দশ
বিশেষত্বহীন নিষ্কর্ম এক শৈশব । দশ বছর বয়সী শৈশব হতে পারে দুরন্তের, কর্দমাক্ত মাঠের কিংবা রক্তিম বিকেলের সর্বোপরি একটি ডানপিটে কৈশোরের । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠেনি । যে বয়সে অন্য সবাই দৌড় ঝাঁপ লম্পঝম্প আর ব্যাট বল নিয়ে মেতে থাকত, আমি থাকতাম চিলেকোঠার পুরানো আসবাব আর মরচে ধরা কিছু তৈজসপত্র নিয়ে; একজোড়া খড়ম, একটা পুরানো ভাঙ্গা সাইকেল আর অকেজো কিছু প্লাস্টিকের খেলনাও ছিলো । কখনো ভেন্টিলেটরের ছিটাবৃষ্টি আমাকে গা করে নি, শীতের আদরমাখা রোদ্দুর আমার শরীর জড়িয়ে ধরেনি । খুব ইচ্ছে করতো একদিন আমিও অন্য সবার সঙ্গে বই খাতা নিয়ে হেলেদুলে ইশকুলে যাবো । সেই ইচ্ছাটা প্রতিনিয়ত আমাকে দুষে যায়, প্রতারক মিথ্যাবাদী বেঈমান হিসেবে আখ্যায়িত করে আর একটু একটু করে উবে যেতে থাকে । আমার আর ইশকুলে যাওয়া হয়না, টুকুনের সাথে খেলাও হয়না ।
খুব ছোটো থাকতে টুকুন একবার হামাগুড়ি দিতে দিতে ভুলক্রমে এসে পড়ে দরজায় । সিঁড়ি ভাঙতে বেচারার খুব কষ্ট হয়েছিলো জানি আমি । টুকুন বন্ধ দরজার দেয়াল ধরে একটু একটু দাঁড়াতে চেষ্টা করে আর পড়ে যায়, আবার চেষ্টা করে আবার পড়ে যায়; এভাবে সফল হবার আগপর্যন্ত সে চেষ্টা চালিয়েই যায় । আমি ওপাশ থেকে ওর ইনফ্যান্টিভ অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারি । ওর ছোটো ছোটো দ্রুতগামী শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে আঁটকে যায় আমার স্ফীত হৃদস্পন্দন । ওর মুঠি পাকানো হাতের তালুতে জমে থাকে থাকে আমার ঘর্মাক্ত সুখ, মার্বেলের মত স্বচ্ছ দৃষ্টিকণিকায় আমি দেখতে পাই আমার ঘূর্ণিয় পৃথিবী । আমি টুকুনকে কাছে ডাকি, টু-কু-ন । কি আশ্চর্য! টুকুন শুনতে পেয়ে খিলখিলিয়ে হাঁসে । আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়, আমি আবারো টুকুনকে ডাকি । টুকুন চকিত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না । আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি টুকুনের কাছে পৌঁছুতে, কিন্তু পারিনা । বন্ধ দরজা এবং গবাক্ষের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবার কৌশল ভালমত রপ্ত করতে পারিনি আমি । তাই সেই অদৃষ্ট দ্বারারক্ষী কারারুদ্ধ করে রাখে আমাদের; দূরত্ব স্থির করে দেয় আমার আর টুকুনের জগতে । আমি হাহাকারের মত চিৎকার করি; কিন্তু কেউ শুনতে পায়না সেই আহাজারি । কেউ জানতে চায়না চিলেকোঠার রহস্য ।
অল্পক্ষণেই কিছু ভারী পদশব্দ সিঁড়ি ভেঙ্গে ছুটে আসতে থাকে, সেই সাথে উত্তেজিত চিৎকার চেঁচামেচি । তারপর থেকে আমি আর টুকুনকে কাছে পাইনি । ওর খিলখিল শব্দে হেঁসে ওঠা, চকিত দৃষ্টি ফেরানো ইত্যাদি আমার অনুভূতির আনুসন্ধানিক দৃষ্টিতে অনুসন্ধিৎসু প্রলেপ মেখে থাকে সর্বক্ষণ । কিন্তু ওকে আমি আর খুঁজে পাইনি ।
দশ বছর আগে
টুকুন? এই টুকুন ….. কোথায় তুই?
এইতো মা, ছাদে ।
কি?! টুকুনের মা অতি উত্তেজনায় সম্ভ্রব হারিয়ে ফেলেন; চিৎকার করে বাড়ি উঠিয়ে ফেলেন । যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অবস্থানরত এক দঙ্গল কাক বিষ্ঠা ছড়ানোর পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে উড়াল দেয় অন্যত্র । জানালার কার্নিশের কবুতরগুলো রয়ে গেছে আগের জায়গাতেই; তারা এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে ফ্যামিলিয়ার ।
টুকুন সাবধানে নেমে আসে নিচে ।
অবশেষে জবাবদিহি করতে হয় বাবার কাছে ।
ছাদে গিয়েছিলি কেন?
বল আনতে ।
কতবার তোকে বলা হইসে ছাদে ওঠা বারণ, তা যে কারণেই হোক । আপাতত কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক । এই বলে তিনি চলে গেলেন অফিশিয়াল কার্যক্রমে ।
টুকুন কানে ধরে এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে । বেশিক্ষণ নয়, যতক্ষণ না ওর বাবা আড়াল হয় । বিকেলে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসা এই হচ্ছে টুকুনের দৈনন্দিন স্কেজ্যুল । আজকে বেরিয়ে দেখে সবার মন খারাপ । ব্যাপার কি? জিজ্ঞাস করতেই জানা গেলো খেলার জায়গা নেই । প্রাণপ্রিয় স্কুলমাঠটি এখন সেনাবাহিনীদের অস্থায়ী ক্যাম্প । গোলাবারুদের নিচে সবুজ ঘাসের আর্তনাদ, চিরহরিৎ গাছগুলো করিৎকর্মা দক্ষ হাতে পড়ে নিঃশব্দে উনুনে কয়লা হয়ে যেতে থাকে । শ্রেণীকক্ষগুলো এখন ব্যবহারিত হয় গণ ঘর্ষণাগার হিসেবে । অডিটোরিয়ামে প্রতিধ্বনি তোলে যুবতী ও প্রসূতি বালিকাদের আর্তচিৎকার, হিংস্র কামুক পশুস্বত্বার পরিতৃপ্তিময় উত্তেজক সুখধ্বনি । বস্ত্রহরণের হুটোপুটি শব্দ এবং পরিশেষে অমানবিক যৌনাচার, ধর্ষণ হত্যা !!
টুকুন সনাতনী বর্গীদের গল্প শুনেছে, শুনেছে আধুনিক পাক স্বৈরাচারীদের গল্প । দুই গল্পের ভিন্নতা এখন সে অনুধাবন করতে পারে । ‘পাকসাদ জামিন শাদেবাদ’ নামক শব্দবহর যখন তীব্র গতিতে ওকে পিষে মারতে চায় ও দৌড়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে । এ কুশব্দের কুঞ্জন কুহকিনী যখন ক্রমেই ওর রোম খাড়া করিয়ে দেয় তখন সে তার হস্তাঙ্গুলি দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে এটাকে রুখে দিয়ে ভেতরটা বাঁচিয়ে রাখতে । কিন্তু বাইরেরটা বাঁচাতে গিয়ে টিরানীদের টিটকারিতে পড়ে অনেকেই বিকিয়ে দেয় তাদের মহৎ এবং বিকাশিত বোধগুলোকে । খসে পড়ে ছদ্মাবরন, উন্মোচিত হয় এক নতুন ব্যাপ্তি; চোস্ত দাঁড়ি, ধর্মীয় স্তুতি, বৈষম্যনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি । কালান্তরে এদেরকে আবার দেখা যায় সরফরাজদের তৈলমর্দন কার্যক্রমে ।
কালপঞ্জিতে টুকুন আজ টুকে রাখে ১৩ই ডিসেম্বর, মানে বছর শেষ হতে আরও সতেরো দিন ! সতেরো দিন পরে ওর এগারো বছর পূর্ণ হবে । টুকুন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নতুন বছরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের । বাবা নতুন সাইকেল কিনে দেবেন; সেই সাইকেলে চড়ে দিকহীন ভট্টাচার্যের স্বর্ণতরীর মত মর্ত্য পাড়ি দেবে টুকুন । চিলেকোঠায় অবশ্য দাদার আমলের একখানা অকেজো সাইকেল আছে; কখনো আগ্রহবোধ করেনি সে । ওর চাই নতুন ঝকঝকে সাইকেল, যার ঘুরন্ত স্পোকগুলো স্পার্ক খাবে সোনালী সূর্যরশ্মিতে, টুং টাং শব্দ খাপ খেয়ে যাবে প্রকৃতির শব্দ সমারোহে । কখনো কুয়াশা কখনো বৃষ্টি ভেজা বাতাস চাইকি গ্রীষ্মের খরতাপ সবসময় সাইকেল থাকবে ওর চিরসঙ্গী, একমাত্র বাহন । এমনই একটা ইচ্ছা বহুদিন থেকে পোষণ করে আসছে টুকুন । সাইকেলের প্রতি ওর আগ্রহ জাগে বিশেষ করে ‘বাইসাইকেল থিফ’ সিনেমাটা দেখার পর থেকে । সেদিন টুকুনের বাবা দেখতে গেলেন নতুন মুভি ‘সানফ্লাওয়ার’ । টুকুনের মা এবার সঙ্গে যাননি । ছেলে বড় হইসে! তাছাড়া এলাকার মুরুব্বীরাও একটু অন্য চোখে দেখে । টুকুনের বাবা অবশ্য এসব পাত্তাই দেননি, ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ এই এক কথায় সব ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতেন । অগত্যা গাঁইগুঁই করে টুকুনের বাবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়েন । আর ফিরলেন না । কতবার টুকুন বাবার হাত ধরে পাড়ার নাট্যশালায় গিয়েছে, থিয়েটারে দেখেছে ‘ক্লিওপেট্রা’, কিংবা ‘রক্তকরবী’ যাত্রাপালায় দেখেছে ‘সখী রঙমালা’ আর ‘সোহরাব-রুস্তম’ দেখতে দেখতে বার বার ঘুমিয়েও পড়েছে । ভাঁড় নারায়ণ ঘোষ এর মূকাভিনয় দেখে হাঁসতে হাঁসতে গড়িয়ে পড়েছে । সবই এখন স্মৃতির এ্যালবামের এন্টিক ।
টুকুনের ছোট চাচা আবার পলিটিক্স নিয়ে নানান গবেষণা করেন, এই রুটের সেক্টর কমান্ডার ওঁর বাল্যবন্ধু । তিনি খোঁজ লাগালেন চারিদিকে । কিন্তু টুকুনের বাবার হদিস মিলল না! নষ্ট ট্রানজিস্টর ঠিক করতে করতে আশ্বাস দেন, চিন্তার কিছু নাই ভাবী । ভাইজানরে ফিরাইয়া আনার দায়িত্ব আমার । স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একের পর এক বিজয়ের খবর ভেসে আসতে থাকে । কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ওরা । শুনে সাময়িক শঙ্কাটা কেটে গিয়ে চঞ্চলতা বিরাজ করে সবার মাঝে ।
স্থানীয় কাঁচাবাজারটা ভেঙ্গে গেছে । কসাইখানায় পশু আর মানুষের রক্ত মিলে মিশে একাকার, আলাদা করার উপায় নেই । মাছের আড়তে দলিত মথিত মৎস্য পিণ্ড, আস্ত মাছ যা আছে তা থেকে পঁচা দুষিত গন্ধ বের হচ্ছে । বাবলা গাছের হাড়গিলা গুলো চক্কর দিয়ে মাটিতে নেমে আসে বার বার । উচ্ছিষ্ট খাদকেরা কাড়াকাড়ি করে ডাস্টবিনে । তবু নেই কোনো মানুষের হাঁক ডাক । চিরচেনা বাজারটির দুষিত ভাগাড় এখন একটা এপিটাফবিহীন ন্যাক্রপলিস । চতুর্দিকে শুধু দুর্ভিক্ষ হাহাকার, জননীর জনমভর আর্তনাদ । চারিদিকে শুধু ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, বাতাসে অনাহুত আহাজারি, পোড়া মাংসের কটু গন্ধ । দুর্বিষহ নারকীয় তাণ্ডবে বিপন্ন জন জীবন । নিস্তব্দ পরিবেশ; ‘অল কোয়াইট অন দ্যা ফরিদপুর স্পট’ ।
টুকুনদের এই রুটে আজ আক্রমণ আসতে পারে । স্থানীয় হর্তাকর্তা পাকিস্তানীদের পা চাটা কুত্তা নজিব মোল্লার সেক্রেটারি সুরুজ আলীকে জব্দ করে সিক্রেট বের করেছে সেক্টর কমান্ডার আজগর; গোপন সূত্রে খবরটা পেলেন টুকুনের চাচা । এই খবর শুনে অনেকে রাতারাতি মালামাল নিয়ে উধাও হতে শুরু করলো । টুকুনরা রয়ে গেলো শুধু ।
গভীর রাতে বুটের ভারি শব্দ আর ইঞ্জিনের একটানা ঘ্যানর ঘ্যানরে ঘুম ভাঙ্গে টুকুনের । কারো ঘরে একটা আলোও জ্বলছে না । সুনসান নীরবতা আর অন্ধকারের মাঝে ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে হঠাৎ । একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় টুকুন; রফিক? ও রফিক বাইর হইয়া আসো । মেহমানরা আসছেন, ওদেরকে ঘরে নিয়ে বসাও । কই গেলা তোমরা সবাই, বাইর হইয়া আসো জলদী; খান সাহেবেরা আসছেন ।
উনি তো ঘরে নাই, মহিলা একটা কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ধুক করে ওঠে টুকুনের বুক । চুপচাপ এগোতে গেলে পেছন থেকে কেউ একজন মুখ চেপে ধরে ফেলে ওকে । ওর চাচা, ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলছে । একটু পর পেছনের জানালায় একটা ছায়াকাঠামো দেখা যায় । টুকুনের চাচা নিঃশব্দে আলমারিটা খুলে বুলেটসহ তিনটা সাব মেশিনগান বের করে আনেন । গলিয়ে দেন জানালা দিয়ে, আর ফিসফিসিয়ে বলেন সাবধানে থাকিস আজগর । টুকুনকে নিয়ে তিনি এবার অতি সাবধানে পা ফেলেন পেছনের সিঁড়িতে । ভাঙ্গা রেলিঙের ছাদে ম্যানিপ্লান্টসের মত নানান জায়গায় জড়িয়ে রয়েছে বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক তার । ভাঙ্গা পাইপের পানি প্রায়শই গড়িয়ে যায় সার্কিটের গোড়ার দিকে । সাবধানে চিলেকোঠার বন্ধ দরজার তালা খুলেন তিনি । ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে ঠিকই খুলে যায় দ্বার দেদার । টুকুন কিছু বুঝতে পারার আগেই দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পায় । বাইরে থেকে ওর চাচা বলে যান, খবরদার আমি না ফেরা পর্যন্ত টুঁ শব্দটিও করবি না । আমি তোর মা কে নিয়ে আসছি এক্ষুনি । তারপর তালা বন্ধ হবার একটা বিদঘুটে শব্দ শুনতে পায় টুকুন ।
বদ্ধ গুমোট ঘরটাতে ছোট ছোট ভেন্টিলেটরের ছিদ্র ছাড়া আর কোনো ফাঁক নেই । চারপাশে জমে থাকা বাতিল সব যন্ত্রপাতি, ফেলনা মোড়ক ইত্যাদি ছাড়াও দেয়ালের কোণ ছাড়িয়ে সিলিঙ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে মাকড়শার আঠালো জাল । ঘুটঘুটে অন্ধকার হাতড়ে একটা ছেঁড়া কুশন পেয়ে যায় টুকুন, তা ই বিছিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে ফ্লোরে । কখন তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ঘুম চলে এসেছে আর কখনই বা তা কেটে গেছে, বোধগম্য হচ্ছে না ওর । তবে এখন রাত গড়িয়ে সকাল তা বুঝতে পারছে । শব্দহীন জগতে নিঃশব্দে উঠে গিয়ে দরজায় কান পাতে টুকুন । কিন্তু কিছুই শুনতে পায়না । আশায় থাকে চাচা আসবে মাকে নিয়ে; মা ওকে পেয়ে জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে কপালে । আদর করে বলবে আর ভয় নেই টুকুন সোনা, এইতো আমি এসে গেছি । ওরা চলে গেছে, আমাদের কিচ্ছু করতে পারেনি । প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা প্রহর টুকুনের কেটে যায় উদ্বিগ্নতায়, অজানা আশঙ্কায় কিংবা উত্তেজনায়, এই মনে হয় এলো । কিন্তু পরক্ষনেই সে অনুধাবন করে সবকিছু, মেনে নেয় চিলেকোঠার বন্দীত্ব । এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায়, মাসও শেষ হয়, সময় এখানে নিষ্ক্রিয় । সময় পারেনি ওকে এগারো বছর বয়সে উন্নীত করতে কিংবা ওর জীবনের স্থিরচিত্র গুলোকে ক্রমান্বয়ে চলমান গতিশীল করে দিতে । টুকুন এখন যাবতীয় ক্ষুদা তৃষ্ণা, ঘুম ক্লান্তি, প্রাকৃতিক আবশ্যম্ভাবলী ইত্যাদি জৈবিক প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধ্বে । এখানে থাকতে থাকতে গা সওয়ার হয়ে গেছে সব । ভেন্টিলেটরের আলো বাতাসই ওর অনুভূতি, বেঁচে থাকার একমাত্র উপাদান । এই একটুকরো ছিদ্র দিয়ে গলে আসা ফিকে আলোর সলতেতে প্রজ্বলন ঘটে ওর নিষ্প্রভ জীবনের । কখনো হলুদাভাব, কখনো তেজস্বী, কখনো বা নিস্তেজ আলোয় স্নান করে টুকুন । আলোকস্নান শেষে সে অনুসন্ধান করে বেড়ায় এর ফোটন গুলোয় । বুঝতে পারে এ আলো নিয়ে এসেছে কোনো রূপসী তরুণীর দৈহিক উষ্ণতা, মুমূর্ষু বাতাস বহন করছে ওরই সমবয়সী আরেকটি প্রাণের প্রশ্বাস । ও ধরতে পারে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত শব্দ চলাচল, বায়ুস্তরে কম্পিত ফ্রিকোয়েন্সি, টিউনিং করতে করতে একসময় পেয়ে যায় ফলাফল । বাড়িতে নতুন বাসিন্দা এসেছে ! তাদের ছয়মাসের ছোট্ট একটা বাবু আছে । বাবুকে তার মা আদর করে টুকুন সোনা বলে ডাকে ।
টুকুন তার হারানো জগত ফিরে পায় আবার । নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে অনুভব করে । নিজেকে অন্যের ভেতর বিলীন করে দিয়ে হারানো শৈশবে পুনুরুদ্ধার করার ব্যর্থ প্রয়াস । তারপরও টুকুন আঁকড়ে থাকে ।
দশ বছর পর
মলিন পলেস্তরা খসা দেয়ালে আজ চুনকাম শুরু হয়ে যায়, ফাটলগুলো ঢাকা পড়ে যায় কংক্রিটে । রঙ বেরঙের বেলুন আর কাগজের ফুলে সুসজ্জিত চারপাশ । টুকুনের আজ ১১তম জন্মদিন । বাসার সবাই শশব্যস্ত মোমবাতি, কেক পেস্ট্রি আর রেপিং পেপারে মোড়ানো দ্রব্যাদি নিয়ে । উৎসব শেষে টুকুনের বাবা ওকে নিয়ে গ্যারেজের দিকে যান । সারপ্রাইজ! একটা নতুন ঝকঝকে মাউন্টেইন বাইক । টুকুন বিশ্বাস করতে পারছেনা যেন । খুশিতে ওর ইচ্ছা হয় তৎক্ষণাৎ সাইকেলটাতে চেপে বসতে । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে সাইকেলের বডি, প্যাডেল, স্টিকার ইত্যাদি পরখ করে । উত্তেজনায় টুকুন ঠিকমত ডিনারও করে না । রাত্রে শুয়ে শুয়ে পরিকল্পনা করতে লাগলো কাল কখন কোন জায়গায় যাওয়া যায় । ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে ।
সকালে টুকুন সাইকেল নিয়ে বের হতে যাবে এমন সময় আকস্মিক হট্টগোল আর চেঁচামেচিতে থমকে দাঁড়ায় সে । দারোয়ান দৌড়ে এসে বলে, স্যার পুলিশ আসছে; ঢুকতে দেইনাই, আপনারে ডাকে । টুকুনের বাবা পরিস্থিতি সামাল দিতে ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেন তৎক্ষণাৎ ।
তদন্ত বিভাগের সাবইন্সপেক্টর বলেন, আমরা এখানে এসেছি একটি গোপন সূত্র ধরে । ইসলামী কট্টরপন্থী নেতা সাইদুর রহমান ও তাঁর সহযোগী সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করার ওয়ারেন্ট আছে আমাদের কাছে । সাইদুর ইতোমধ্যে সারেন্ডার করে ফেলেছেন । আমরা এখানে এসেছি নজিবুল হকের খোঁজে । সাইদুর রহমানের সাথে তাঁর লিংক আছে বলে যতদূর মনে হয় এবং আমাদের কাছে সমস্ত ইনফরমেশনও আছে ।
তিনি আমার পিতা । আপনার যা কিছু বলার আমাকে বলতে পারেন ; টুকুনের বাবা বলেন ।
তাহলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশে যুদ্ধ অপরাধী সংশ্লিষ্ট আইন নতুন করে পাশ করেছে; নিশ্চয় জানেন? এবং যুদ্ধ অপরাধীদের তালিকায় আপনার পিতা নজিবুল হকের নামও আছে । তাই তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।
টুকুনের বাবা যখন কিছুতেই তাদেরকে সার্চ করতে দিচ্ছিলনা । তখন খবর পেয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছুটে আসেন । তিনি দাবী করেন এ বাড়িটাও অবৈধ ভাবে দখল করা হয়েছে । এবং এর অরিজিনাল দলিল ডকুমেন্টও ওদের কাছে আছে । নজিবুল হোক ওরফে নজিব মোল্লার যুদ্ধপরাধের সাক্ষী, প্রমাণ ঘটনা সবই ওদের কাছে আছে । এখন শুধু ওনাকে কোর্টে চালান করে দেয়া হবে । আপনি ইচ্ছে করলে লইয়ার ঠিক করে মামলা লড়তে পারেন । মনে হয় না পারবেন, গভমেন্ট কেইস ।
সুতরাং নজিব মোল্লাকে সসম্মানে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুরো বাড়িটা ভালো করে সার্চ করা হয় । চিলেকোঠার মরচে ধরা পুরানো তালা ভেঙ্গে ফেলা হয় । গুমোট বদ্ধ ঘর থেকে অনেকদিনের জমে থাকা দুর্গন্ধ বের হয় । ভেতরে একটা পঁচা বীভৎস কংকাল খুঁজে পাওয়া যায় । সাইজ দেখে অনায়াসেই বলে দেয়া যায় দশ এগারো বছরের একটা শিশুর কংকাল এটা । চিলেকোঠার রহস্য উন্মোচিত হয় অবশেষে ।
পরিশিষ্ট
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রায় কিছুই জানেনা টুকুন । ও সারাদিন ব্যস্ত থাকে সাইকেল চালনায় । স্কুল ছুটির পর মেইটদের সাথে প্রতিযোগিতা দেয় । ঝির ঝির বৃষ্টি আর সাইকেলের ছুটন্ত গতি, স্বর্গীয় এক অনুভূতি যেন! গভীর রাতে টুকুনের ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রায়ই । চারিদিক অন্ধকার, বদ্ধ একটা রুমে টুকুন একা, শুয়ে আছে মেঝেতে বিছানো একটা মাত্র কুশনে, একমাত্র ভেন্টিলেটরের ফাঁকা ছিদ্র দিয়ে একটুকরো আলো চুইয়ে আসছে সেই সাথে হালকা একটা সুবাস । টুকুন সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকে সেই আলোক উৎসের দিকে, হারিয়ে যেতে থাকে আলোকগর্ভে । তারপর সব শূন্যে উবে যায়, টুকুন নিজেকে আগের অবস্থানে ফিরে পায় আবার । সাময়িক এই ঘোরগ্রস্ততায় লেপ্টে থাকে অন্যভুবনের এক ব্যথাতুর চিত্র ।
অন্যরকম অনুভূতি !
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০৯