সকাল ৮টা ৩০মিনিট। আলু ও ডিম ভাজি দিয়ে চারটে রুটি খেয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা হলাম ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। পরনে সবসময়ের মত সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি। পায়ে ইন্ডিয়ান জুতা।
আমাকে এখন ক্যাম্পাসে পৌঁছতে হবে ৪ ধাপে। প্রথমে ১ কি.মি. হাঁটতে হবে, এরপর ইজি বাইকে আড়াই কি.মি. যেতে হবে, তারপর বাস যোগে ১৩ কি.মি. যেতে হবে এবং শেষ ধাপে সাড়ে ৩ কি.মি. মিনিবাস দিয়ে গেলেই ক্যাম্পাসের সামনে নামা যাবে। এই মিনিবাসের নাম বাহাদুর শাহ পরিবহন লি.। আমার আজকের লেখা এ মিনিবাসকে নিয়েই।
প্রথমে একটু বাস সম্পর্কে জেনে নিই।
এ বাস চলে যাত্রাবাড়ী থেকে সদরঘাট রুটে। মিনিবাস হলেও অন্যান্য বড় বাসের মতই ৩০ থেকে ৩৫টা ছিট থাকে এতে। ঠিকমত বসা যায় না। বসলেও নড়াচড়া করা যায় না। অন্যের গা ঘেষে বসতে হয়। মোট কথা কষ্টকর জার্নি। তবুও সবাই যায় কারণ এই রুটে বাস চলে না, লেগুনা তো নিষিদ্ধ। এই বাসের বিকল্প শুধুই রিকশা। যার ভাড়া ৫০ থেকে ৮০ টাকা। তাই মাত্র ১২ টাকায় ১৫ মিনিটের যাত্রায় এই কষ্ট সবাই মেনে নেয়।
এ বাসে গেলে কয়েকটা ঝামেলায় পড়তে হয় তার মধ্যে একটি হলো সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থেকে এ বাসে উঠতে হলে বিশাল লাইনে সিরিয়াল ধরে তারপর উঠতে হয়। এ ক্ষেত্রে যে ঝামেলা হয় তা হলো, মিনিবাস যখন আসে তখন কিছু লোক জোর করে বাসে উঠে পড়ে। উঠতে উঠতে বাস ভর্তি হয়ে যায়। যার কারণে বাস আসলেও সিরিয়াল কমে না। আবার লাইনের শুরুতে যেখান থেকে বাসে ওঠে সেখানে বাস আসলে লাইন ভেঙ্গে অনেকে উঠে পড়ে যার কারণে সিরিয়াল ছাড়াও অনেকে ওঠে তাই লাইনের লোকেরা পিছে পড়ে যায়। এতে করে মহিলা, শিশু ও শান্তশিষ্ট লোকদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তারা না পারে হুড়োহুড়ি করে উঠতে আর না পারে বাটপারি করে সিরিয়াল ছাড়াই বাসে উঠতে। এটা নিত্যদিনের ঘটনা।
আজ লক্ষ্য করলাম, আমার সামনে লাইনে থাকা এক মহিলা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। লাইনের লোক কমছে না দেখে একবার লাইন ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলো হুড়োহুড়ি করে উঠার জন্য কিন্তু পারেনি। লাইনের শুরুতে গিয়েছিলো লাইন ছাড়াই উঠার জন্য কিন্তু তাতেও সফল হয়নি। অনন্যোপায় হয়ে আবার ফেরত এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। তার চেহারায় এক অসহায়ত্বের ছাপ পড়েছে। তার এই পরিস্থিতি দেখে আমার অবচেতন মনে প্রতিবাদী এক চেতনা তৈরী হলো। ভাবলাম যেসব বাস সিরিয়াল ছাড়া যাত্রী উঠাচ্ছে এগুলোকে আটকানো দরকার।
একটা বাস সিরিয়াল ছাড়াই যাত্রী ভরে এগিয়ে আসছিলো। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, চিৎকার করে বললাম, এ বাস যাবে না। ড্রাইভার বিরক্তি ভাব নিয়ে সরে যেতে ইশারা করলো। আমি আরও জোরে চিৎকার করে বললাম এ গাড়ি যাবে না। হয় সব যাত্রী নামাও অথবা এই সিরিয়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি সাইড করে রাখো। হেল্পার রাগে দাঁত কড়মড় করে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো আর অপরদিকে আমার গাড়ি আটকানো দেখে আমার পিছে এসে সিরিয়ালে থাকা কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে। তারাও আমার সুরে সুর মিলালো। ড্রাইভার বাধ্য হয়ে সবাইকে নামিয়ে দিলো। যাত্রীরা কিছু বলতে চাইলে বললো গাড়ি যাবে না। অবশেষে সবাই নেমে পড়লে লাইন থেকে যাত্রী উঠিয়েই পড়ে বাসটি চলে গেলো।
এরপর যা হলো, কোন গাড়ি যাত্রী ভরে আনলেই অন্যরা তা আটকাতে লাগলো। দুএকজন নিজ উদ্যোগে লাইনের শুরুতে গেলো এবং সুশৃঙ্খলভাবে সবাইকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করলো যাতে লাইন ছাড়া কেউ ঢুকতে না পারে। কেমন জানি সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠলো।
আজকে এমন একটা সাহসী কাজ করেছি বলে আমি নিজেকে হিরো ভেবে এ পোস্ট লিখছি ভাবলে ভুল করবেন। এটা একটা সাধারণ প্রতিবাদ। এরচে আরও বড় বড় প্রতিবাদ আমাদের করার বাকি কিন্তু আমরা করছি না। আমি ভাবছি ভিন্ন কিছু। আজকের এ অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে...
আমি দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ এই রুটে চলি এবং মিনিবাসে এমন হুড়োহুড়ি করে ও লাইন ছাড়া উঠতে দেখি। কিন্তু এতদিন আমার মনে এ প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত হয়নি কেন?
আমার প্রতিবাদের আগে সবাই প্রতিবাদী হলো না কেন? কই, কাউকে তো কোনদিন এমন প্রতিবাদ করতে দেখলাম না। কেন?
আমি একজন বাঙালি, আমার প্রতিবাদী চেতনা জাগতে এত বিলম্ব হলো। তাহলে পুরো জাতিটাই কি এমন যে তাদেরও প্রতিবাদী চেতনা জাগতে বিলম্ব হচ্ছে? আচ্ছা সবাই যদি এমন না হয় তাহলে শতশত জনতার মাঝে গুটিকয়েক পোষা গুণ্ডাদের হাতে মানুষ মার খায় কি করে? আবার যদি সাহসী না হয়ে থাকে তাহলে এই শতশত জনতাই আবার চোর-ডাকাত পিটিয়ে মারে কিভাবে?
একটা অফিসে ঘুষের অভাবে ফাইল আটকে থাকলে সেখানে যদি প্রতিবাদী কণ্ঠ তোলা হয় তাহলে সে অফিসে কি ঘুষ বন্ধ হবে না? পুলিশ যেখানে ঘুষ খায় সেখানেই যদি আমরা পুলিশকে ধাওয়া করি তাহলে কি পুলিশ ঘুষ খেতে চাইবে?
আসলে সব দোষ আমাদেরই। আমরাই চুরি করি, আমরাই চোর পুষি।
আজকের ঘটনায় আমাদের মতই কিছু যাত্রী যেমন অনৈতিকভাবে গাড়িতে উঠছিলো আবার আমাদের মতই কিছু যাত্রী তা দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাহলে দোষটা কার? শুধু ড্রাইভার বা হেল্পারের নাকি আমাদেরও?
আমরা দেশের যে কোন পরিস্থিতির জন্য সরকার বা কোন বিভাগকে দায়ী করি, আসলেই কি সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ একা দায়ী নাকি আমরাও দায়ী?
| ১১ই সেপ্টেম্বর'১৮ | জবি ক্যাম্পাস
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ২:২৫