আটটার দিকে ফোন এসেছিল প্রকাশক সাহেবের। প্রথমে ধরতে পারিনি। ব্যাক করলাম একটু পর। আদী প্রকাশনের কর্ণধার সাজিদ ভাইকে মহা আনন্দিত মনে হল। বাহিরে থাকার কারণে ঠিক স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না। সম্ভবত কোনো সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। সেটার কথাই বলছিলেন। আমি বার কয়েক জিজ্ঞেস করেও যখন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে কিসের সদস্য হয়েছেন তখন কেবল হু হা করে যাচ্ছিলাম। সরাসরি কংগ্রেটস জানাতেও বাধছিল। কারণ শিওর না হয়ে কিছু বলা মুশকিল। দেখা গেল তিনি বরাবরের মত হতাশার সুরে বলছেন, মারা খা সংগঠনের সদস্যতা পদ লাভ করেছি ভাই!
এবং উত্তরে যদি কংগ্রেটস জানাই, তাহলে বিষয়টার ভয়াবহতা অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়াবে। তাই চুপ চাপ শুনে যাচ্ছিলাম। তবে যা বুঝেছি, ভদ্রলোক বহু কষ্টে কিছুর মেম্বারশিপ পেয়েছেন। শুনে ভাল লাগলো। কারণ সারা বছরে সাজিদ ভাইয়ের ফোন মানে হা হুতাশ ছাড়া আর কিছু নেই। সামনে বই মেলা, উনার হা হুতাশ যদি একটু কমে!
তবে ফোন দিয়ে লাভ হয়েছে। তিনি উৎফুল্ল স্বরে জানালেন, "আপনার অমিয়েত্রা কি বাজারে ছেড়ে দেবো ভাই? বই তো বেরিয়ে গেছে। বইমেলার অপেক্ষা করবেন? নাকি আগেই দিয়ে দিবো?"
জিইসি'র ব্যাস্ত কোলাহল আর মানুষের ভিড়ের মাঝে হাঁটছিলাম। সামান্য অন্যমনস্কও ছিলাম বোধহয়। সাজিদ ভাইয়ের কথাটা শোনার পর সূক্ষ্ম একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। নিচু স্বরে কেবল উত্তর দিলাম, "আলহামদুলিল্লাহ্। শুনে অনেক ভাল লাগছে। আপনার ইচ্ছা। যেভাবে ভাল মনে হয় সেভাবেই চালান। আর বইমেলাতে তো আমি আসছিই বেঁচে থাকলে......... স্টলের কি অবস্থা ভাই?"
সাজিদ ভাই বোধহয় মহা আনন্দিত আজ। ওনাকে খুব কমই আনন্দিত দেখা যায়। বেশিরভাগ সময়েই অসুখি মানুষ মনে হয়। সন্তুষ্ট হতে পারেন না কিছু নিয়ে। তিনি হড়বড়িয়ে বলে যাচ্ছেন, "এপ্লিকেশন করা শেষ। ইনশাআল্লাহ্ গতবারের মত এবারেও পেয়ে যাবো। শিহাব ভাই, আপনি না দেখলে বুঝবেন না। বইটা খালি এবারে হাতে নিয়ে দেখিয়েন। জাস্ট অসাধারণ হয়েছে। দারুণ বাধাই, কাগজ, লেমিনেটিং। সব!"
আমি স্মিত হাসলাম কেবল, "পারলে দুই কপি বই পাঠিয়ে দিয়েন আমাকে। যদিও অনেক ব্যস্ত থাকেন। তাও বললাম। আর একটা রিকোয়েস্ট, নাজিম উদ দৌলা ভাইয়ের 'ইনকারনেশন' বইটা এক কপি পাঠাবেন প্লিজ। আমি কিনবো।"
"মুরাদ ভাইয়ের কাফকা ক্লাবও নেন ভাই। অসাম এক পিস! শিওর মজা পাবেন।"
"আচ্ছা ঠিক আছে। কাফকা ক্লাব আর ইনকারনেশন এক কপি করে পাঠিয়ে দেবেন। আমি পে করে দেবো।"
আরো খানিকটা কথা হয়েছিল ফোনে, খেয়াল নেই সবটা। হাঁটছিলাম। উনি জানালেন আগামী বুধ-বৃহস্পতিবার অমিয়েত্রা সহ বাকি বইগুলো পাঠিয়ে দেবেন আমাকে। ফোনের লাইন কেটে আবার হাঁটতে লাগলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সন্ধ্যার জিইসিটা দেখতে কেমন অদ্ভূত লাগে আমার কাছে।
বছর খানেক আগে হতাশাগ্রস্থ একজন লেখক ইন্টারনেটে কয়েক লাইনে একটা আক্ষেপের কথা লিখেছিল।
"বাংলাদেশের প্রকাশকেরা বইয়ের পৃষ্ঠাগুণে বই প্রকাশ করে। একজন লেখকের লেখার প্রতি মমতা বা ভালবাসা কারো চোখে আসবে না। অমিয়েন্দ্র-অমিয়েত্রা অপ্রকাশিত থেকে যাবে হয়তো।"
লাইনগুলো লেখার পেছনে একটা কারণও ছিল। কারণ লেখকের অবসরপ্রাপ্ত বাবা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রকাশনীগুলোতে ঘুরে ঘুরেও পুত্রের অমিয়েন্দ্র নামের একটা উপন্যাস প্রকাশ করাতে পারেননি। হতাশ মুখে প্রতিবারই ঢাকা থেকে ফিরে আসতেন, এবং ঘরে ঢুকেই উজ্জ্বল মুখে বলে উঠতেন, "পুত্তর! চিন্তার কুনো কারণ নাই! ইনশাআল্লাহ্, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অমুক প্রকাশক তোমার বই পড়ে বড়ই প্রশংসা করেছে। সে বলেছে জানাবে। নাম্বার নিয়েছে আমার।"
লেখকের পিতার কাছে কোনো ফোন আসেনি কোনো প্রকাশকের। পিতা ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন নীরবে। পুত্রের সামনে বহুদিন আর যাননি। গর্ব করে বলেননি যে বই বের করার ব্যবস্থা করে দেবেন। আম্মা কেবল আশার বাণী শোনাতেন, "সময় হলে আল্লাহ্ একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেবে। তুমি লেখা ছাড়বে না। যত বড় বই'ই হোক, নিশ্চয় কেউ না কেউ তোমার বই বের করবে। যোগ্যতা থাকলে কাউকে ধরতে হয় না শিহাব।"
আমি হাসতাম কেবল। আমার খারাপ লাগতো প্রতিদিন। কারণ আমি হারতাম না, নীরবে শুধু তাদের দুজনকে হেরে যেতে দেখতাম। আমি কাউকে ধরতে জানি না, কাউকে সাধতেও জানি না। আমাকে দিয়ে হয়নি কখনো। এটাই আমার ব্যর্থতা। হোক, সমস্যা নেই। কে জানে, সত্যিই হয়তো একদিন অমিয়েন্দ্র-অমিয়েত্রা বের হবে। যিনি লেখার ক্ষমতা দিয়েছেন, বিকাশের দায়িত্ব তার, আমার না।
কি মনে করে যেন আবার ফোন ঘোরালাম সাজিদ ভাইকে, "সাজিদ ভাই?"
উনি আজ মহা আনন্দের মুডে আছেন বোঝা যাচ্ছে, "জ্বি ভাই?"
"বইটায় আপনি আর ভাবী কিছু লিখে দেবেন।"
"জ্বি ভাই! দেবো।" হাসলেন তিনি। হয়তো মানুষের ছেলেমানুষি দেখে বড়রা যেমন হাসে, হাসিটা সেরকম। সমস্যা নেই। লেখক আর প্রকাশকদের সম্পর্ক অনেকটা মানসিক রোগী আর নিরাপরাধ ডাক্তারের মত। লেখকেরা হচ্ছে উৎপাদনশীল মানসিক রোগী গোষ্ঠী, এবং প্রকাশকেরা নির্দোষ ডাক্তার। লেখকেরা ফান করলেও প্রকাশকদের যেমন অতিষ্ট হতে নেই, প্রকাশকেরাও যদি বিজ্ঞের মত হাসি হাসেন- লেখকদের কিছু যায় আসে না। দে বোথ ডিজার্ভ থ্যাঙ্কস টু ইচ আদারস্। আমার মতে প্রকাশকদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বিশাল একটা পার্থক্য রয়েছে। The people who works really hard to make the dream come true of a Rhymester as Author- is a Publisher. Also he must act as the Conveyer of current literature to the thirsty people of cognition.
নিজের কথা উহ্য রেখেই বলি, আদী প্রকাশনের প্রতি অনুরোধ থাকবে ইচ্ছার সঙ্গে নিয়ত ঝুঝতে থাকা সেই সব লেখকদের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য, যাদের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ের সাহিত্যকে শক্ত একটা অবস্থানে পৌছে দেয়া সম্ভব। সাহিত্যের সংজ্ঞা প্রতি নিয়তই বদলে যাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন শাখা প্রশাখা, বিভাগ। নতুন নতুন চিন্তা আর অসাধারণ সব প্লট নিয়ে এই শহরের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকা সেই সব লেখক, কবি বা সাহিত্যিকদের চেষ্টাকে সর্বস্তরে পৌছে দেয়ার জন্য যথার্থ পেট্রোনাইজেশন আদী করে আসছে, ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যহত থাকুক, এই কামনা করি।
সংক্ষেপে বৃত্তান্ত-
বইয়ের নামঃ অমিয়েত্রা
লেখকঃ মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব
প্রকাশনাঃ আদী প্রকাশন
ক্যাটাগরিঃ উপন্যাস
জেনারঃ প্যারানরমাল-ফিকশন
মূল্যঃ ৪০০ টাকা (২৫% ডিসকাউন্টে ৩০০ টাকা)
ফেসবুক পেজঃ অমিয়েত্রা
রকমারীতে অর্ডার লিংকঃ অমিয়েত্রা অনলাইনে অর্ডার করুন
এছাড়াও বুকস্ট্রিট তো আছেই।
মেলায় আদীর স্টল নাম্বারঃ ২৬৪
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:১৫