১
আন্দালিব সাহেব খুব আয়েশ করে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে মার্কেজের একটা বই পড়ছিলেন; নাম ‘বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প’ । পাশে রয়েছে টি পট আর এক প্যাকেট লিঙ্কন । নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট, তাঁকে একজন গিফট করেছে । তৃপ্তি পাচ্ছেন না; পুরানোটার চেয়ে অনেক লাইট এটা । কি মনে করে বই রেখে দিয়ে এবার ল্যাপটপটা নিয়ে বসলেন তিনি । অনেক দিন ফেসবুকে ঢুঁ মারা হয় না । লগিন করতে গিয়ে পড়লেন আরেক সমস্যায়; পাসওয়ার্ড ভুল দেখাচ্ছে বারবার । বিরক্ত হয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে একটা অশ্রাব্য শব্দ রিলিজ করে দিলেন তৎক্ষণাৎ । লাভ হলনা তাতেও । রিমাইন্ড….. রিমাইন্ড...... বলতে বলতে ব্রেইনস্টর্মিং করে ফেললেন তারপরও মনে পড়লনা গোপন সংখ্যাটা ।
নায়লা পড়ছে ভেতরের রুমে; ডাকাটা কি ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে অজান্তে ডেকেই বসলেন । প্রযুক্তির এই যুগে কষ্ট করে চেঁচিয়ে ডাকতে হয়না এখন আর ।
মোবাইলে রিং বাজছে কিন্তু কেটে দিচ্ছে নায়লা । এভাবে ক্রমাগত চেষ্টার আশীর্বাদে স্বয়ং বস্তুটিই এসে হাজির হয় ।
হয়েছেটা কি? এখান থেকে ওখানে তুমি মোবাইলে ফোন দিচ্ছ কেন? আমার কালকে থেকে মিডটার্ম ।
সেইজন্যই তো তোকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি, তুই পড়া ফেলে উঠে এলি কেন? আন্দালিব সাহেব কাঁচুমাচু হয়ে বলতে থাকেন ।
মেয়ের বিরক্তিসূচক মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল কথাটা । মা নায়লা তুই না আমার ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছিলি; সেটাতে তো এখন ঢুকতে পারছিনা । পাসওয়ার্ডটা কি তোর মনে আছে?
কি আশ্চর্য! তোমার একাউন্ট, আমার মনে থাকবে কেমন করে? আর পাসওয়ার্ড ভুলে গেলেই বা কেন!! কৃত্রিম ঝাঁজ মাখানো কন্ঠে বলল সে ।
ভুলে গেছিরে কিভাবে জানি, এই বুড়া বয়সে কি এতকিছু মনে থাকে । এটা পুনুরুদ্ধার করার কোনো ব্যবস্থা নাই রে মা?
থাক । তোমার আর এই বুড়ো বয়সে ফেবু ইউজ করার কোনো দরকার নেই; তুমি বরং ট্যুইটার ইউজ করো ।
বলিস কি!! তোরা পিচ্চিরা সামাজিক ওয়েবসাইটে অসামাজিক কার্যক্রম করে বেড়াবি আর আমরা বুড়োরা একটু আধটু পোকার খেলতে পারবো না; ইজ ইট ফেয়ার? আর আমি এখনও পুরোপুরি বুড়িয়ে যাইনি; কথাটা মনে রাখিস । নিজের ভাবগম্ভির বজায় রেখে আলগোছে কথাটা পাড়লেন আন্দালিব সাহেব ।
ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে মুখ চেপে আস্তে কেটে পড়ল নায়লা । অল্পের জন্য দেখলনা আন্দালিব সাহেবের পাংশু এবং O বর্ণীয় মুখাবৃত্তি ।
এসেই সে আগে ফোন করলো বড়বোন শায়লাকে ।
কাজ হয়ে গেছে আপু ।
তাই নাকি!! আব্বু কিছু বুঝতে পারসে?
একদমই না; উনি তো পাসওয়ার্ড ভুলেই বসে আছেন । আনন্দধ্বনি শোনা যায় ওপাশ থেকে ।
২
গফুর ভাই ফ্রেন্ডদের বাসায় বাসায় গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসছেন । ইনভাইটেশন কার্ডটা ছোট্ট একটি ভিজিটিং কার্ডের সমান । তাতে ডেট, ভেন্যু এবং নগদ পেমেন্টের কথাও বলা আছে ।
কিরে বিয়ে টিয়ে করতাছস নাকি?
আরে না; আমার নতুন বই । বইমেলায় বের হচ্ছে ।
‘বৈপরীত্যের ক্রমবর্ধিষ্ণু পদার্পণ’ এরম খটমটে শিরোনাম দিছস কেলা । মনে হইতাছে তো নজরুল গীত, আরে ধুরো কাব্য ।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস; কবিতার বই । নিজেও কিনবি অন্যদেরও ইন্সপায়ার করবি, ঠিকাছে? ।
না ঠিক নাই । তুই দোস্ত মানুষ; তর থেইকা বই কিনুম কোন দুঃখে । মাগনা দিবি, বুজছস?
এইটা কি কইলি ! তুই দোস্ত হইয়া দোস্তের জন্য একটা বইও কিনতে পারবি না ? তাহলে অন্যরা কি বলবে । গফুর ভাই দুর্বল জায়গায় আঘাত করে ফেললেন ।
আইচ্ছা ঠিকাছে যাহ্, ছাইড়া দিলাম । তয় বন্ধুর কথা ভুইল্লা যাইস না, মনে রাখিছ আমরা আছিলাম দেইখ্যাই তুই অত উঁচায় যাইতে পারছস ।
গফুর ভাই অস্বীকার করলেন না । বরং মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন ।
শুন, আমাগো লীগের নেতা মুকুল ভাইরে চিনস না? হেই ভাইরে দিয়া ব্যবস্থা করতেছি; হলের সব পোলাপাইনের বাধ্যতামূলক ভাবে কমপক্ষে একটা কিনতেই হইবো । অহন তর কাম হইল গিয়া; এক প্যাকেট বেনসন লইয়া তেনার সামনে যাবি, ভালা মন্দ জিগাইবি । তরে দেখলে খুশিই হইব ।
৩
ব্লগার জয়নাল হামিদ ফেসবুকের ‘বৈক্রপ’ পেজে একটা স্ট্যাটাস দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টস আর লাইকের হিড়িক পড়ে গেলো । সেই লিস্টে আছেন, স্বয়ং আন্দালিব সাহেব, বিভিন্ন দৈনিকের কলামিস্ট ও সাংবাদিকগণ, সম্পাদক থেকে শুরু করে সহসম্পাদক, বিভিন্ন ওয়েভসাইডের ব্লগারগণ এবং নির্বিশেষে আমজনতা ।
স্যার আসবো?
কে?
আমি গফুর ।
পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম থেকে চোখ তুলে তাকালেন আন্দালিব সাহেব । ও জয়নাল, এসো বসো । কেমন নিষ্প্রভ শোনা গেলো ওনার কন্ঠ ।
মিষ্টির প্যাকেটটা রেখে একটা র্যা পিং পেপারে মোড়া বাক্স এগিয়ে দিলেন গফুর ভাই ।
কি এটা?
খুলেই দেখুন স্যার, রহস্য করে বললেন যেন ।
খুললেন তিনি । ভেতরে সুন্দর মলাটের ঝকঝকে একটা বই । নামটা বেশ চকচকে ‘বৈপরীত্যের ……..’ । মেজাজ ঠিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর ।
জিজ্ঞাস করলেন কোন প্রকাশনী?
অদ্বয় । তুমি আসলে একটা ……………
অপদার্থ, তাই না স্যার? অসমাপ্ত কথাটা শেষ করলেন গফুর ভাই । তাহলে প্রথম পৃষ্ঠাটা একটু উল্টে দেখুন ।
আগ্রহ বোধ করলেন না তিনি । গফুর ভাই আরো বারকয়েক রিকোয়েস্ট করলেন । ফিরেও তাকালেন না আন্দালিব সাহেব; বরং তাঁকে উপেক্ষা করে ফেসবুক লগিনের ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে গিয়ে সফল হয়ে গেলেন এবং যারপরনাই আশ্চর্যন্যিত হলেন । তবে সেটা বাইরে প্রকাশ করলেন না । দেখলেন অনেকগুলো নোটিফিকেশন জমে আছে । চেক করতে গিয়ে দেখেন ‘বৈক্রপ’ নামক একটা পেজে তাঁর স্ট্যাটাস এবং সেটাকে ঘিরে অসংখ্য লাইকস আর কমেন্টস । বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি । এই প্রথম তিনি উপলব্দি করলেন ফেসবুকে ডিসলাইক বাটন থাকাটা যে কতটা জরুরী । হ্যাকিং …. হ্যাকিং ….. তাকিয়ে থেকে আনমনে কথাগুলো আউড়িয়ে গেলেন শুধু ।
৪
গফুর ভাই চলে গেছেন অল্প কিছুক্ষন হবে । আন্দালিব সাহেব ধীরে ধীরে বইটা তুলে নেন । দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে ছুঁড়ে ফেলেন বারান্দার ফাঁক গলিয়ে । নতুন বই ধুলোয় পড়ে মলিন হয়ে যায় নিমিষেই । এখনও হয়তো শুঁকলে পাওয়া যাবে এতে নতুন প্রিন্টের গন্ধ কিংবা প্রথম পাতাটা উল্টালে দেখা যাবে উৎকৃষ্ট বিশেষণে বিশেষায়িত উৎসর্গবাক্যটা ।।
এর আগের পর্বটি হচ্ছে বৈপরীত্যের ক্রমবর্ধিষ্ণু পদার্পণ
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৫:২৭