আধুনিকতা, ইহজাগতিকতা ও বিনির্মান’র সম্পর্ক পাঠ
আব্দুল ওহাব আল্ মিসরী
ইসলাম ধর্মের ‘তাওহীদ’ (তাওহীদি প্যারাডাইম) অনুশারে, খোদা এই বিশ্ব-ব্রম্মান্ড সৃস্টির পরে মানুষ অথবা প্রকৃতির কোনটির সাথেই এক মূহুর্তের জন্যও যোজিত (dwell) থাকেননি বা কোনটিকে ছেড়ে যাননি একেবারে। খোদা এই বিশ্ব-ব্রম্মান্ডের সৃস্টিকর্তা ঠিকই, তবে তিনি স্রষ্টা হিসেবে সৃস্টির সাথে একটি তফাত বা দূরত্বসূলভ গাম্বীর্য্য বজায় রাখেন। এর ফল মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে একধরনের প্রাথমিক যুগ্নতা তৈরী করে, যা মহাবিশ্বে অন্যান্য দ্বৈততার মধ্যেও ধ্বনিত হতে দেখি (যেমন: শরীর-আত্মা, নারী-পুরুষ- এমন সব)। স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যকার এই তফাত-জ্ঞান বা দূরত্ব-বাস্তবতা‘র ভিত্তিতেই মানব অস্থিত্বের পরিধি নির্ধারিত হয়। কিন্তু পাশাপাশি মানব-বাস্তবতা/মানববিশ্ব (human space) পরিপূর্ণ করবার ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের এমনই স্বাধীনতা আছে যা কিনা আলোচ্য বাস্তবতার পরিধিতে সীমিত এবং পরিপূর্ণ; মানুষ এসবকে (স্বাধীনতা/ফ্রিডম) তার সারবত্তা ও সক্ষমতার ক্ষেত্রে চাই গ্রাহ্য করুক বা না। মহাজাগতিক বাস্তবতা (space)‘র পরিপ্রেক্ষিতে সীমিত এই ব্যক্তি-মানুষ প্রকৃতিগত অবস্থা থেকে সংস্কৃতিগত অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়, যথা একটি সরল অপাপ (simple innocence) অবস্থা যেখানে মানুষ জানেনা কল্যাণ আর মন্দের ফারাক; এমন হালত হতে অগ্রসর হয় একটি জটিল অভিজ্ঞতার দিকে যেখানে মানুষ নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারে বা নিজেকে স্বম্মক চিনতে পারে। সংক্ষিপ্তাকারে ব্যাখ্যা করলে, মানুষ (humanity) প্রাথমিক ভাবে অগ্রসর হয় একটি অবিকশিত (embryonic stage) অবস্থা হতে- যেখানে মানুষ নিশ্চিত যে তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই, সে অনিয়ন্ত্রিত এবং তারা প্রকৃতিরই সন্তান- তাকে প্রকৃতি হতে আলাদা করবার কোন সুযোগ/অবকাশ থাকেনা। এবং উত্তরিত হয় এমন একটি খোদায়ী (রব্বানী) অবস্থায় যেখানে ব্যক্তিমানুষ মূলতঃ নিয়ন্ত্রিত বা পরিসীমায়িত। তবে এরূপ পরিধির মধ্যে থেকেও সে নিজের স্বাধীনতা, ব্যক্তি মর্যাদা, নিজস্বতা, আলাদা বোধশক্তি ইত্যাদি উপভোগ করবার বা এসকল কিছুকেই এড়িয়ে চলবার সক্ষমতা অর্জন করে। মানুষ প্রকৃতিরই একটি অংশ ঠিকই, কিন্তু সেটি জৈবিক মোটেও নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা (কম্প্রিহেন্সিভ সেকুল্যারইজম) ও আধুনিকতা
পশ্চিমা দার্শনিক ঐতিহ্যে দর্শন চর্চা এবং আধুনিকতা বিষয়ে বিবিধ আলাপচারিতায় ‘প্রকৃতি’ ধারনাটি কথা বলবার জন্য সহায়ক এবং অত্যাবশ্যক একটি প্রত্যয় হিশেবে ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট আলাপের প্রেরণা বা পূর্বধারনা সমূহ খুঁজে পেতে হলে আলাপের মধ্যকার মানুষ, তার অবস্থান, তার সম্পর্কে যাবতীয় (humanity) বিষয়াবলীকে ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনই একটি প্রশ্ন/প্রসঙ্গ বা উদ্দেশ্যকে চোখে রেখে আমি পশ্চিমা আধুনিকতায় ‘প্রকৃতি’ এবং ‘প্রাকৃতিক বিধান’র কিছু বৈশিষ্ট্যকে দেখছি এবং এরই মধ্যদিয়ে তাদের ‘হিউম্যানিটি’ ধারনাটির স্বরূপ পাঠে এগিয়েছি। এক. বিশ্ব-প্রকৃতি চিরন্তন, শাশ্বত, আত্মঅস্থিত্বসম্পন্ন, স্বনিয়ন্ত্রিত এবং নিজেই নিজের ব্যাখ্যাকারী; দুই. ‘প্রাকৃতিক বিধান’ সমূহ অপরিবর্তনীয় এবং এসবকে কোন ভাবেই বর্জন বা লঙ্ঘন করা অসম্ভব; তিন. ‘প্রকৃতি’ ধারনাটি এমন একটি একক যার নূন্যতম রূপান্তরও অসম্ভব; এবং এই একক-এর মধ্যে কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা, ক্রমবিচ্যুতি, দ্বৈততা, মর্যাদা’র তারতম্য ব্যতিরেকে বিশ্ব-প্রকৃতির আসমস্তকিছু অন্তর্ভূক্ত করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব; চার. ‘প্রাকৃতিক বিধান’ সমূহ মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের উপরেই সমান ভাবে প্রয়োগ হয়, মানুষের জন্য আলাদা নীতি বা এটি মানুষকে আলাদা গুরুত্ব প্রদান হতে নিরপেক্ষ/বিরত থাকে; পাঁচ. মৌলিক ভাবে সকল প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ সমূহ হয় অবয়বী, নতুবা আকারবিহীন শক্তি গুচ্ছ। তবে অবস্থাটি যেমনই হোকনা কেন- প্রকৃতি তার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিরন্তর পরিবর্তনশীল; ছয়. মানুষ নিজেও পরিচালিত হয় প্রকৃতি হতে অর্জিত মান বা আদর্শ-এর ভিত্তিতে।
আলোচ্য এই নীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতেই আধুনিক যামানায় প্রকৃষ্ট মানবতার গড়ন হয় ‘প্রকৃতি’র ব্রতী হয়ে যাওয়া এবং তারই কাছে আত্মসমর্পন করবার মধ্যদিয়ে। এবং একবার এই সম্ভাবনা সম্পন্ন হলে পরে মানুষ তার নিজস্বতা হারিয়ে প্রকৃতির একটি জৈবিক সত্ত্বা’য় পরিণত হয় এবং নিজেকে লঘুকৃত করে প্রকৃতির কাছে। এবং যেহেতু প্রকৃতির সমস্ত গুনাবলী আর কর্মসক্ষমতা আরোপ করা সম্ভব ‘বস্তু’র উপরও, সেহেতু বিষয়টিকে শুধুমাত্র ‘প্রকৃতি’ বলে ব্যাখ্যা করার চেয়ে বলা যায় যদি ‘জড়-প্রকৃতি’ (nature-matter)- তবেই বলাবর কাঙখাটা পরিপূর্ণতা পায়। এই ‘জড়-প্রকৃতি’ প্যারাডাইম খানা পশ্চিমা আধুনিকতার মূলভাবনা বা অর্ন্তলীন সূত্র হিশেবে প্রচ্ছন্ন থাকে।
তাই পশ্চিমা আধুনিকতার নানান আপাত রহস্যের অভিমূখ উম্মোচন সম্ভব হয় আলোচ্য শব্দবন্ধটি দিয়ে। অধিকন্তু, এটি পশ্চিমা আধুনিকতার পরিচয় তুলে ধরে ‘সমন্বিত ধর্মনিরপেক্ষতা’ (comprehensive secularism) ধারনার মধ্যদিয়ে যাকিনা ‘অংশতঃ ধর্মনিরপেক্ষতা’ (partial secularism)- এর বিপরীত। পার্শিয়াল স্যাকুলারইজম মূলতঃ রাষ্ট্র আর চার্চের নামমাত্র পৃথকীকরণকে বুঝায়; এর বাইরে বিশ্বদৃষ্টি হিশেবে এটির কোন সমন্বিত স্বরূপ নেই। এটি নিজের পরিধি রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে এবং কিয়দ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিগন্ডিতে সীমিত রাখে; পরম ও প্রতিষ্ঠিত বিষয়াবলী (নৈতিক, ধর্মীয় বা এমন অন্য)‘র ক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। এবং চুড়ান্ত যেকোন বিষয়ে এটি নিজেকে গরহাজির রাখে (যেমন: মানুষের উৎপত্তি, মানুষের গন্তব্য, জীবনের উদ্দেশ্য এবং সম্পর্কিত অন্যান্য)।
অন্যদিকে, কম্প্রিহেন্সিভ স্যাকুলারইজম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করছে। চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ এবং কিছু-নূন্যতম-পর্যায়ে জনজীবন (public life) থেকে ধর্মের দূরত্ব তৈরীই এর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়; বরং নৈতিক, ধর্মীয় এবং মানবীয় সবধরনের মূল্যবোধ থেকে সার্বিক ভাবে জনজীবনকে মুক্ত/নিরপেক্ষ রাখাই কম্প্রিহেন্সিভ স্যাকুলারইজম-এর উদ্দেশ্য। কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় পরিসর থেকে মূল্যবোধ-এর বিতাড়ন নয়, বরং ক্রমে মানুষের জনজীবন তথা ব্যক্তি-জীবন এবং শেষতক সমগ্র বিশ্বকে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ করে তুলতে আগ্রহী এই কম্প্রিহেন্সিভ স্যাকুলানইজম। জড়-প্রাকৃতিক-বিশ্বই সেক্ষেত্রে একমাত্র গ্রহনীয় আদর্শ বা মূল্যমান। এবং এমনতর পরিকাঠামোর মধ্যদিয়ে দেখা যায়- মানুষ এবং তার সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় সেই অপরিবর্তণীয় ‘প্রাকৃতিক বিধান’র আদলে যা কোন প্রকার ধর্মীয়-মানবিক আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং প্রাকৃতিক ভাবে স্বনিয়ন্ত্রিত। মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের উপরই আলোচ্য অলঙ্ঘনীয় ‘প্রাকৃতিক বিধান’ প্রযোজ্য বলে ধরে নেয়া হয় এবং মনে করা হয় মূল্যবোধ নিরপেক্ষ ও সয়ঙ্ক্রিয় প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভাবে মানুষের নাগালের অতীত। এমন ‘প্রাকৃতিক বিধান’ সমূহকে ভিন্ন ভাবে ‘বৈজ্ঞানিক নীতি’ও (scientific laws) বলা হয় এবং ধরে নেয়া হয় এগুলো মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের উপরই এই নীতি প্রযোজ্য। বিষয়টিতে আরো গভীর দৃষ্টিক্ষেপ যদি করা যায় দেখা যাবে, এখানে সক্রিয় আছে মূলতঃ সেই জড়-প্রাকৃতিক প্যারাডাইম-ই এবং আবর্তিত হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রাকৃতিক/বস্তুগত নীতির দ্বারা। ফলে মানবজাতির বিশ্বদৃষ্টি হিশেবে পশ্চিমা আধুনিকতাকে একটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান-এর অভিযোজন এবং একমাত্র গ্রহণীয় আদর্শ বা মূল্যমান বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। মানুষের প্রয়োজন, আকাঙ্খা এবং আগ্রহের বাস্তবায়নে জগতকে যোগ্য করে গড়বার চেয়ে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ, যৌক্তিক, প্রকৃতিগত এবং অলঙ্ঘনীয় নীতি-বিধান দ্বারা ব্যক্তি মানুষের জীবনকে পূণঃ সাজাবার মহড়া চালু হয়। তাই বলা যায়, কম্প্রিহেন্সিভ স্যাকুলানইজম মূলতঃ পশ্চিমা আধুনিকতা‘র প্রবর্তিত বিশ্বদৃষ্টিরই অন্য নাম; দুটি শব্দই এই অর্থে প্রতিশাব্দিক, একটির দিকে নির্দেশ করলে পরে অন্যটির প্রতি দৃষ্টিতরণ ঘটে অনায়াসে।
ইহজাগতিকতার অধিবিদ্যা
জড়-প্রাকৃতিক ভাবনার আদলে পরিচালিত আধুনিকতা তথা কম্প্রিহেন্সিভ স্যাকুলারইজম মূলতঃ একটি ইহজাগতিক (immanence) বিশ্বদৃষ্টি। ইংরেজিতে immanence শব্দটি এসেছে ল্যাটিন immanere ক্রিয়াপদ হতে, সরল অর্থে ‘থাকা’ বা ‘বাস করা’ বুঝায়। আর immanent শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘সাথে থাকা’ বা ‘বিষয়ের মধ্যে যোজিত থাকা’ বা ‘যা কিছু নিজেই নিজের নিয়ন্তা’- এমন। এভাবে immanent- এর পরিধিতে বিশ্বের সমস্ত কিছুই স্বগঠিত, আত্মনিয়ন্ত্রিত, আত্মপরিচালিত এবং স্বব্যাখ্যাতঃ, যেমনটি কম্প্রিহেন্সিভ স্যাকুলারইজম-এ জড়-প্রাকৃতিক বিশ্ব বা নিতশের দর্শনে superman।
সাধারণ ভাবে immanence-কে transcendence বা পরম- এর বিপরীত বলে ধরে নেয়া হয়; ইংরেজিতে transcendence শব্দটি ল্যাটিন ক্রিয়াপদ transcender থেকে আসা (trans মানে ‘অপর দিকে’ বা ‘বিপরীতে’ বা ‘অনতিক্রম্য’ এবং scandere মানে ‘উঠা’ বা ‘আরোহণ করা’)। মানুষের গতানুগতিক অভিজ্ঞতা আর বৈজ্ঞানিক পরিগন্ডিতে ব্যাখ্যার অতীত যে জ্ঞান বা যে পরমোপলব্ধি, তা-ই এখানে transcendence। অন্যদিকে immanent কে সর্বেশ্বরবাদীরা নিজেদের আলোচনায় বস্তুবিশ্বে খোদার লীন থাকার বিষয়টি বুঝানোর জন্য ব্যবহার করে এবং মাঝে মাঝে সৃষ্ট বস্তুবিশ্বকে বুঝাতেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে transcendence শব্দটি দিয়ে আস্তিক্যবাদীরা সৃষ্ট বিশ্বের বাইরে থাকা খোদার একক স্বত্ত্বানুভূতিকে প্রকাশ করে এবং বিশ্বাস করে খোদা সৃষ্ট-এই-বিশ্বের থেকে স্বাধীন।
immanence বা ইহজাগতিকতার অধিবিদ্যায় খোদার অস্থিত্বকে অনায়াসে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা যায়। এবং কিছু প্রকারান্তরে তাঁর অস্থিত্ব স্বীকার্য্যও হয়। তবে যে খোদার অস্থিত্বকে এক্ষেত্রে স্বীকার করা হয় তিনি এই বস্তুবিশ্বেই অংশ এবং কোন ভাবেই তিনি এই বিশ্বের থেকে আলাদা নন। আরবীতে এই ধারনাকে ওয়াহদাতুল ওজুদ বা সামগ্রিক স্বত্তার এককত্ব হিশেবে চিহ্নিত হয়। আরবীতে এমন অন্য একটি শব্দ হচ্ছে ‘হুলুল’, যার সরাসরি আভিধানিক অর্থ ব্যপৃত থাকা বা ‘যোজিত থাকা’ বুঝালেও এটিকে সামগ্রিক স্বত্তার এককত্ব বা immanence হিশেবেও অনুবাদ করা যায়। ‘হুলুল’ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে পরম্পরাগত পর্দা বা পর্যায় সমূহ উম্মোচিত হয়। আর ওয়াহদাতুল ওজুদ পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধ বা উম্মোচিত অন্তিম একটি অবস্থা বা মূহুর্তকে নির্দেশ করে। পরম্পরাগত পর্দা বা পর্যায় সমূহের অবমুক্তি শুরু হয় তখনই যখন পরম স্রষ্টা (transcendence creator) তাঁর সৃষ্টির (মানুষ ও প্রকৃতি) সাথে এমন নৈকট্যে আসে যে তাঁকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বত্তা হিসেবে অনুভব করা সম্ভব হয়; তবে এই অনুধাবনা কোন ভাবেই স্রষ্টার সাথে লীন হয়ে যাওয়ার উপলব্ধি নয়। আরব মুসলমানদের লোক-ঐতিহ্যে শিশুদেরেকে আল্লাহর প্রিয় বা নিকটের একজন হিশেবে মনে করা হয়, যেটি একধরনের ইহজাগতিকতার ইঙ্গিত দেয়। এবং এতদসত্ত্বেও, বিশ্বে উভয় সত্ত্বারই অস্থিত্ব বিদ্যমান থাকে। তবে একটি অপূরনীয় (unbridgeable) ব্যবধান বা গ্যাপ বিদ্যমান থাকে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে। খোদা তাঁর সৃষ্টির থেকে পরিপূর্ণ ভাবে আলাদাই থাকে, যদিও তিনি খুব কাছেরই একজন।
উদাহরণ হিশেবে এরূপ ‘হুলুল’ মূলতঃ একটি ধর্মতাত্ত্বিক প্রকরণ বলে পরিচিত হতে প্রস্তুত দেখা যায় এবং মরমী ইসলামের অনেক প্রকরণ এই ধারারই অন্তর্ভূক্ত। একারনে সূফী কবিতা সমূহে তাই মানুষ আর আল্লাহর মধ্যকার পার্থক্য বা স্বাতন্ত্র্য অথবা কবিতার বিষয়বস্তু হিশেবে তাঁর ‘এককত্ব’ বিষয়ক আলোচনা কেবলই আলংকারিক (figurative) হয়ে পড়ে বা হতে বাধ্য হয়। ঐশ্বরিকতার অনন্যপরতা (independence of devine) হতে শুরু করে মানুষ নিজেকে হাজির করবার বা নিজেকে নিজে চিনবার কাজটিও এমনতর মেহনতপূর্ণ ব্যাপর হয়ে দাঁড়ায় ওয়াহদাতুল ওজুদ ও ওয়াহদাতুশ শুহুদ (প্রতক্ষ স্বাক্ষ্যর ভিত্তিতে লব্ধ বা সজ্ঞানতার এককত্ব) –এর সুনির্দিষ্ট পরিসরে। ওয়াহদাতুশ শুহুদ মূলতঃ মানুষের মধ্যে আসমস্ত অস্থিত্বের বিষয়ে সচেতনতা তৈরী করে। এ মূহুর্তে খোদার এককত্ব তত্ত্বীয় ভাবে প্রতিভাত হয় না, তার’চে এটি সম্পূর্ণ রূপে মানসিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থা যেখানে মানুষ একটি অগ্রসর সজ্ঞানতায় ব্যপ্ত থাকে এবং এই মহাবিশ্ব ও খোদার অস্থিত্ব সুর্ন্দিষ্ট ভাবে জ্ঞাত হয়- আল্লাহ একই সাথে মানুষ ও প্রকৃতির সাথে যোজিত এবং একই মূহুর্তে এই সম্পর্কেও অধি।
এছাড়া চরম কিছু সূফী প্রবনতায় হুলুল-এর অবস্থানটি এমন ভাবে অতিরঞ্জিত হয়ে ওঠে যে এসকল প্রকরণে খোদা তাঁর সৃষ্টির সাথে পূঁথিগত ভাবে যোজিত (immanenre) হয়ে পড়ে এবং এই যোজিত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি পরিচিত হন। এটি হচ্ছে ওয়াহদাতুল ওজুদ-এর একটি অন্তিম পর্যায় যখন মহাবিশ্বের গাঠুনিক নীতি সমূহ উক্ত ধারনার সাথে সম্পর্কিত হয়ে ব্যাখ্যাতঃ হয় এবং সম্পূর্ণ ভাবে ইহজাগতিক হয়ে ওঠে; তখন উভয়ের মধ্যে ফারাক তৈরীর কোন উপায়ই অবশিষ্ট থাকেনা। ফলে মানববিশ্ব (human space)’র নানান সম্পর্কের মধ্যে তৈরী হয় একটি জড়ানো বা ল্যাপ্টানো (liquid) সম্বন্ধ এবং পুরো মহাবিশ্ব স্বনির্ভর, আত্মনিয়ন্ত্রিত ও নিজেই নিজের ব্যাখ্যাতা হিশেবে একটি একক জৈবিক সত্ত্বায় পরিণত হয়। মনুষ্য সম্পর্কিত এবং মানুষ ভিন্ন অন্যান্য সকল প্রপঞ্চ- যত প্রকারই হওয়া সম্ভব, সমস্ত কিছুই শেষতক ইহজাগতিকতায় পর্যবসিত হয়। অন্যভাবে বললে, দ্বৈত সম্পর্কের (খোদা ও মানুষ, মানুষ ও প্রকৃতি) যৌগিক অবস্থান থেকে একটি অদ্বৈতবাদী (monism) জৈবিক সরল বিশ্বে আমাদের পূণঃ ফেরত ঘটে। এখানে একই নীতি-এ সমগ্র মহাবিশ্ব সংকোচিত হয় বা সমগ্র মহাবিশ্বকে একটি সাধারণ নীতিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।
অন্যদিকে অদ্বৈতবাদের নানান প্রকরণের মধ্যে দুটি ধরণ মৌলিক বলা যায়- এক. আধ্যাত্মবাদী ধারনা, এবং দুই. বস্তুবাদী ধারনা। উভয়ের মধ্যে নামাকরণের মৌলিক পার্থক্য মূলতঃ বিশ্ব-জগতের ব্যবস্থাপনা নীতির রকমফেরের উপর নির্ভর করে। ‘খোদা বা স্পিরিট’ হচ্ছে আধ্যাত্মবাদী ধারনার একমাত্র নীতিগত অবস্থান। অন্যদিকে বস্তুবাদী ধারনায় এই নীতির নাম ‘প্রকৃতি (in the material sense), প্রাকৃতিক বিধান, প্রণোদনা, প্রয়োজনীতা তথা বৈজ্ঞানিক নীতি’। এছাড়া অন্য একটি প্রাথমিক স্তরে অথবা প্রাথমিক-স্তর না বলে, বলা যায় উভয়ের মধ্যবর্তী একটি ধারনা-এ মনে করে বিশ্বজগত তার গড়নে ও নামাকরনে মূলতঃ আধা-আধ্যাত্ম ও আধা-বাস্তবতার সমন্বয়। এবং এটিকে তখন মনো-আধ্যাত্মিক প্রেরণা, পরমাত্মা, পরম ধারনা (geist, animus mundi, elan vital, absolute mind, absolute idea) হিশেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ‘প্রকৃতি’ এমন একটি চরম রোমান্টিক ধারনা হিশেবে উপস্থিত হয় যে এটি খোদার খোদায়ীকেও আচ্ছাদিত করে ফেলে। এটি ইতিহাসের পরমতা, ইতিহাসের বিধান, উৎপাদন সম্পর্ক (sprit of history, laws of history, relations of production, eros, or eros and thanatos) ইত্যাদি শিরোনামেও আলোচিত হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আধ্যাত্মবাদী, বস্তুবাদী বা উভয়ের সমন্বয়ী ধারনাই হোকনা কেন- এর প্রতিটিতে যেকোন একটি বিষয়ই সবসময় ইহজাগতিক হয়; এই ইহজাগতিকতা হয় প্রকৃতির মধ্যে, নয় মানব ধারনায়, নতুবা উভয়ের মধ্যেই বিরাজ করে। হেগেল immanence-এর একটি বাস্তবধর্মী ধারনা প্রদান করেন; তাঁর মতে, বিশ্বজগতের সকল প্রপঞ্চই একই সাথে ও সময়ে বস্তু/বাস্তব ও আধ্যাত্ম/পরম। পরম ধারনা নিজেকে পরিপূর্ণ করে প্রকৃতি ও বস্তুর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। এবং ইতিহাস অন্তিমে বিশ্বজগতের সমস্ত কিছুই একীভূত হয় এবং সকল দ্বৈততা ও স্বতন্ত্র্য বিষয়াবলী যোজিত হয়ে (liquidated) একটি জৈব একক তৈরী করে; এটিই হচ্ছে খোদা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার পরিপূর্ণ অভেদাবস্থা বা সর্বময় ঈশ্বর চেতনা।
অন্য অর্থে, ইহজাগতিক/সর্বঈশ্বরবাদী বিশ্বদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি মানুষ মূলতঃ ‘জড়-প্রাকৃতিক’ প্যারাডাইম নির্ভরতার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। মানববিশ্বের এমন জড়ানো বা যোজিত (liquidated) অভেদাবস্থায় মানুষ তার স্বত্ত্বাধিকার হারিয়ে বসে, হয়ে পড়ে বৃহত্তর প্রাকৃতিক এককের নগন্য অংশ মাত্র। তখন মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে নূন্যতম কোন পার্থক্য বা দূরত্ব অনুভূত হয়না। নৈতিকতার প্রভেদজ্ঞান বা ভাল মন্দর বিবেচনা আর পছন্দের ক্ষেত্রে মানুষ আর দায়িত্ববান স্বাধীন স্বত্ত্বা নয়। সমগ্রের সাধারণ অংশীদার হিশেবে ব্যক্তি সচেতনতার কোন গুরূত্ব নেই। তখন ব্যক্তির কর্তব্য হয় শুধু নিজেকে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করে দেয়া এবং এরই মধ্যে লীন হয়ে যাওয়া। পৃথিবীর যাবতীয় পার্থক্যে বা বৈচিত্রে ব্যক্তি একজন অক্রিয় (passive) অনুর্ঘটক; প্রাকৃতিক পৃথিবীর সেই অবিকশিত (embryonic stage) অবস্থার সাথে তার সম্পর্ক নিবিড় আর ভাল মন্দ‘র পার্থক্য বিচারে শূণ্যজ্ঞান।
এমনতর ভাববিশ্বে সমস্তকিছুর একটি একক পরিণতি অর্জনই মূখ্য হয়ে ওঠে যেখানে মাছ ও পাখি হয়ে পড়ে মানুষের সমকক্ষ কিছু। এবং এই চেতনা আরো প্রগাঢ় পরিণতি লাভ করে নির্বান প্রাপ্তি‘র স্তর পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়ে যেখানে ব্যক্তি শেষাবধি অস্তিত্বহীন/শূন্য/কিছুইনা (nothing)। এরূপ বিলোপ (fana) সাধনের বিষয়টি মূলতঃ সর্বেশ্বরবাদী প্রত্যাশাই। সমস্ত কিছুরই তখন মানবনতি ঘটে, সব সৃষ্টির উপরই একটি পরমাত্মিক ধারনা ভর করে, সবকিছু একটি অলঙ্ঘনীয় ধর্মবোধের আওতায় বিবেচিত হয় সমান। ফলে পবিত্র বিষয়াবলী অন্যান্য অপবিত্র বিষয়ের সমরূপ, একই ভাবে পূত ও অসীম বিষয়াবলী অপবিত্র ও সাময়ীক বিষয়ের সমরূপ মনে করা হয়, ভাল হয় মন্দ, খোদার সমকক্ষ হয় মানুষ, আপেক্ষিকতার সমরূপ পরম; বস্তুত সমস্ত কিছুই সমস্ত কিছুর অর্ন্তভূক্ত, সমকক্ষ, লীন। এবং শেষ পরিণতিতে সমস্ত কিছুই (nihil, nothing) অস্তিত্বহীন, কিছুইনা, শূণ্য।
অন্যদিকে আধ্যাত্মিক প্রকরণ হিশেবে যখন immanence –কে পাঠ করি তখন আমি panatheism শব্দটিতে আগ্রহী হই; যেখানে অন্তর্ভূক্ত theism অংশটি এসেছে theos থেকে যার মানে হচ্ছে ‘ঈশ্বর’। immanence –শব্দটিকে আমি জড়বাদী (materialistic) এবং আধা-আধ্যাত্মিক (quasispritual) প্রকরণ হিশেবে দেখেছি। এই লেখাটির পরিসরে জড়বাদী সর্বব্যাপীতা (materialistic immanence/pantheism)’র ধারনাটি আত্মস্থ করা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটিই পশ্চিমা আধুনিকতার তলে জিইয়ে থাকে। ‘জড়-প্রাকৃতিক’ প্যারাডাইমের সাথে ‘এর (materialistic immanence-এর) গঠনগত ঐক্য এতটাই নির্দেশনামূলক যে, বুঝতে বাকী থাকেনা পশ্চিমা আদুনিকতা একটি immanentistic আলাপচারিতা ও চর্চা বৈ কিছু নয়। আমরা যখন দেখি ‘এই বিশ্বজগত (মানুষ ও প্রকৃতি) প্রাকৃতিক নিয়মেরই অংশ বা বিষয়’ তখন ‘মানুষ হয় উপাদন (এডামস্মিথ ও মার্ক্স) প্রসূত, নয় পূণঃউপাদন (ফ্রয়েড)’ – হিশেবেই বিবেচিত হবে; অর্থ্যাৎ ‘জীবন কোন ভাবে বেঁচে থাকার তাগিদ ভিন্ন কিছুই নয়’; অর্থ্যাৎ ‘টিকে থাকা কেবল যোগ্যতরদের জন্যই’; অর্থ্যাৎ ‘এই অতিমানুষটি (superman) তার নিজের জীবনের বাইরের কোন মূল্যমান দ্বারা পরিচিত বা বিবেচিত হতে পারেনা’; অর্থ্যাৎ ‘পৃথিবী কেবলই একটি ইন্দ্রিয় একক মাত্র’; অর্থ্যাৎ ‘ব্যক্তির সজ্ঞানতা তার ভৌত শরীর হতে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনা’; অর্থ্যাৎ ‘একজন নারীর শরীরই তার অন্তিম সম্পদ’; অর্থ্যাৎ ‘বিবর্তন আর গতিই প্রকৃতির প্রধান ও একমাত্র স্থায়ী বৈশিষ্ট্য’; অর্থ্যাৎ ‘মানুষ হয় তার প্রাকৃতিক বা সামাজিক পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত, নয়তো তার জীন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’; অর্থ্যাৎ ‘একজন মানুষ মানেই একটি বস্তু-সত্ত্বা বৈ নয়’; অর্থ্যাৎ ‘বস্তু আত্মনিয়ন্ত্রিত’; অর্থ্যাৎ ‘বিজ্ঞান যেকোন মূল্যমান নিরপেক্ষ বা এর মূল্য নির্ধারিত হয়নিজেকে দিয়েই’; অর্থ্যাৎ ‘সমস্ত কিছুই বা সকল মূল্যমানই আপেক্ষিক’; অর্থ্যাৎ ‘সবকিছুই পবিত্র বা পবিত্রতা বলে কিছুই নেই’- জীবন র্চ্চায় এর যেকোনটিতেই সম্পর্কিত হই যদি, সচেতন বা অবচেতন ভাবে আমরা হয়ে পড়ি একটি ইন্দ্রিয়পরায়ন, স্বনির্ভর, আত্মনির্দেশিত, স্বব্যাখ্যাত এবং স্বনিয়ন্ত্রিত বিশ্বজগতেরই অংশ, এর বাইরে মানুষ হিশেবে আমাদের মহত্তর কোন সজ্ঞা নেই। কেননা ইহজাগতিকতাই সর্বশ্ব।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৫২