somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি থেকে যা আজও আমায় ভাবায় (৯)

১৭ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এটা আমার জীবনের বেশ মজার একটি ঘটনা। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। এর আগে তৃতীয় শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ঘোরাফেরা করছি, নানার বাড়িতে, খালার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। যেদিন পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে অর্থাৎ রোল নাম্বার ঘোষণা করবে সেদিন স্কুলে যাই আর জানলাম আমার রোল নাম্বার ১৬ হয়েছে। আমি জানি বাড়িতে এখন যদি বলি রোল নাম্বার ১০ থেকে ১৬তে চলে গেছে তাহলে উত্তম মধ্যম খেতে পারি কিংবা প্রচন্ড বকাঝকা শুনতে পারি। কি করবো বাড়িতে যেতে যেতে ভাবছি।
যাক বাড়িতে যাওয়ার পর আম্মা জিজ্ঞেস করলো, কিরে রোল নাম্বার কত হয়েছে? আমি বললাম ৮। ১০ থেকে ৮, দুই কমাতে পেরেছিস ভালো হয়েছে। আম্মা ভালো করে গোসল করিয়ে দিয়েছে, দুপুর বেলায় পাশে বসে খাওয়া দিয়েছে। আব্বা আসার সাথে সাথে আম্মা আব্বাকে জানালো আমার রোল ১০ থেকে ৮এ এসেছে। আব্বাও খুশি হলেন। যাক এভাবেই চলতে লাগলো।
এরপর চতুর্থ শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলে আসলো। আমাদের পরীক্ষার সময় বাড়ি থেকে পরীক্ষায় লেখার জন্য খাতা নিয়ে যেতে হতো, এক্সট্রা সিট লাগলে সেটা স্কুল থেকে দিতো। খাতার উপরে নাম, শ্রেণী ও রোল নাম্বার লিখতে হতো। আম্মা খাতা বানিয়ে উপরে নাম, রোল নম্বর লিখে দিতো। রোলের জায়গায় আম্মা লিখতো ৮, আমি পরীক্ষা দিতে গিয়ে সেখানে রোল কেটে ১৬ করে দিতাম।
প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষ হলে, কয়েকদিন পর একে একে প্রত্যেক বিষয়ের খাতা দেওয়া শুরু হলো। এবার আমি পড়েছি খুব বিপদে। আম্মা যখন খাতা দেখতে চাইবে তখন উপরের রোলের জায়গায় কাটাকাটি নজরে পড়লে ধরা পড়ে যাবো! এদিকে সময় যাচ্ছে আর আম্মা জিজ্ঞেস করছে খাতা দিচ্ছে নাকি স্কুলে? আমি বলে যাচ্ছি এখনো দেয় নাই। যাক যতগুলি খাতা দিয়েছে আমি সবগুলি এনে আমার বিছানার নিচে রেখে দিয়েছি। একদিন হঠাৎ করে বিকেল বেলায় আম্মা আমাকে ডেকে আনলো, সুন্দর করে কাছে বসালো, এরপর সবগুলি খাতা বের করে বলল এগুলি কি? আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। দৌড় দিতে চেষ্টা করলাম, আম্মা শক্ত করে হাত ধরে রাখলো। এরপরে শলার মুঠি দিয়ে কয়েকটি লাগিয়ে দিলো। আর বললো তোর আব্বাকে বলবো না, আজকে থেকে আর কখনো পড়ালেখা নিয়ে মিথ্যে কথা বলবি না। ঠিকভাবে পড়ালেখা করবি, আমি বললাম ঠিক আছে।
ভাবলাম বিপদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু না, রাতের বেলায় আব্বা এসে আরেক দফায় বকাবকি শুরু করল। আমাদের এক স্কুল টিচার আব্বার দোকান থেকে সদাইপাতি করে। কথায় কথায় আমার ব্যাপারে আব্বা জিজ্ঞেস করেছে উনার কাছে। স্যার আব্বার কাছে সব বলার পরে আব্বা বুঝতে পারে আমার রোল ১৬ নয় ৮! স্যারকে কিছু বলেনি আব্বা। রাতে এসে আমাকে প্রচন্ড বকাঝকা করেছিল। যাক এরপরের বছর থেকে আমার রোল ১৬ থেকে সোজা ১ এ নিয়ে এসেছিলাম এবং এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত সব সময় রোল ১ ছিল, কখনো ২ হয়নি।

এ ঘটনাটি আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখনকার। তখন আস্তে আস্তে একটু বাড়ির বাইরে যাওয়া শিখছিলাম। আগে শুধু স্কুল আর বাড়ি, এর বাইরে আর কোথাও যেতাম না। তখন আস্তে আস্তে বাজারে এবং আমাদের বাড়ির পিছনে কয়েকটি দোকান ছিল সেখানে যেতাম। বাড়ির ছেলেপেলেদের সাথে বাড়ি থেকে বেশ দূরেও যেতাম। তো আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে আমার স্কুলের এক বন্ধুর বাড়িতে দুপুরবেলা গেলাম। বন্ধু তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে তাদের ক্ষেত থেকে শসা খাওয়াবে বলে। বন্ধু কয়েকটি শসা তাদের ক্ষেত থেকে নিয়ে আনলে ক্ষেতের পাশেই বসে আমি আর সে মিলে খেতে লাগলাম। একটুপর তাদের বাড়ির একটি ছেলে আসে। সে তখন কলেজে পড়তো, ছাত্রলীগ করে। কলেজে পড়ুয়া ছেলে যখন রাজনীতি করে তখন তারা একটু অন্যরকম চলাফেরা করে, কথাবার্তা বেশ ধমকানোর সুরে বলে। আমাদেরকে দেখে বললো তোরা এখানে কি করিস? আমার বন্ধু বললো শসা খাই। সে বলল দেখি, শসা দেখে বললো এগুলি তো আমাদের ক্ষেতের শসা, আমি আর আমার বন্ধু বারবার বললাম আমরা এগুলি এই ক্ষেত থেকে নিয়েছি এবং শসা কাটার পরে যে রস শসা গাছের ডগা থেকে পড়ছিল সেগুলিও দেখালাম। সে তারপরেও আমাদের সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগলো। একপর্যায়ে আমাকে এবং আমার বন্ধুকে ধরে মারতে আসে। প্রথমে আমার বন্ধুকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এরপর আমার জামার কলার ধরে বলে তোদের কোন বাড়ি? এদিকে আমার বন্ধুটির হাতে শসা কাটার জন্য একটি ব্লেড ছিল, সে দৌড়ে এসে ওই ছেলেটির হাতে এলোপাথাড়ি ব্লেড দিয়ে টান দিতে শুরু করলো। ছেলেটি আমাকে ছেড়ে দিয়ে চিৎকার দেওয়া শুরু করলো, আমরা দেখলাম ছেলেটির কনুই এবং আঙ্গুল দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। দুইজনে মিলে এক দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।
এরপর দুজনে মিলে ভাবছিলাম যে কি করবো, আমার খুব ভয় করছিল কিন্তু আমার বন্ধুটি সে নির্বিকার। সে তখনও ঐ ছেলেটিকে গালাগালি করতে ছিল। আমি বন্ধুকে বললাম এই খবর বাড়িতে গেলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। বন্ধুটি বলল তুই তোর নানার বাড়িতে চলে যা আমি আমার ভাবিদের বাড়িতে যাচ্ছি। এ কথা বলে দুজন দুই দিকে চলে গেলাম। আমি আমাদের বাড়ির এক চাচাকে দেখে বললাম আম্মাকে বলিয়েন আমি নানার বাড়িতে গেছি, এই বলে আমি সেখান থেকে সে অবস্থায়ই নানা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুদিন পর যখন বাড়িতে আসলাম, স্কুলে গেলাম এ নিয়ে কারো মুখে কোনো কথা শুনলাম না এবং ওই ছেলেটির সাথে আর দেখা হয়নি। আমার বন্ধুটিও স্কুল ছেড়ে দিয়ে মাদ্রাসায় চলে গেলো।
অনেকদিন পরে বন্ধুটির সাথে একদিন দেখা হলে তাকে ওই ছেলেটির কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, আমাদের সাথে যেদিন এই ঘটনা ঘটেছিল ঐ ছেলেটির পরের দিন সৌদি আরব চলে যাওয়ার তারিখ ছিল এবং চলেও যায়। যার জন্য এটা নিয়ে আর কোনো হাঙ্গামা হয়নি।

এটি আমাদের পাশের বাড়ির এক ছেলের ঘটনা ছেলেটির নাম জাহাঙ্গীর, দেখতে একদম কুচকুচে কালো। ওকে অনেকেই কালা জাহাঙ্গীর নামে ডাকতো। খুবই সহজ সরল ছেলেটি। দৈনিক মজুরিতে মানুষের ক্ষেত খামারে কাজ করতো। এখনো জীবিত আছে, তবে এখন অটো রিক্সা চালিয়ে জীবন চালায়।
তো এ ঘটনাটি অনেক আগের। আমার বয়স ১২-১৩ বছর হবে। জাহাঙ্গীর তখন যুবক। একদিন হঠাৎ করে আমরা আমাদের বাড়ি থেকে সন্ধ্যার পর বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাই, খুব সুমধুর সুর। সন্ধ্যা আটটা থেকে শুরু করে রাত এগারোটা পর্যন্ত কেউ একজন বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। পরের দিন সকাল বেলা জানতে পারলাম এ কাজটি জাহাঙ্গীরের। জাহাঙ্গীর যে এত সুন্দর করে বাঁশি বাজাতে পারে এটা অনেকেরই তখন জানা ছিল না।
যাক এরপরের থেকে জাহাঙ্গীর প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাঁশি বাজাতে থাকে। আমিও মোটামুটি তার বাঁশির আওয়াজ উপভোগ করতে শুরু করলাম। পড়া শেষ করে ঘুমোতে যাওয়ার সময় তার বাঁশির আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। রাতের বেলায় বাজাতো বলে আওয়াজ অনেক দূর থেকে শোনা যেতো। এভাবে অনেকদিন চলল।
একদিন হঠাৎ করে বিকেল বেলা স্কুল থেকে এসে জাহাঙ্গীরদের বাড়ি থেকে অনেক হট্টগোল শোনা যেতে লাগলো। আমিও বইখাতা ফেলে তাদের বাড়িতে দিলাম দৌঁড়। গিয়ে দেখি একটা লোক জাহাঙ্গীরকে মারছে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে। বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে। জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীরের মা অনেক কাকুতি মিনতি করছে কিন্তু লোকটি তাকে ছাড়ছিল না। উপরন্তু অকথ্য ভাষায় গালাগালিসহ চড় থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছিল। এরপরে সবাই যখন তাকে রিকুয়েস্ট করলো এবং জাহাঙ্গীর আর বাঁশি বাজাবে না এই ওয়াদা করলো তখন লোকটি শান্ত হলো।
পরে জানতে পারলাম জাহাঙ্গীর যখন রাত করে বাঁশি বাজায় তখন নাকি আশেপাশের অনেক যুবতী ও কুমারী মেয়েদের নেশার মতো এক ধরনের কাজ করছে। তারা জাহাঙ্গীরের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। এটার জন্য নাকি ঐ লোকটির কাছে বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছে। আর এতেই সে উত্তেজিত হয়ে জাহাঙ্গীরের সাথে এমন আচরণ করেছে।
যাইহোক এরপর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আর কখনোই জাহাঙ্গীরকে বাঁশি বাজাতে আমি শুনিনি। এবার বাড়িতে গেলে ইচ্ছে আছে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করবো সে আগের মত বাঁশি বাজাতে পারে কিনা। যদি পারে তার পাশে বসে কিছুক্ষণ তার বাঁশি বাজানো শুনবো। তবে আমার ধারণা সে তার বাঁশি বাজানোর প্রতিভা হারিয়ে ফেলেছে!
স্মৃতি থেকে যা আজও আমায় ভাবায়(৮)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×