somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহাদ - আমার ড্রাইভার

২২ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কখনও ভাবিনি ওকে নিয়ে আমার লিখতে হবে! আর ভাববোই বা কেন - সবই তো ঠিকমত চলছিল...

হঠাৎ ১৬ মার্চ দুপুর তিনটার দিকে আমার স্ত্রী ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে "এই, আহাদ নাকি মারা গেছে...", "কে বলল", "জানি না, তুমি ওর নম্বরে ফোন করে দেখ..." ওর নম্বরে ফোন দিতেই অচেনা কন্ঠ শুনলাম। "এটা আহাদের নম্বর না?","জ্বি স্যার আহাদের নম্বর", "ও কোথায়, আপনি কে?","স্যার আমি ওর রুমমেট, ও তো আজকে সাড়ে বারটার দিকে মারা গেছে", "মারা গেছে মানে?", "স্ট্রোক করছিল...ঘরে বসে পেপার পড়তেছিল, ফোনে ওয়াইফের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়...ডাক্তার আনার পরে বলল মেডিকেলে নিয়ে যাইতে...আধাঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম...ডাক্তার বলল মারা গেছে...", "এখন কোথায় আপনারা", "আমরা চাষাড়া, ওর ভাই থাকে এখানে, ওকে নিয়ে আসছে, ওর বাবাও আছে সাথে..."

আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কি শুনছি! কিভাবে সম্ভব? মাত্র কিছুক্ষণ আগে নয়টার দিকে আমাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে গেল, তারপর আমার বউকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে আবার আমার অফিসে গাড়ি পার্ক করে গেল। নিচে নেমে দেখলাম গাড়িটা পার্ক করা আছে। ঠিক বিশ্বাস হল না। গত দু'বছর ধরে ও আমার গাড়ি চালাচ্ছে, তখনও অসুস্থতার জন্য ছুটি নিতে দেখিনি, আজকেও তো ঠিকমতই আসলো। মনে হল, ওর মোবাইল হয়তো চুরি হয়েছে, কেউ ফাজলামি করছে। আবার ফোন দিলাম, এবার ওর ভাইয়ের সাথে কথা হল। "আমরা তো ওকে দেখতে পারলাম না, আমি অফিস থেকে রওনা দিলেও তো দু-আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে চাষাড়া আসতে", "জ্বী স্যার আমরা তো পোস্তগোলা-মাওয়া দিয়ে বের হয়ে যাব", "তাহলে আর দেরি কইরেন না, রওনা হয়ে যান...পটুয়াখালী, বহু দূরের পথ"। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে অফিসের পার্কিংয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। সবকিছুই কেমন যেন শূণ্য লাগছিল! আমার বউকে জানালাম। ও বলল "কিভাবে সম্ভব? আমাকে সাড়ে নয়টার দিকে বনানী নামায় দিয়ে গেল, জ্যাম দেখে গাড়ি ঘুরালো, আমি সবসময় অফিসে ঢুকে যাই, আজকে না ঢুকে কি মনে করে যেন দেখছিলাম..."

আমি আবার ওর ভাইকে ফোন দিলাম, "কোথায় আপনারা?", "আমারা তো রওনা দিসি", এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শুনছিলাম। "ওর বাবা-মা জানে?", "আব্বা সাথেই আছে", "ওর বউয়ের কি অবস্থা?", "কি আর অবস্থা বলেন, ওর সাথেই তো কথা বলতে বলতেই তো চইলা গেল..."

আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করতেই ওর চেহারা ভেসে উঠছিল। নিতান্তই নিরীহ, মৃদুভাষী, বয়স বড়জোর ২৮ হবে। কারও সাথে আজ পর্যন্ত উচু গলায় কথা বলতে শুনি নি। আমাদের সাথে বেয়াদবী তো অনেক পরের ব্যাপার! রেগুলার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। গাড়ীর খুবই যত্ন করতো। আমাকে কখনও কিছু বলে করাতে হয় নি। দশ টাকা নিলেও বলে নিত। মাত্র কিছুদিন আগে জানুয়ারী মাসে বিয়ে করলো...। কোনদিন ডিউটিতে আসতে দেরী করতে দেখি নি। যতই মনে পড়ছে ততই কেমন যেন লাগছে! আবার নিচে নামলাম, তখন পাঁচটা বাজে। এর মধ্যেই ও গাড়ী নিয়ে আমার বউয়ের অফিসে চলে যেত। দেখলাম, গাড়ীটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে! ও আসে নি। ও আর আসবেও না...এই প্রথম আমার মনে হল আহাদ আসলেই আর বেঁচে নেই, ও মারা গেছে।

মনে পড়লো, প্রথম যেদিন এসেছিল, আমি ওকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেখালাম। গাড়ীটা কিভাবে চালাতে হবে, কি কি সমস্যা আছে। ও বুঝে গিয়েছিল, আর বোঝাতে হয় নি। "তোমার গাড়ি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তুমি শুধু যত্ন করে ধীরে সুস্থে গাড়ী চালাবা, ডিউটি খুবই কম, আমাকে আর মেডামকে অফিসে নামায় দিয়ে বাসায় গিয়ে রেস্ট করবা। সারাদিন কোন কাজ নাই, আবার বিকালে আসবা। গুলশান-ইস্কাটন এইটুক আপ-ডাউন।" আমাদের যেদিন বাবু হবে সেদিন ও নিজে থেকেই বলল "আমার রক্তের গ্রুপ এ+, আমি দিতে পারবো, আমি নিচেই আছি"। সেই আহাদ আজ আর নেই। কিছুদিন আগেই মগবাজার এগোরার সামনে পেট্রোল বোমায় এক অল্পবয়স্ক ড্রাইভার পুড়ে মারা গেল। আহাদকে বললাম, "সবসময় গাড়ীর গ্লাস তুলে রাখবা আর পার্কিং করলে গাড়ির ভিতরে থাকবা না"। আমার বউ একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার কিনে দিল। "চালাইতে পার?","জ্বী স্যার"। একমাস আগের কথা...ও কি জানতো, এক মাস পর ও আর থাকবে না? কয়েকদিন আগেই জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা লাইসেন্সের মেয়াদ আর কয়দিন? শেষ হবার আগে আগে রিনিউ করে নিও। বলল, আছে ১৭ পর্যন্ত, সমস্যা নেই। আমার বউকে পাশে বসিয়ে আমি ড্রাইভ করে বাসায় আসলাম। পুরোটা রাস্তা দুজনেই অঝোরে কাঁদলাম! এর বেশী আর কী-ই বা করতে পারি? আমার শাশুড়ীও শুনে চোখের জল আটকে রাখতে পারেন নি। উনি সব সময় ওকে নিজহাতে বেড়ে খাওয়াতেন। ও বাড়ী গেলে আবার আমার শাশুড়ীর জন্য নিজেদের গাছের সুপারি নিয়ে আসতো। জানুয়ারীতে ছুটি নিয়ে বাড়ী গেল। কয়েকদিন পরে জানালো, ওকে ওর বাবা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন, আসতে একটু দেরী হবে আর কিছু টাকা লাগবে। আমি টাকা বিকাশ করে দিলাম আর বলে দিলাম বেশী দেরী না করতে। বেচারা আমার কারনেই বোধহয় নববধুর সাথে আরও কিছু সময় বেশী কাটাতে পারলো না। এপ্রিলে আবার ছুটি চেয়েছিল। বললাম, সেকেন্ড উইকে যাও। পহেলা বইশাখ বউয়ের সাথে কাটাও। আহাদ বউয়ের সাথে থাকার জন্য বাসা খুঁজছিল। আমাদের বাসার পাশে একটা বাসাও দেখেছিল। মে তে বউকে ঢাকায় আনার কথা ছিল। আর কিছুই হল না। আমি কিছুতেই ওকে ভুলতে পারছিনা। রাতে স্বপ্নে দেখলাম, ও আবার আমার গাড়ী চালাচ্ছে। বললাম তুমি না মারা গেছ। না স্যার, মরার মত অবস্থা হইছিল, মরি নাই। বললাম, রোদে কম বের হবা, সবধানে থাকবা, অনেক গরম পড়ছে!

বিয়ের মাত্র দু'মাস সাত দিনের মাথায় আহাদ চলে গেল। নিশ্চই নতুন সংসার নিয়ে ওর অনেক পরিকল্পনা ছিল। কেমন চাদর কিনবে, কয়টা হাড়ি-পাতিল লাগবে, ঘরে একটা সুন্দর পর্দা্ও লাগবে। ওর বউয়েরও নিশ্চই ভাবনা ছিল। আমার মেয়ে বড় হলে তাকে নিয়ে সে স্কুলে যাবার কথাও বলেছিল। কিছুই হল না! জানলাম, ওর বিয়ে যে কাজী পড়িয়েছিল, সে-ই আবার তার জানাজা পড়িয়েছে। তিনগ্রামের লোক এসেছিল ওর জানাজা-কুলখানিতে। সবারই এক কথা, ওর মত ছেলে এই গ্রামে হাজারে একটা হয় না। কিন্তু, পৃথিবীতে কিছুদিন থাকা হল। গতকাল ওর শ্বশুরের সাথে কথা হল, শুধুই আফসোস করছেন, "এত ভাল একটা ছেলেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আহারে, আমার আব্বার সাথে এগারোটা বাজেও কথা বললাম...। আমার আব্বাটা তাহাজ্জুদের নামাজও পড়তো...আহারে আমার আব্বা!" আমি নির্বাক শুনি।

ওর এই অকাল মৃত্যু আমাকে দেখিয়ে দিল, জীবন সুন্দর নয়-অসুন্দরও নয়, সহজও নয় আবার কঠিনও নয় বা জীবন জীবনের মত-তা-ও নয়...জীবন আসলে ক্ষুদ্র-অতিক্ষুদ্র। ওকে আমি ভুলে যাব, সময়ই ভুলিয়ে দেবে। ওর কোন চিহ্নও পৃথিবীতে থাকবে না...একটা সময় পরে কেউ আর শোক করবে না। কিন্তু ওর স্ত্রী, যে কিনা সংসার শুরুর আগের স্বামীহারা হল, আহাদের বাবা-মা যারা ওর কফিন বইলো...তারা মনে রাখবে। উড়ে যাওয়া পাখীর ঝরা পালকের মত ওর ড্রাইভিং লাইসেন্সটা আমার গাড়ীতে রয়ে গেছে, ১৭ তে যার মেয়াদ শেষ হবে - ওর মেয়াদ তার আগেই শেষ হয়ে গেল! পৃথিবীর অনেক সুন্দর-ভাল না দেখেই গেল আহাদ - আমার ড্রাইভার।

নাজিম হিকমাতের কবিতাটি যেন ওরই জন্য লেখাঃ
যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলি নি।


পরম করুনাময় আল্লাহ যেন তাঁর করুনাধারার শীতল ছায়ায় আহাদের আশ্রয় দেন।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:৪৬
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×