গফুর ভাইয়ের উৎসাহের আগুনে কিছুটা পানির ছিটা পড়লো । ‘ব্যাপার না’ এই রকম মনোভাব ধরে রেখে তিনি আরো একটু ধাবমান হবার সিদ্ধান্ত নিলেন ।
স্যার, আপনি গত পরশুর প্রথম আলো পত্রিকায় আমার ‘শ্রেয়’ কলামটি পড়ে বলেছিলেন ... গফুর ভাই কে এখানেই থেমে যেতে হয় ।
হয়েছে হয়েছে_ চিনেছি আপনাকে । আপনি তো আব্দুল করিম ভুঁইয়া তাই না?
স্যার, আব্দুল গফুর ভুঁইয়া । অত্যন্ত বিনীতভাবে পরিশুদ্ধ করে দিলেন তিনি ।
প্রকাশক সাহেবকে মোটেই বিচলিত মনে হলো না । অনেকক্ষণ পর তিনি আগন্তুকের দিকে চোখ তুলে তাকালেন ততক্ষণে তাঁর পত্রিকা পড়া শেষ হলো । গফুর ভাই তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে । আন্দালিব সাহেব মহাবিরক্ত হলেন ।
আপনারা যে কি আমি বুঝিনা । কবি সাহিত্যিকদের মাথায় মনে হয় ঘিলু একটু কমই থাকে । আপনাকে এসব নিয়ে বাসায় আসতে বলেছে কে?
স্যার, আপনিই তো সেদিন বলেছিলেন সোজা বাসায় চলে আসতে । বলে এমন ভাব করলেন যেন মুখ ফস্কে কথাটা বের হয়ে গিয়েছে । আন্দালিব সাহেব এমনভাবে তাকালেন যেন গফুর ভাই মহাপাপ করে ফেলেছেন ।
তা দিন আপনার কাগজ গুলো । গফুর ভাই স্ক্রিপ্ট গুলো তাঁর হাতে দিলেন এবং বললেন, স্যার মে আই হ্যাভ এ সিট ?
প্রকাশক সাহেব মনে হয় তা শুনতে পাননি । আজকাল মাইক্রোসফটের যুগে কেউ আর হ্যান্ডরাইটিং করে না । যার ফলে কারো ব্যাক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু ধারণাও করা যায়না’ স্ক্রিপ্ট দেখতে দেখতে বললেন তিনি ।
স্যার আপনি মনে হয় ডিটেকটিভ ফিকশন বেশী পছন্দ করেন’ নিজস্ব ভাবগম্ভির বজায় রেখে অতি সাবধানে কথাটা বললেন গফুর ভাই ।
খানিকক্ষণ ফতুয়া জিন্স পরা উস্ক খুস্ক চুলের আটাশ বছরের যুবকটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন আন্দালিব সাহেব । ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বললেন ঠিকই ধরেছো ।
মনে মনে খুশি হলেন গফুর ভাই । ভেবে নিলেন প্রকাশক সাহেব তাকে আপন করে নিয়েছেন তুমি’র মাধ্যমে।
স্ক্রিপ্ট গুলোর পাতা একটার পর একটা উল্টাচ্ছেন আর বার বার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন প্রকাশক সাহেব । তারপর বিরক্ত হয়ে হঠাৎ বলে ওঠলেন, আজকে আর পারবো না; আপনি দু দিন পরে আমার সাথে দেখা করুন ।
গফুর ভাই খুশি মনে ফিরছিলেন । প্রকাশক সাহেব ডাক দিয়ে ফেরালেন তাকে । বললেন বাকি স্ক্রিপ্টগুলো নিয়ে যান ।
মুখের মাংসপেশিতে ঢিল পড়লো গফুর ভাইয়ের । হাঁসি হাঁসি মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো । কিন্তু একটা সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন এই দেখে যে একটা গল্পের স্ক্রিপ্ট রেখে দিয়েছেন প্রকাশক সাহেব । গল্পটা সম্ভবত “বৈপরীত্যের ক্রমবর্ধিষ্ণু পদার্পণ” ।
দু দিন পরের কথা । আন্দালিব সাহেব বসে আছেন প্রুফ রিডার মোস্তাহেজ আলীর সামনে । তিনি ক্যাসপারস্কি’র মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়ার মাধমে ভুল ক্রুটি খুঁজে বের করছেন ।
যথাসময়ে গফুর ভাইয়ের উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি সময়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন এবং পলিটিক্সের সাথে যুক্ত নন’ আন্দালিব সাহেবের সূক্ষ্মবুদ্ধি অনুযায়ী ।
আকস্মিক প্রকাশক সাহেব ক্ষেপে উঠলেন, নিজেকে কি মনে করেন আপনি? বঙ্কিম নাকি লুৎফর রহমান ? মাঝে মাঝে এমন কঠিন বাক্য আবার বাচ্চাদের হাট্টিমাটিম টাইপে লেখা; অসহ্য !
গফুর ভাই চুপ করে রইলেন ।
কতক যুক্তাক্ষরের সমন্বয়ে নির্মিত কঠিন কঠিন বাক্য গঠন করলেই ভালো গল্প হয়না; একটি ভালো গল্প নির্ভর করে বিষয়বস্তু ও প্রাঞ্জলতার ওপর । ধ্রুপদি সাহিত্য চর্চা করতে হবে বুঝলেন? কঠিন কয়েকটি কথা দিয়ে নমনীয়তার ব্যাখ্যা দিলেন যেন আন্দালিব সাহেব ।
গফুর ভাই কি করবেন বুঝে উঠতে না পেরে বলে ফেললেন, স্যার ভুল ক্রুটি গুলো যদি একটু ফিক্স করে দিতেন ।
খেঁকিয়ে ওঠলেন তিনি, আমাকে প্রুফ রিডার পেয়েছেন নাকি? যান, নিয়ে যান এসব ছাই পাশ বলেই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন হাতের স্ক্রিপ্ট । অন্য কারো কাছে যান । নিজ খরচায় ঝামেলা ছাড়াই বই প্রকাশ করতে পারবেন । আমার সুনাম নষ্ট করতে চাইনা । যা আছি তাই ভালো’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লাগলেন প্রকাশক সাহেব ।
গফুর ভাই বুঝলেন প্রকাশক সাহেব তাকে আর আপন মানুষ মনে করছেন না । পরিচয়টা কি এখনই দেবেন কিনা তা চিন্তা করছিলেন তিনি । ভাবি তো বলেছিল তার বাবা খুবই উদার প্রকৃতির মানুষ ।
তার অনুরোধেই এভাবে হেনস্ত হওয়া । আর উদারতার পরিচয় পাওয়া ।
শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, ঠিক আছে স্যার। শায়লা ভাবির কথাটা রাখতে পারলাম না বলে দুঃখিত । আসি, স্লামালিকুম ।
এই এই শোনো । উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেল পেছনে ।
ফিরে এলেন গফুর ভাই ।
তুমি কি শায়লার দেবর?
জি ।
বিখ্যাত ব্লগার জয়নাল হামিদ?
জি স্যার ।
তাহলে গফুরটা কে?
স্যার এটা আমার ছদ্ম নাম ।
বাবা তোমার সবগুলো স্ক্রিপ্ট আমাকে দাও । আমি বিনা খরচে পাবলিশ করে দেব ।
জী না স্যার । আমি এডভান্স ছাড়া এগুলো কোনো প্রকাশনা সংস্থায় দেব না ।
স্বভাবতই জয়নাল হামিদ খুবই চালবাজ গফুর ভাইয়ের চেয়েও । গফুর ভাইরা দ্বারে দ্বারে হেনস্ত হয়; আর জয়নাল হামিদরা কমেন্টস আর লাইকে প্রফুল্ল হয় ।
উৎসর্গঃ সামুর সকল ব্লগারগণ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:০১