষেও তারা প্রতীক্ষাই করে; কিন্তু মনে হয় যেন তারা অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করছে। অর্থহীন এই প্রতীক্ষা, কারণ গডো আসেন না। কখনও আসবেন এমন নিশ্চয়তা বা সম্ভাবনাও দেখা যায় না, তবু মুক্তি নেই তাদের! প্রতীক্ষা করে যায়! বেকেট কিন্তু গডোর পরিচয় দেন নি। হতে পারে গডো ঈশ্বরতুল্য কেউ। যদি তাই হয়, তবে তিনি হয়তো চান যে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন নিজের ভবিষ্যত নিজে ঠিক করুক। তাই তিনি দেখা দেন না, অস্তিত্ববাদী এই ঈশ্বরের 'আসি-আসি বলে ফাঁকি' দেওয়ার ব্যাপরটা যদিও এই ধরণের সহজ ব্যাখ্যার উর্ধ্বে। স্পষ্ট অস্তিত্ববাদী এই নাটক বাইরে বাইরে জীবনমুখী না হয়েও, জীবনের সার্বজনীন ইঙ্গিত তুলে ধরে আছে কোমলতায়, আবছা ভোরের হাওয়ার মতো, চাঁদের ধবধবে পূর্ণিমার নিচে বালুর চকচকে প্রতিফলনের মতো। নির্দিষ্টতার বাইরে যাওয়ায় এই লেখা মেঘের মতো, রোদের মতো, বাতাসের গন্ধের মতো সার্বজনীন।
১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিশে মৃত্যুবরণ করেন ইংরেজী সাহিত্যের স্বনামধন্য নাট্যকার স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট। আজ তার ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:১৬