somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চতুরঙ্গ – দ্বিতীয় পর্ব

১৮ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চতুরঙ্গ – প্রথম পর্ব
“ আলু-ছিলে-ছুইন...... না, কি একটা বল না? কি ওটা?” জাহিদ মাথা চুলকালো।
“ হ্যালুসিন্যাসন?” তাকালাম ওর দিকে।
“ হ্যা! ওইটা! ওটা দেখেছো।” যেন বিশাল এক আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন ভাবে রায় দিল।
“ রাম ছাগল। হ্যালুসিন্যাসন ছাড়া আর কোনো যুক্তি কি মাথায় আসে না? ভিজুয়্যাল আর অডিটরি- দুই হ্যালুসিন্যাসন এক সাথে হয়েছে আমার?”
“ এর থেকে ভাল কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলাম না। আমার স্বল্প বুদ্ধিতে আলু ছিলে ছুইন-ই বড় ব্যাখ্যা। তুমি আলু ছিলার সময় ডাঃ এমরানকে দেখেছো তিনি হুইল চেয়ার ছাড়াই দাঁড়িয়ে উলটো ভাবে ছাদ থেকে ঝুলে ঝুলে নামায পড়ছেন।” উদাস ভাবে গাছের গায়ে হেলান দিল। বসেছি পার্কের একটা গাছের নিচে।
গত রাতের ঘটনাটা কাউকে বলতে না পেরে জাহিদকে বলার জন্য ডেকে এনেছি। কিন্তু ছাগলটা তার হাটুর মগজ দিয়ে চিন্তা করা শুরু করেছে।
বিরক্ত গলায় বললাম, “ রাখো তো! তোমার সব কিছু নিয়ে ফাজলামি! আমার হয়েছে আমি বুঝেছি, তুমি হলে বুঝতে কেমন লাগে।” কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম দু’জনে। তারপর আবার বলে উঠলাম, “ একটা ব্যাপার জানো- উনি নাকি কখনো দাবায় হারেননি তোরাব আলী মারা যাবার পর থেকে।”
“ তাই নাকি! দুই দান খেলা দরকার তো তাহলে! আমিও জীবনে কখনো হারি নাই এই খেলায়। অবশ্য দাবাই খেলি নাই এখনো, তাই হারার সুযোগ হয় নাই!”
“ ধুর! তোমার সাথে কথা বলাটাই আমার ভূল হয়েছে!” রাগ লাগলো।
জাহিদ উদার ভাবে হাসতে লাগল, “ হয়েছে বাবা! এখন মাফ কর। এই উদ্ভূট্টু কান্ড কারখানা শুনে দিনের বেলাতেই হাটুতে নোকিয়া ভাইব্রেশন ধরেছে, রাতের বেলা ঘুম হারাম হবে। এখন সাবজেক্টটা বাদ দাও। আসো, প্রেমালাপ করি বেগাম।” হঠাৎ যেন মনে পরতেই বলে উঠলো, “ ওউ! তোমাকে তো শুভ সংবাদটা দিতেই ভূলে গেছি বেগাম! শুভ সংবাদটা হল গিয়ে – আমার টিউশ্যনিটা চলে গেছে।”
“ কি! এটাও?” আৎকে উঠলাম। “ কি ছাত্র পড়াও যে টিউশ্যনি চলে যায়?”
“ আমার মত ছাত্র আর কি। যারা সারা বছর ফেল মেরে বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হয়, কিন্তু এভারেজে গিয়ে প্রমশন জোটে না।” উদাস মুখে আমার দিকে তাকাল।
“ চাকরি বাকরি ধরবে? নাকি গাছ তলায় সংসার পাতবে বলে ঠিক করেছো?” বিরক্ত হলাম।
জাহিদ গাছটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “ খারাপ বল নাই তো! সংসার পাতার জন্য গাছতলাই উত্তম। যাও সপ্তাহে তিন দিন মশারী আমি লাগায় দিবো। বাকি কয়দিন তোমার পালা।”
“ উফ! অসহ্য!” রাগতে গিয়েও হেসে ফেললাম শেষ মুহূর্তে। জাহিদও হাসতে লাগল। ও হাসলে ওর চোখে পানি চলে আসে। খুব মায়া লাগে কেন জানি তখন।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

সে রাতের ঘটনার কথা অবশ্য ডাঃ এমরানকে জিজ্ঞেস করলাম না। জাহিদের সাথে কথা বলার পর নিজের ভেতরেই সন্দেহ হচ্ছে – কে জানে হয়ত চোখের ধাঁধাঁ ছিল পুরো ব্যাপারটা। দিনের আলোতে পুরো ঘটনাটা অবাস্তব লাগল যত বার ভাবলাম। শেষে বেশি চিন্তা করা বাদ দিয়ে কাজে মন দিলাম। ডাঃ এমরান আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলেন। আমি প্রতিদিন তাঁর মিউজিয়াম কাম বাড়িতে যাই। মাঝে মাঝে দু চার জন বিদেশী পর্যটক আসেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ শালা দেখতে। ডাঃ এমরান মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে দেখান। কখনো আমি। কেউ কেউ বই লেখার জন্য এখান কার অ্যানটিক্সের সম্পর্কে জানতে এলে আমি নয়ত ডাঃ এমরান ছোট খাট ক্লাস নিয়ে ফেলি। প্রায় সময় নানান স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র ছাত্রীরা আসে তাঁর মিউজিয়াম দেখতে। ডাঃ এমরান তখন মহা উৎসাহ নিয়ে তাদের সব ঘুরিয়ে দেখান। নানান গল্প শোনান কোথায়, কিভাবে এসব পেয়েছেন। শুনতে ভালই লাগে। শিক্ষক হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কারণ হঠাৎ হঠাৎ উনি আমার কার্ড একজাম নেয়ার মত করে প্রশ্ন করা শুরু করেন। শুরুতে সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরে বুঝে গিয়েছিলাম উনি কেন এটা করেন। আমি হাসপাতাল, প্র্যাক্টিস সব বাদ দিয়ে তাঁর সাথে পড়ে আছি এটা তাঁকে খুব বিব্রত করত। তাই নিজের জ্ঞান দিয়ে আমার জ্ঞানটাকে ঝালিয়ে নিতেন। যাতে আমি আবার চার্চার অভাবে সব ভূলে না যাই। তাঁর একরকম জোর পূর্বক জারি করা আইনের ফাঁদে পরে আমাকে সপ্তাহে দুই দিন তাঁর নিজের দেয়া নতুন হাসপাতালটায় গিয়ে রোগী দেখে আসতে হত। তাঁর বদ্ধমূল ধারনা আমি তাঁর সাথে থেকে থেকে সব ভূলে যাচ্ছি এত দিন যা শিখেছি। কিন্তু ওনাকে এটা বোঝাতে পারিনি ওনার এহেন আইটেম, কার্ড, প্রফ লেগে থাকলে কারো পক্ষে একটা চ্যাপ্টারও ভোলা সম্ভব না।
মাঝে মাঝে মিউজিয়ামে নানান জায়গা থেকে মালপত্র আসে। ডাঃ এমরানের কথা মত আমাকে প্রায়ই অনেক জায়গায় গিয়ে নিলাম থেকে অনেক জিনিস কিনে আনতে হয়। ব্যাপারটা দারুন লাগে। প্রথম প্রথম উনি আমাকে নিয়ে যেতেন কিভাবে নিলাম থেকে কিনতে হয় শেখাতে। এখন আমি একাই যাই। উনি বলে রাখেন কত থেকে কত’র মধে্য হলে কিনবো। আমি সে রকমই করি। খুব অল্প দিনে বেশ কয়েকটা দেশ ঘোরা হয়ে গেল ডাঃ এমরানের সঙ্গে। কখনো বা কুরিয়ারে অ্যানটিক্স এলে আমাকে মালপত্র মিলিয়ে রাখতে হয়। এভাবেই বেশ নির্বিঘ্নে কেটে গেল দুই মাস। কাজটার প্রতি কেমন যেন নেশা ধরে গেল। ডাঃ এমরান প্রতি মাসের প্রথম দিন একটা সাদা খামে আমার সেলারী তুলে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না চোখ কপালে ওঠার মত মতই টাকার অংক। যে কোনো হাসপাতাল থেকে তিন গুণ বেশিই দিচ্ছেন আমাকে। জাহিদ তো প্রথম মাসের টাকা দেখেই শিস দিয়ে উঠেছে, “ তোমার চাকরিটা আমাকে দিয়ে দেও বেগাম। তোমার এত কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না। মাস শেষে যে টাকা দিতেছে- আমারে দশ বার ধোলাই খালে বেঁচলেও আসবে না! আমি বেকার পোলা, একটা চাকরি ধরায় দেও ওই বাড়িতে। মালি হলেও চলবে।”
কাজের প্রতি অনিহা কখনই ছিল না আমার। তার ওপর ডাঃ এমরানের দেয়া এত সব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পর কাজের প্রতি একটা দায়ভারও জন্ম নিলো। গত কয়েকদিন হল ডাঃ এমরান একটা অক্টোপাস কিনেছেন। মিউজিয়ামের হল রুমটা মোড় নিয়েছে এদিক সেদিক। একটা অংশে বিশাল এক ইনডোর সুইমিং পুল। যদিও এখন কেউ নামে না সেখানে। ওখানেই অক্টোপাসটাকে রাখার ব্যবস্থা করেছি আমি। সাইড গুলো উঁচু রেলিং দিয়ে ইলেক্ট্রিফায়েড করা। যাতে অক্টোপাসটা উঠে আসতে না পারে। ডাঃ এমরান প্রায়ই এখানে এসে সময় কাটান। একা থাকেন বেশির ভাগ সময়। মাঝে মধ্যে আমার ভাইবা নেয়া ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথাই বলেন না দিনের পর দিন।
উনি তাঁর স্ত্রী জয়নাব আরার প্রতি ভীষণ দূর্বল ছিলেন সেটা বুঝতে পারলাম দু মাসের মাথায় এসে। সেদিন রাতে আমি চেক আপ শেষে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো- এমন সময় হ্যান্ড ব্যাগের ধাক্কা লেগে দরজার পাশে ঝোলানো একটা বিরাট ঝিনুকের ডোরবেল মাটিতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় আৎকে উঠি। কিন্তু আমার থেকে শত গুণ বেশি আহত হলেন ডাঃ এমরান। বিছানায় শুয়েই পাগলের মত বলে উঠলেন, “ হায় হায়! এটা কি করলে তুমি? ওটা জয়নাবের কত পছন্দের ছিল জানো? ও নিজ হাতে ওখানে লাগিয়েছিল ডোর বেলটা।” কান্না সামলাতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
আমি অপ্রস্তুত ভাবে বললাম, “ আ-আমি ইচ্ছা করে করিনি স্যার...... আমি খুবই স্যরি......” কি করবো বুঝতে পারলাম না। তাকিয়ে দেখলাম তিনি বিছানার কিনারে হেচড়ে চলে এসেছেন মরিয়া হয়ে। বিছানা থেকে ঝুঁকে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ঝিনুকের একটা টুকরা তুলে নিলেন। চোখে ভূলও দেখতে পারি- এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল তাঁর গাল বেয়ে। আমি অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
ডাঃ এমরান সঙ্গে সঙ্গে খুব অসুস্থ হয়ে পরলেন। এভাবে হুট করে অসুস্থ হয়ে পরবেন কল্পনাও করিনি। দেখতে দেখতে জ্বর উঠে গেল একশো তিন ডিগ্রী। কাঁপতে লাগলেন বিছানায় শুয়ে। আমার বাসায় যাওয়া হল না। থেকে যেতে হল। ওনার এ অবস্থায় বাসায় যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জ্বরের ঘোরে উনি বারবার বলতে লাগলেন, “ তুমি এখনি বাসায় চলে যাও। আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু সেটা আমি করতে পারি না। থেকে গেলাম। খারাপ লাগছিল খুব ওনার জন্য। আমার কারণে হল এসব।
রাত দু’টার দিকে ওনার জ্বর আরো বাড়ল। আমি উপায় না দেখে হল রুমে নেমে এলাম, হাসপাতালে ফোন করা দরকার। এখানেই শুধু ফোন রাখা। ডাঃ এমরান ফোনের শব্দ একেবারেই সহ্য করতে পারেন না বলে তাঁর ঘরে ফোন নেই।
আমি হল রুমে আসা মাত্র বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ করেই প্রচন্ড ঘুম এসে ভর করল আমার দু চোখে। মাতালের মত টলতে লাগলাম। টেলিফোন পর্যন্ত পৌছাতে পারলাম না। সফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম মুহূর্তের মধ্যে.........

চোখ মেলার পর বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। ঘুমিয়ে ছিলাম তো সোফার ওপর। কিন্তু এখন শক্ত কোথাও শুয়ে আছি। চোখ কোচলে উঠে বসলাম। ফ্লোরে বসে আছি। আবছা অন্ধকারে বেশ অবাক হলাম। সোফা থেকে পড়ে গেলে তো নরম-গোড়ালি ডুবে যাওয়া কার্পেটের ওপর পড়তাম। কিন্তু যেখানে আছি সেটা টাইলসের মত ফ্লোর। অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকালাম। ধীরে ধীরে চোখে অন্ধকার সয়ে এল। চমকে উঠলাম। বিশাল কোনো দাবার বোর্ডে বসে আছি আমি! বিরাট বিরাট সব সাদা কালো দাবার ঘর, আমার চারপাশে আধো অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে বর্ম পরা অনেক গুলো মূর্তি! নড়ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে এখনি নড়ে উঠবে। আমি টের পেলাম আমার দু কানের পাশ দিয়ে যেন আগুণের হল্কা ছুটে গেল। উষ্ণ রক্তের একটা স্রোত বয়ে গেল মাথা থেকে পায়ের দিকে। আমি কম্পিত মুখে ধীরে ধীরে মাথার ওপরের দিকে তাকাতেই তীব্র একটা ভয় চেপে ধরল আমাকে! আমার মাথার ওপর দিকে ডাঃ এমরানের সেই হল রুম, হাজার হাজার অ্যানটিক্স আর বিশাল বিশাল বুক শেলফ! আমি ছাদ থেকে উল্টো হয়ে ঝুলে আছি! নিজের অজান্তেই একটা চিৎকার দিয়ে উঠে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু দৌড়ে কোথায় যাবো? মাটিতে একটা মানুষ যে ভাবে দৌড়ায়- আমি সেভাবে ছাদময় দৌড়াচ্ছি! আমার মধ্যাকর্ষন বল যেন ছাদের দিকে! ভয়ার্ত চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ডাঃ এমরানের পুরো মিউজিয়ামের হাজার হাজার জিনিস পত্র উড়ে ছুটে আসছে এই বিশাল দাবার বোর্ডের দিকে! যেন এই বিশাল বাড়িটাকে কেউ উল্টো করে বসিয়ে দিয়েছে। ছাদ নিচে, ফ্লোর ওপরে! ফ্লোরের দিক থেকে ছুটে আসা জিনিস পত্র গুলো বৃষ্টির মত আমার চারপাশে আছড়ে পড়া শুরু করল। প্রচন্ড শব্দ করে কাঁচের জিনিস গুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হতে থাকল। লাইব্রেরীর বই গুলো শেল্ফ থেকে উড়ে এসে পড়তে লাগল মূর্তি গুলোর ওপর। আমি আতংকে দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগলাম। আমার গায়েও এসে পড়ল দু একটা অ্যানটিক্স। তবে খুব ভারী না হওয়ায় বেশি কিছু হল না, কেবল ব্যথা পেয়ে পড়ে গেলাম। আবারও হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পাগলের মত ছাদময় দৌড়ে বেরাতে লাগলাম। ডাঃ এমরানের হল রুমটা কয়েকটা বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে। ছাদটাও তাই। আমি বাঁক গুলো হয়ে হল রুমের অন্য দিকে ছুটলাম। হল রুমের কয়েকটা মোড় ঘুরতেই বিশাল ইনডোর সুইমিং পুলটা। যেখানে অক্টোপাসটা পোষেন ডাঃ এমরান। আমি বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে দেখলাম সুইমিং পুলের পানি সোজা উড়ে আসছে দাবার বোর্ডের দিকে! ছাদের এ অংশে মূর্তির ঘনত্ব বেশি। মূর্তি গুলোর ওপর রীতিমত সমুদ্রের গর্জন হেনে আছড়ে পড়ল সুইমিং পুলের টন খানেক পানি! পানির তোড়ে আমি খড় কুটোর মত ছিটকে গেলাম একদিকে! ভেসে যেতে যেতে একটা মূর্তির পা ধরে আটকে ফেললাম নিজেকে। আতংকিত হয়ে দেখলাম বিশাল মাকড়শার মত অক্টোপাসটাও উড়ে নেমে আসছে ছাদের দিকে! আমার নাকে মুখে পানি ঢুকেছে। বেদম জোরে কাঁশতে কাঁশতে উঠে দৌড়াতে লাগলাম। টাইলসে পানি পড়ায় পা পিছলে গেল হঠাৎ। দড়াম করে আছাড় খেতেই মাথার একপাশে একটা ভয়ংকর বাড়ি খেলাম। তীব্র যন্ত্রণায় কোনো শব্দই বেরুল না মুখ দিয়ে। জ্ঞান হারালাম।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে আমার।
জ্ঞান ফিরে চোখ মেলতে জাহিদের মুখটা চোখে পড়ল। উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে ছিল, আমাকে চোখ খুলতে দেখেই দাঁত বের করে হাসল, “ এখন কেমন আছো বেগাম?”
আমি সামান্য নড়াতেই মাথার একপাশে তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করলাম। মাথাটা যেন ছিঁড়েই যাবে! ব্যথায় মুখ বাঁকিয়ে ফেললাম, “ উফ! মাথাটা শেষ! ফেটে চার টুকরা হয়ে গেছে!”
“ সমস্যা নেই। ডাক্তারেরা সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। এখন রোদে শুকাতে হবে। আর বলেছে এরপর যেন আর সোফায় শুয়ে ঘুমালে যেন সিট বেল্ট বেঁধে দেয়া হয়। তুমি তো ট্রাক ড্রাইভারের মত সোফায় ঘুমাও। ওখান থেকে পড়েই এই অবস্থা। আল্লায় বাঁচাইছে আরেকটু ওপর থেকে পড়ো নাই!”
আমি দূর্বল গলায় বললাম, “ আমি সোফা থেকে পড়িনি জাহিদ। পা পিছলে ছাদে পড়েছি। আমি চার তলা উঁচু ছাদের সেই দাবার বোর্ডে ছিলাম উল্টো ভাবে।”
জাহিদের মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল। থমথমে মুখে বলল, “ ডাক্তার মাথাটা জোড়া দেয়ার সময় নাট-বল্টু যে খুলে রেখে দেবে ভাবিনি। এতদিন জানতাম টি.ভি. মেকানিকরা এই কাজ করে। ডাক্তাররাও যে করে এই প্রথম জানলাম।” ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল, “ তুমি ঘুমাবার চেষ্টা কর। নড়া চড়া একদম করবে না। আমি আছি এখানে।”
আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না আমি এখানে কিভাবে এলাম? ডাঃ এমরান কি জানেন আমার এ অবস্থা কিভাবে হয়েছে? আর তিনিই বা কেমন আছেন এখন?

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ডাঃ এমরানের মিউজিয়ামের অবস্থা কি হয়েছে সেটা দেখতে যাওয়ার মত সুস্থ হতে হতে দশ দিন লেগে গেল। শুনলাম তিনি নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই কথা হয়নি। জাহিদের সঙ্গেই তাঁর আলাপ হয়েছে। অনেক্ষণ কথা বলেছে তারা শুনলাম মিথিলার কাছে। জাহিদ যে কি এত বকবক করতে পারে বুঝি না! হাসপাতালে এ কয়দিন জাহিদ, খালা আর মিথিলা ছিল আমার সঙ্গে প্রায় সারাক্ষণ। জাহিদের স্বরচিত অখাদ্য কবিতা শুনে শুনে কানের পোঁকা বেরিয়ে যাবে এমন যখন অবস্থা- তখন হাসপাতাল থেকে ডিকসাস করে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কাজে ফেরার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম।
মিথিলা ব্যাগ গোছাচ্ছিল হাসপাতাল ছাড়ার আগে। আমি জামা পালতে সবে ওড়না দিয়েছি, এমন সময় কেবিনের দরজায় নক করার শব্দ হল। ফিরে তাকালাম।
“ কে?” মিথিলা জিজ্ঞেস করল।
“ ছোট বেগাম, আমি।” জাহিদের গলা শোনা গেল।
“ ও, ভাইয়া ভেতরে এসো।” গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে এসে মিথিলা ব্যাগ গোছানয় মন দিল। জাহিদ দরজা খুলে মুখ ঢুকিয়ে উঁকি দিল। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিল, “ ডার্লিং ভাল আছো?”
“ ভেতরে ঢোকো।” হাত নেড়ে বললাম।
“ উঁহু! চোক্ষু বন্ধ করো গো বেগাম! সারপ্রাইজ গিফট এনেছি তোমার লাগি।”
“ তোমার এত ঢং করার এনার্জি আসে কোত্থেকে?” বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালাম। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ খুলে মিথিলার দিকে তাকালাম, মিটিমিটি হাসছে, মুখে হাত চেপে হাসি আটকাবার চেষ্টা করছে। ধমক দিলাম আমি, “ হাসবি না ফ্যাঁক ফ্যাঁক করে।” আবার চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালাম।
শুনলাম জাহিদ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আমার সামনে এসে বোধ হয় হাটু গেড়ে বসল।
“ বেগাম, তোমার জন্য দুনিয়া তন্য তন্য করে একশো আটটা নীল পদ্ম না আনতে পারি। এই অধম প্রেমিক তার নতুন টিউশ্যনির জোরে একশো আটটা সিঙ্গারা ঠিকি আনতে পেরেছে! চোখ খুলো বেগাম, দেখে ধন্য হও!”
আমি চোখ খুলে ছানা বাড়া হয়ে গেলাম। জাহিদ বড় একটা কাটুনে করে একগাদা সিঙ্গারা নিয়ে এসেছে! গরম সিঙ্গারার ঘ্রানে কেবিনের বাতাস মোঁ মোঁ করছে!
দাড়াজ হাসি হেসে বলল জাহিদ, “ একটা কবিতাও লিখেছি বেগাম। তোমার শুভ মুক্তি উপলক্ষে – ” কেঁশে গলা পরিষ্কার করল –

“ মনে পড়ে আমার দিকে
তাকিয়ে ছিলে ভীরু চোখে?
প্রহর শুরুর ক্ষুদ্র ক্ষণে
স্বপ্ন দেখা সপ্তালোকে?
পথটা যখন শুরুয় ছিল
রঙ্গিন নেশায় ভোর,
তোমার কোমল ভালবাসার
পাইনি সে আদর।
বেলায় কেবল অল্প করে
লাগত রঙের টান,
দূর বহুক্ষণ প্রত্যাশাতেই
প্রেমের আহবান।
প্রহর শেষে তোমার কাছে
এসেছি আজ তাই,
পথের শুরুয় পাইনি তো কি?
পথের শেষে চাই!”

ভ্রুঁ নাচাল, “ কেমন হয়েছে বেগাম?”
আমি কিছু বলার আগেই মিথিলা জোরে হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল, “ ওয়াও জিজু! চো চুইট! ইস ক্যামেরা থাকলে ভিডিও করতাম।”
ওর দিকে তাকিয়ে এক হাতে বাক্সটা ধরে বাউ করার মত করল জাহিদ, “ শুকরিয়া, শুকরিয়া ছোট বেগাম!”
আমি কোমরে দু হাত দিয়ে নাকের পাটা ফুলিয়ে বললাম, “ এই টন খানেক সিঙ্গারা কে খাবে? টাকা হাতে পেলে ওড়াতে ইচ্ছা করে? ভাল একটা শার্ট কিনতে পারো না? একটা নীল শার্টে কি দশ বছর চালাবে?”
বিন্দু মাত্র মলিন হল না জাহিদের হাসি, “ ওটা যৌতুকের খাতায় জমা আছে। বিয়ের আগে এই এক শার্টে পার করে দেবো।” বাক্সটা হাতে উঠে দাঁড়াল, “ তোমার শুভ মুক্তি পাওয়া উপলক্ষে মিষ্টি কেনা ঠিক হবে না। তাই ঝাল জিনিস বিলাবো ভেবেছি। ছোট বেগাম- ” মিথিলার দিকে তাকাল, “ চল সারা হাসপাতালে এগুলো বিলিয়ে আসি।”
মিথিলা ফিঁক করে হেসে দিল। আমি রেগে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাত ধরে, নাহ- কনুইয়ে কনুই ধরে বেরিয়ে গেল সিঙ্গারা বিলাতে!
বিরক্ত হলাম খুব। ঘুরে ব্যাগটা গোছাতে লাগলাম। জাহিদের কবিতাটার শেষ লাইন দুটো মাথায় ঘুরছে কেন জানি। খারাপ লেখেনি। কিন্তু প্রশংসা করলে পেয়ে বসবে। থাক। যেমন আছে থাকুক। আপন মনে হাসলাম ওর পাগলামীর কথা ভেবে।
সেন্ডেল নিতে ঝুঁকেছি মেঝেতে – হঠাৎ জমে গেলাম বরফের মত। ভয়ংকর একটা ভয় মাথা থেকে ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। রুমের লাইট জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে, তার ছায়া পড়েছে মেঝেতে। আমি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলাম ফ্যানের ছায়ার সঙ্গে একটা মানুষের উল্টো ছায়া! সিলিং থেকে কেউ ঝুলে থাকলে যেমন হবে- ঠিক তেমন! আমি কাঁপতে লাগলাম আতংকে। খুব ধীরে ধীরে ঘুরলাম। রুমের সিলিংটা ঠিক সেই দাবার বোর্ডের মত হয়ে গেছে!
সেখান থেকে গম্ভীর মুখে ঝুলে আছেন ডাঃ এমরান! তাকিয়ে রয়েছেন সরাসরি আমার দিকে!

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ৮:০০
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×