আগেকার দিনে অটো ক্যামেরাতে ফিক্সড ফোকাসিংয়ের ওয়াইড এঙ্গেল লেন্সের কারনে নিজের ছবি নিজে তোলা যাইত না, নিরুপায় হইয়া সেলফ টাইমার দিয়া মারিতে হইতো। তাতে যা পাইতাম তা হইল "সেলফ পোর্ট্রেট"। শিল্পগুনে না উৎরাইলেও নিঃসঙ্গ/অসামাজিক/ঘরকুনা/ঝগড়াটে/কৃপণ/খিটখিটে/বদমেজাজী/শীর্ষসন্ত্রাসী ব্যাক্তির স্মৃতি ছবিতে ধারণের আর কোন বিকল্প না থাকায় মানিয়া লওয়া যায়... নিতান্ত বাধ্য না হইলে কেহ উহা তুলিত না বা তুলিলেও ব্যাক্তিগত করিয়া রাখিয়া দিত! কিন্তু, হঠাৎ করে বিশ্বকে সেলফি জ্বরে ধরিল কেন?
কিছুদিন আগেও যখন ফ্রন্ট ক্যামেরা ছিল না, তখনও মোবাইল উল্টাইয়া ছবি তুলিত এবং তা সর্বদাই কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং সদৃশ হওয়ায় অধিকাংশ সময় লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকিত! কিন্তু হঠাৎ কী হইল? বিনা নোটিশে ধুমধাম করিয়া ব্যপক আকারে বাড়িয়া গেল 'সেলফি জ্বর'। সম্ভবত এর নামকরণই এর কারন। আর্ন্তজাতিকভাবে এই প্রবণতাকে চিহ্নিত এবং আদর করিয়া নাম রাখার পরপরই স্ব-ছবি তোলার হার এবং অর্ন্তজালে প্রকাশ করিয়া বাহবা পাবার চাহিদা উভয়ই বিকট রকমের বাড়িয়া যায় :-& :-&
আশেপাশে ছবি তুলিবার জন্য বহুজন থাকিবার পরও নিজেকেই কেন নিজের ছবি তুলিতে হইবে তা আমার বোধগম্য হয় না আর ছবির মান সম্পর্কে কী বলিব! আপনি যা তুলিয়াছেন, ভাল করিয়া তাকাইয়া দেখুন একবার। এগুলাকে কি আসলেই কোন ছবির পর্যায়ে ফেলা যায়? আপনার শরীরের তুলনায় মাথাটা বেঢপ রকমের বড়, এক হাত নাই কিংবা থাকিলেও তা ফ্রেমের বিশাল অংশ দখলে ব্যাস্ত! কাছ হইতে তোলার দরুণ আপনার নাকটা দেখাইতেছে হাপরের মত, থুতনিটা আগাইয়া আসিয়াছে অহেতুকভাবে!! কিন্তু, আপনি সন্তুষ্ট। চরম আপলোড চলিতেছে; লাইকও পড়িতেছে সেরাম!
টিনেজ বা ললনাদের সেলফি-প্রবণতা বড়ই বাড়াবাড়ি রকমের বেশী ঠেকে। একখান জামা পরিলে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরিয়া ৩৬০ খান ছবি তুলিতেই হইবে তো হইবেই, এরপর যতভাবে সম্ভবমাথা হেলাইয়া, মুখ বেকাঁইয়া, চোখ-ঠোঁটের নানা ভঙ্গি করিয়া আরও শ'খানেক ছবি উঠিয়া যাইবে। নিজের পালা শেষ হইলে শুরু হইবে বিবিধ বস্তুকে পিছনে রাখিয়া সেলফি। সেখানে ফুলের টব হইতে শুরু করিয়া টয়লেটের হাই কমোড, যেকোন কিছুই থাকিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কোন বাছবিচার নাই...তুলিতে হইবে তো হইবেই। মানুষের চাহিদার শেষ নাই আবার চাহিদা উদ্রেককারী ব্যবসারও অভাব নাই! তৈরী হইয়া গেল সেলফি স্ট্যান্ড। ডান্ডার মাথায় মোবাইল আটকাইয়া কিছুটা দূর হইতে ছবি তোলা যাইবে, তবে কালো ডান্ডাখানা আবার ঠিকই ফ্রেমবন্দী হইবে...। সমস্যা নাই, আরেক কোম্পানি নিয়া আসিল ব্লুটুথ সুইচ; হাতে লইয়া টিপিলেই হইল!! আপনিও খুশি, ব্যবসায়ীও খুশি
কী মনে হইল কে জানে, জুতার মধ্যে ফোন রাখিয়াও আপনার সেলফি তোলা চাই...আর তাই আসিয়া গেল সেলফি জুতা
আপনি সেলফি ফিভারে আক্রান্ত একজন হইলে নিশ্চই আমার গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যাস্ত। তবে ভায়া জানিয়া রাখুন, আপনার এই যথেচ্ছ সেলফিচার আপনার জন্য মনঃপীড়ার কারন হইবে শীঘ্রই! গ্রীক মিথলজীর তরুন দেবতা নার্সিসাস নিজের সৌর্ন্দয্যের প্রতি এতই মোহমুগ্ধ ছিল যে, ঝিলের পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে পানিতে ডুবিয়া মরিয়া যায়। আর এ থেকেই এই প্রকারের সেলফ অবসেসনকে বলা হয় নার্সিসিজম। এর প্রভাবে আপনি ইতোমধ্যেই চরম অস্থির প্রকৃতির হইয়া উঠিয়াছেন। নিজেই ভাবিয়া দেখুন!
আপনি সাঁতার জানেন বিধায় ঝিলের পানিতে অকালে ডুবিয়া মরা আপনার কপালে নাই। কিন্তু আপনি মরিবেন আপনার মনের ঝিলে! মোবাইলে মেমরীর সংকট নাই, টিপিয়াই যাইতেছেন যতক্ষন না পর্যন্ত আপনার কাংখিত শটটি না মিলে। কিন্তু, নিশ্চিত থাকুন এভাবে ছবি তুলিলে কখনই আপনাকে সেরূপ লাগিবে না যা আপনি চান। কালেভাদ্রে শ'তে এক-দু'খানা হইলেও হইতে পারে। কিন্তু, এতে করিয়া যা হইবে তা হইলো প্রচ্ছন্ন একটি হতাশা আসিবে। "আমি কি সুন্দর না?, ও কি আমার থেকে বেশী সুন্দর? আমার কি নাই যা ওর আছে?"...ইত্যাদি ইত্যাদি! ভাবিবেন আর তুলিবেন, তুলিবেন আর ভাবিবেন। আর ঝড়ে বক মরিলে তো কথাই নাই আপনার তুলনামূলক কম কিম্ভূত ছবিতে লাইক দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া নিজেই তাকাইয়া থাকিবেন আর নিজেকে নার্সিসাস ভাবিবেন। আর এইসব ছবির সাবজেক্ট কেবলই আপনি। দশজনের গ্রুপে দশজন পৃথক-পৃথকভাবে সেলফিতে ব্যাস্ত। দশজনের একখানা গ্রুপছবির তেমন কোন প্রয়োজন বোধ হয় না। আমি থাকিলেই হইল, অন্যেরা থাকুক বা না থাকুক। আর এখানেই আপনি "আমরা" হইতে "আমি" হইয়া যাইবেন। সবার মাঝে থাকিয়াও বোধ করিবেন নিঃসঙ্গতা!
নিজের প্রায় একই ছবি একশবার তুলিয়া কি সুখ পাওয়া যায় তা আপনি নিজেই জানেন। পথে ঘাটে, নর্দমা-ড্রেনের পাশে, ফুটপাথে, চায়ের দোকানে সেলফি তুলিবার হেতু আমার অজানা। এই ছবি না আপনি সংরক্ষণ করিবেন, না প্রিন্ট করিবেন...শুধু শুধু আপলোড দিয়া আর্ন্তজাতিক ডাটা ট্রাফিকে বিঘ্ন সৃষ্টি করিবেন!
যাহা হউক, ছবি তুলুন, নিজের ছবি তুলুন, সুন্দর ছবি তুলুন...আর নিজেকে দেখিয়া মুগ্ধ না হইয়া আমাদেরকেও মুগ্ধ করুন