অমিতাভের সাথে সেদিন আচমকা দেখা হয়ে গেলো। কয়েক মুহুর্তের দৃষ্টি বিনিময়। আমাকে দেখেই বরফের মতো জমে গেলো অমি। অমিতাভকে আমি ‘অমি’ বলে ডাকতাম। হৃদয়ের শুকনো পাতার নিচে লুকিয়া রাখা নাম! অমিতাভের সাথে দেখা হওয়াটা আসলে কোনো ঘটনা নয়, নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাগুলোর একটি। অমির কাছ থেকে একটা এসএমএস এলো; ‘অনেকদিন বাদে তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। বদলাও নি একদম’। মুঠোফোন বার্তাটা মোটে ১৭বার পড়লাম। এতো কেবল দুটো বাক্য নয়, এটা অনুমতি প্রার্থনা! মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরতি বার্তায় লি্খে পাঠালাম ‘চশমাটা তোমাকে মানিয়েছে’। কেন লিখলাম? কিছু মানুষকে অবজ্ঞা করা যায়, অপমান করা যায় না। ঝিঝিপোকা যেমন লাল চোখের মাছিকে ডেকে আনে নিজের মৃত্যুর জন্য। ঠিক সেই কাজটাই করে ফেলেছিলাম সেদিন।
অমি আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। যেন খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছে এমনভাবে। বাইরের সব কোলাহল থেমে গেলো, মনের মধ্যে নেমে এলো নতুন এক নীরবতা। চিরন্তন আড়াল এক গোপন দরজা! চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো অমি। সম্ভবত অমি চোখে চোখ রাখতে চাইছে না। আমিও ইচ্ছে করেই ওর দিকে তাকালাম না আর। পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে, আমি যদি না তাকায়, তবে তার জন্য সহজ থাকাটা সহজ হবে। অথচ এটা তো কোনো সম্মুখ সমর নয়! কে জানতো, উড়ে যাওয়া সময়ের ভেতর দিয়ে দেখা হওয়াটা একসময় বদলে যাবে। আগের মতো আর অনুভূতি তৈরি হবে না।
কিছু একটা ভেবে দ্বিধাগ্রস্থ অমিতাভ আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলো। তাকিয়ে বললো, ‘কেমন আছো’। কথাটা বলার সময় তার কন্ঠটা খুব আড়ষ্ট বলে মনে হলো। হৃদয়কাড়া হাসি দিয়ে জানতে চাইলাম, তুমি? ‘ভালো’। অমি’র ‘ভালো’ শব্দটা- নিসর্গের মাঝে আর্তনাদ হিসেবে কানে বাজলো। এটা হলো অমি’র বলা সত্যিকারের কোনো মিথ্যে। অমি’র মুখটা একেবারে অভিব্যক্তিহীন হয়ে উঠেছিল, অনেকটা মৃত মানুষের মতো। দুর্বলতা ঢাকতে সেলফোনের স্ক্রিনে নিজেকে দেখে নিলো। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা যেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বিষয়ে স্থানান্তর হয় সেই চেষ্টায় আমরা কথা খুঁজতে লাগলাম। মাঝে মধ্যে নিরবতাও একধরনের ঠাট্টা হয়ে ওঠে। অথচ একসময় অফুরন্ত গল্প ছিলো আমাদের! আবেগের সাথে লড়লাম আমি। নারীর চিরন্তন অনুভুতি বিজয়ী হ'লো অপর সব আবেগের সঙ্গে লড়াইয়ে। বুঝতে পারলাম প্রশ্নের পর প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে মনে ; কিন্তু একে একে সেগুলোকে গিলে ফেলছি। সহজ প্রশ্ন, কি করছো এখন? তেমন বিশেষ কিছু না। তুমি? আমি সেই ৫-৯টার রুটিনে আছি। তো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে? হ্যাঁ একদম ঠিকঠাক। 'আসি' অমি এমন ভাবে বললো, যেনো কথাটা সে বলতে চায়নি।
অমিতাভ সম্পর্ক থেকে পালানো একজন মানুষ। আমি তার অন্তর্মুখি স্বভাব আর অসাধারণ ধীর-স্থিরতাকে আমি ঈর্ষা করি। ঈশ্বর অমিতাভকে এক জোড়া সুন্দর চোখ দিয়েছেন। চোখজোড়া সব পড়তে পারে। বর্তমানের অমিতাভের চোখের পেছনে গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিমত্তা নয় বরং পরিসমাপ্তিহীন রাতের অন্ধকার। জীবনে কিছুই শেখেনি সে: কেবল ক্লান্ত হওয়া ছাড়া।
সুখের জন্য আমরা যতই ব্যাকুল হইনা কেন, যতই চোখ বন্ধ করে রাখি না কেন... লোভের জন্য একবার আত্মা বিক্রি করে দিলে তা প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তবে আকাংক্ষাকে কখনো মেটাতে পারেনা। মানুষের মনের গভীরে সমস্ত না পাওয়াগুলো ভাইরাসের মতোই বসবাস করে। কিছু অনুভূতি অভুতপূর্ব। তারপরও ভালোবাসা বদলে দিতে পারে স্রোতের দিক; বয়ে আনতে পারে সমাপ্তি। ভালোবাসা কখনো অনুভব করতে না পারলে সেটা হারানোর বেদনাও অনুভব করা যায় না। প্রকৃতিতে কোনো অনুকম্পা নেই; আমরা নিজেরা অনুকম্পা সৃষ্টি করি, নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য।
লেখার শিরোনাম ঋণঃ ব্লগার হাবিব রহমানন'র কবিতার লাইন থেকে।