সিলেটের যে পাড়ায় আমরা থাকতাম সেই পাড়াটা না অনেকটাই ছিল গম্ভীর প্রকৃতির। পাড়ায় ঢুকতেই যেই গলিটি, সেটি ছিল বাশঝাড় দিয়ে ঢাকা। আর সেই পথের পাশ দিয়ে একটি বড় নর্দমাও ছিল। আর পথের ঠিক মাঝখানটায় ছিল একটি কদম গাছ। দাদুর মুখ থেকে শুনেছিলাম বাশঝাড়ে, বটগাছে, কদম গাছে নাকি ভূত-প্রেত ঐসব থাকে। আর আমি একা ঐ রাস্তায় কখনো চলিনি ভয়ে আর তখন আমার বয়সটাও ছিল খুবই কম। আর আমি কোথাও গেলে, হয় আব্বু আম্মুর সাথে, আর না হয় ছোট ফুপ্পির সাথেই যেতাম। তবুও কদমগাছ, বাশেরঝাড় এগুলোর অন্ধকার পরিবেশটায় এসেই মনে হত, কি যেন একটা আমার গা ছুয়ে গেল এই মাত্র, বাতাসের মত কিছু একটা। কানের পাশ দিয়ে সারাক্ষণ কেমন যেন একটা রহস্যময় শব্দ চলাফেরা করত। প্রায় দিনই এমনটি হতো। আর যদি দিনের বেলায় স্কুল থেকে আরিফ অথবা বাপ্পির সাথে সেই রাস্তা দিয়ে আসতাম, তখন আমরা দুজন একে অন্যের হাত ধরে রাখতাম আর কেউ কারো হাত ছাড়াছারি নাই। আর ঐ জায়গাটায়, যেখানটায় এসে শব্দ শুনতে পেতাম সেখানে আসামাত্রই দুজনের দুই কান চেপে ধরে, লম্বা একটা দৌড় দিতাম। আর বাসার ঠিক সামনে এসে তবেই আমরা থেমেযেতাম তার আগে কখনোই থামিনি।
সেখানকার লোকজন ঐ জায়গা সম্পর্ক নানান কথা বলত। আর আমি এও যেনেছিলাম যে আমরা যেই বাড়িটাতে ছিলাম সেটার জায়গাটা নাকি ভালো ছিল না। এলাকার পুরোনো লোকেরা বলাবলি করতেন যে সেখানে নাকি মুক্তিযোদ্ধের সময় গণকবর পড়ে ছিল। আর আমাদের ঐ বিল্ডিংটা নাকি ঐ গণ কবরেরই উপর দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে। আর তাই সেখানকার আবহাওয়া ছিল সব সময়ই গম্ভীর আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলায় বাসার প্রতিটি ঘড়েই আলো জ্বালিয়ে রাখতে হতো। আর আমরাতো ছিলাম দোতলায় আর নিচতলায় থাকত অন্যরা। সেখানেতো আরো বেশি অন্ধকার। আর আমি তখন আব্বু আম্মুর সাথে থাকতাম। আব্বু আম্মু বলতেন যে প্রায় রাতেই আমি নাকি ঘুমের মধ্যে কিসব আবোল তাবোল ও আস্পষ্ট কথাবার্তা বলতাম, কখনো চিৎকারও করতাম কিন্তু আবার ঘুম থেকে জাগতাম না। আর আমার মনে আছে যে আমি খুব বেশি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখতাম আর ঘুম থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে বসতাম। সেখানকার আশপাশটার পরিবেশই ছিল ইংলিশ ছবির ভৌতিক পরিবেশের মত। কাছে একটা বিরাট ফাকা মাঠ আর তার সাথে ছিল জঙ্গল, আর আমাদের বাসার পেছনে ছিল একটা বশতি ও তার পেছনদিক দিয় ছিল একটা লেক। লেকটি একেবারে ঠিক ঐ মাঠটার পেছন দিয়ে গিয়ে ওই জঙ্গলের দিকে এসে মিশেছে। প্রায় রাতেই শেয়াল এর ডাক শুনে ভয় পেতাম। আরও কি একটা পাখিও ডাকত। মনে হতো খুব দূর থেকে ডাকছে, ঠিক তখনি আবার মনে হতো যেন খুব কাছে এসে ডাকছে, "কু উও...., কু উও... কু উও...." করে। কিরকম যেন ভয়াবহ একটা পরিবেশ সবসময়ই আমি লক্ষ্য করতাম।
তোমরা জানো? আমি একদিন আমাদের ঐ দোতলা বাড়িটির ছাঁদ থেকে প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম। সেদিন কি হয়েছিল শোনো, আমি তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি মাত্র। স্কুলে খুব বেশিক্ষণ ক্লাশ হত না। ঐদিন আমার স্কুল ছুটির পর আমাকে আমার ছোট ফুপ্পি স্কুল থেকে নিয়ে এসছিল। আমার ভাইয়ারা তখনো স্কুল থেকে ফিরেনি। আর তখন বাজে দুপুর ১টা কি ১টা ৩০মিনিট হবে, আমি হঠাৎ অন্যমনষ্ক হয়ে ছাদের দিকে উঠতে লাগলাম একা একা। সিঁড়ি বেয়ে একা একা এর আগে কখনো ছাদে উঠিনি। আর ঐ বিল্ডিংটার সাথে গা ঘেষে ছিল আরো দুটো বিল্ডিং। ঐ দুটোর একটি ছিল তিনতলা আর অন্যটি ছিল দোতলা। আর ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর অপর দিকে ছিল একটি বট গাছ। আমাদের ছাদের উপর ছিল একটি বিরাট আকৃতির ইট-সিমেন্টের ট্যাঙ্ক। আমি কেন যেন ছাদের দিকে গেলাম, কি উদ্দেশ্যে গেলাম তা বুঝে উঠার আগেই আমি ছাদের ঐ পানির ট্যাঙ্কের উপরে উঠতে লাগলাম, একপা ছাদের র্যালিং এর উপর রেখে অন্য পা যেই ট্যাঙ্কের উপর দিতে গেলাম, আমি দেখলাম আমি পড়ে গেছি। আর আমি পরছিলাম বিল্ডিং এর বাহিরের দিকটায়। কি যে ভায়ানক মুহূর্ত ছিল সেটা তা তোমাদের আমি বলে বোঝাতে পারবোনা। আমি মুহূর্তের মধ্যেই চোখ বন্ধ করে ফেলি আর ভাবি আমি বুঝি নিচে পরে গেলাম আর এখানেই বুঝি আমার মরণ। আমি ভেবেছিলাম আমি বুঝি আর বাচবোই না। কিন্তু আমি অলোকিকভাবে কেমন করে যেন বেচে গেলাম এবং এক ফোটা আচড়ও লাগেনি আমার গায়। আমি চোখ খুলে দেখি আমি ছাদের র্যালিং ও পানির ট্যাঙ্কটির মাঝের এক ফিট অঞ্চলের চিপার মধ্যে, মেঝের উপর ছাদেই শুয়ে আছি। আমারত বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি এমিনিভাবে বেচেগেছি। আমি অবাক, এ কিকরে সম্ভব? আর তখনই মনে হল স্রষ্টাই আমাকে দয়া করে প্রাণ ভীক্ষা দিয়েছিলেন। র্যালিংয়ে যেভাবে বারি খেলাম তাতে যদি বাহিরের দিকটায় পরে যেতাম সানশেইড তো ছিলোইনা, আমারও সেদিন বেচে থাকার মত কোন অবস্থাই ছিল না। আর ঐ বট গাছটার নিচে কার যেন একটা মাজার ছিল। আর তিনতলার ছাদের উপর দিয়ে দেখা যেত কখনো কখনো ঐ বটের পাতা, কখনো বটের পাতা না দেখে দেখতাম আমের কিংবা লিচুগাছের পাতা। কি যে তার রহস্য তাও বুঝতাম না। ভাইয়াদের সাথে বা ফুপ্পির সাথে যখনই ছাদে গিয়েছি তখনই ঐ গাছটার দিকে এক বার হলেও লক্ষ্য করছি। আর ভাইয়াদের মুখেই বলতে শুনেছিলাম এই রহস্যের কথা। এর পর একা একা আর কোন দিন আমি ঐবাড়ির ছাদে যাইনি।