অমীমাংসিত- প্রথম পর্ব (গল্প)
অমীমাংসিত – দ্বিতীয় পর্ব (গল্প)
আমি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারলাম না। জ্বরটা লেগেই থাকল। জ্বরের কাঁপুনি নিয়েই হাসপাতাল ছাড়লাম। সাথে টাকা পয়সা তেমন ছিল না যে আরো কিছুদিন হাসপাতাল-ওষুধের খরচ চালাবো। ঈমাম ইদ্রীস শেখের কাছে আমি কৃতজ্ঞ- কারণ শেষের দিকের প্রায় সব খরচ’ই উনি দিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে ওখানে থাকাটাও সম্ভব ছিল না। টাকা পয়সার টান পড়তেই বাধ্য হলাম শহরে ফিরে আসতে। অবশ্য চলে আসার আগে মাদ্রাসায় একদিন ছিলাম। ইদ্রীস সাহেবের সঙ্গে সে সময়টায় আমার অনেক কথা হল। সে সময় তাঁকে জানালাম এখানে আমার আসার কারণ সম্পর্কে। যদিও তিনি আগে থেকেই জানেন আমি কেন এসেছি এখানে। কারণ অন্য “নজরুল হোসেন” তাঁকে নাকি সব বলেছিল। “সে” স্বপ্ন দেখে তার সত্যতা যাচাই করতে এসেছিল। তবে ঈমাম সাহেব সে সময় তাকে যা বলেছিলেন- তা আমি জানতাম না, তাই নতুন করে আমাকে তিনি বলা শুরু করলেন।
সে রাতে খাওয়ার পর ঈমাম ইদ্রীস শেখ মসজিদের বারান্দায় আমার সাথে বসে অনেক গল্প করলেন। চারপাশে নিরেট ঘন অন্ধকার। কেবল বারান্দায় একটা হারিকেন জ্বলছে। মাদ্রাসার ঘর গুলোর দু-একটা থেকে ছাত্রদের আরবী পড়ার মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। বাকিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আলো নেই সে সব ঘরে। রাত তখন সাড়ে এগারোটার মত। একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে, এখন আর হচ্ছে না, তবে হালকা বাতাস এদিক সেদিক থেকে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির ছটা উড়িয়ে এনে গায়ে ফেলছে।
ইদ্রীস সাহেব মুখে সবে পান পুড়েছেন। বারান্দায় হেলান দিলেন দেয়ালে। আমার দিকে তাকিয়ে সমবেদনার সুরে বললেন, “আমি বুঝতে পারতেছি আপনে অনেক পেরেশানির মধ্যে আছেন। আল্লাহ পাক কাকে কখন কি পরীক্ষায় ফালায়- তিনিই কইতে পারেন কেবল।”
আমি নড়ে চড়ে বসলাম। শীত লাগছে। গায়ে একটা চাঁদর দিয়েও শীতে পোষ মানছে না। জ্বরটা ভাল মত জাকিয়ে বসেছে হাঁড়ের ভেতর। সামান্য দ্বিধা মেশানো গলায় বললাম, “আমি এখনো বুঝতে পারছি না আমার পরিচয়ে কে এসেছিল এখানে? আর সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটাই বা কে? কেন আমি বার বার তাকে দেখি? গত পঞ্চাশ বছরেও আমার এরকম সমস্যা ছিল না- নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ আমি। কারো ক্ষতিও করিনি কখনো।”
ঈমাম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না। দীর্ঘ একটা গুমোট নীরবতা। বৃষ্টি থামায় দু-একটা ঝিঁ ঝিঁ পোঁকা এখান-ওখান থেকে চাপা স্বরে ডাকা শুরু করেছে। আমি বাহিরের ঘুট ঘুটে কালি গুলে দেয়া অন্ধকারের মাঝ দিয়ে গোরস্থানের দিকে তাকালাম। কিছু বোঝা যায় না। শুধু অদ্ভূত একটা ভয় উঁকি দেয় মনের ভেতর। মিলিয়ে যায় না সেটা।
ঈমাম সাহেব কেঁশে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলেন, “আপনে জিজ্ঞাস করছিলেন জুবায়ের আলীর কোনো বোইন আছিল নাকি?”
“আমি?” অবাক হয়ে তাকাল, “কখন?”
“না মানে আপনে না, আপনের আগের জন।”
“কি বলেছিলেন জবাবে?”
“কেউ ছিল না। জুবায়ের এতিম ছেলে। মা, বাপ, ভাই-বোইন কেউ আছিল না। তিন বৎসর বয়স যখন তখন থেইকা এই মাদ্রাসায় ছিল। বলতে পারেন এই মাদ্রাসার ছেলে।” একটু বিষাদ মেশানো কন্ঠে বললেন।
আমি কিছু বললাম না। চুপ হয়ে বসে আছি।
ইদ্রীস সাহেব আপন মনেই বলতে লাগলেন, “জুবায়ের খুবই শান্ত কিসিমের ছেলে আছিল। একদম কথা বার্তা বলত না। এই পাঁচ বছর বয়সেই পুরা অর্ধেক কুরান মুখস্ত করে ফেলছিল!”
আনমনেই বললাম, “তাই নাকি?”
“হ্যা ভাই। খুবই ভাল স্বরণ শক্তি আছিল ছেলেটার। একটা আজব খেয়াল আছিল ওর। সারা দিন রাত গোরস্থানের ভিতর গিয়া নতুন কবরের নাম, তারিখ, সাল- মুখস্ত করত।”
আমি অন্য মনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। কথাটা কানে যেতেই ঝট করে সোজা হয়ে বসলাম। শিরদাঁড়া পুরো টান টান, “কি বললেন?”
“ইয়ে- কবরের নাম, তারিখ, সাল মুখস্ত করত।” একটু অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে।
আমি বেশ বিষ্মিত মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “ মানে? মুখস্ত করত?”
“জী ভাই। আরো একটা কাজ করতো- কবরের পাশে বসে কান পাইতা থাকত, যেন কিছু শুনবার চেষ্টা করতেছে।”
আমি স্থির দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মূর্তির মত দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নড়লাম না।
“ভাই? কী ভাবতেছেন?” অবাক গলায় বললেন ইদ্রীস সাহেব।
আমি জবাব দিলাম না। আমার মাথায় বিচিত্র একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে তখন। আমি ঠিক জানি না আমি যেটা ভাবছি- সেটা ঠিক কিনা। কিন্তু আমার যুক্তিতে সব খাঁপে খাঁপে মিলে যাচ্ছে......
আমি সে রাতটা মসজিদের বারান্দায় শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। এক মুহূর্তের জন্য দু চোখের পাতা এক করলাম না। কারণ ঘুমালেই আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করবো। আমার জেগে থাকা এখন ভীষণ দরকার। ভীষণ। জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকার গোরস্থানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম সারা রাত। অপেক্ষা করতে লাগলাম সূর্যের জন্য। অজানা আশংকায় বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা পাগল হয়ে গেছে।
আমি পরদিন খুব ভোরে চলে আসি রেল স্টেশনে। আসার আগে ফযরের নামাজ শেষে বিদায় নেই ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে। আমাকে এগিয়ে দিতে তিনি রেল স্টেশন পর্যন্ত এলেন। ভদ্রলোক বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে বিদায় জানালেন। বহুকাল মানুষের এমন গভীর ভালবাসা পাইনি। খারাপ লাগল কেন জানি। আসার আগে তাঁকে বললাম, “ ভাই, একটা কথা বলি?”
“অবশ্যি বলেন ভাই।”
“আমাকে পাগল ভাববেন না। কথাটা শুনলে পাগল মনে হতে পারে আমাকে।” স্টেশনের প্লাটফর্ম দিয়ে হাটতে হাটতে বললাম। ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে।
“কি কথা?” বেশ অবাক হলেন।
“জুবায়ের আলী নামের সেই ছেলেটার ছবি আর বর্ণনা দিয়ে পত্রিকায় একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি দেন। ছেলেটাকে খুঁজে পাবেন আমার মনে হয়।”
ঈমাম সাহেব এমন ভাবে তাকালেন যেন আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে তাঁর কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলাম, “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন ভাই, আমি বুঝে শুনে কথাটা বলেছি আপনাকে।”
ট্রেনের বাঁশি দিল। আমি দরজার হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়লাম। ঈমাম ভদ্রলোক তখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্লাটফর্মে। ট্রেনটা ছেড়ে দিল। ঈমাম সাহেবের সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
পৃথিবীতে অতিপ্রাকৃত কিছু আছে কিনা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু এখন একটা জিনিস আমি জানি। অতিপ্রাকৃত কিছু মানুষ ঠিকি রয়েছে।
প্রকৃতি যখন সিদ্ধান্ত নেয় তার সৃষ্ট মানুষ গুলোর মাঝ থেকে কাউকে সে বিচ্ছিন্ন করবে- তখন একই সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তের পরিপুরোক অন্য কোথাও একটা মানুষকে সৃষ্টিও করেন। আর প্রকৃতি তার সিদ্ধান্ত মাঝ পথে বদলে ফেলার জন্য তৈরি করেছেন কিছু মাধ্যম। সেই রকম একজন মাধ্যম হল “মোঃ নজরুল হোসেন” কিংবা “জুবায়ের আলী”।
আমি ৩১ জুলাই রাতে জুবায়ের আলীর দ্বিতীয় সত্ত্বাকে বাঁচাতে পারিনি। সেদিন কবর দেয়া হয়েছিল জুবায়ের আলীর দ্বিতীয় অস্তিত্বকে। আসল জুবায়ের আলীকে নয়। কবরের ভেতর মারা যাওয়া বাচ্চাটা ছিল “মোঃ নজরুল হোসেন”এর সেই দ্বিতীয় জনের মত। আসল জুবায়ের আলী আমার মত এখনো বেঁচে আছে কোথাও না কোথাও। পালিয়ে বেরাচ্ছে ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে- কারণ সে এখনো ছোট। ভয়টাকে সহ্য করার মত শক্তি তার এখনো হয়নি।
আমার এ অদ্ভূত ব্যাখ্যার অর্থ অনেকেই বুঝতে পারবেন না। তাই একটু বুঝিয়ে বলছি- জুবায়ের আলী নামের সেই বাচ্চা ছেলেটা খুব ছোট থাকতেই একটা জিনিস জেনে গিয়েছিল। প্রকৃতি তার সৃষ্ট মানুষদের নির্দিষ্ট সময়ের আগে যদি টেনে নেন- মাঝে মাঝে তাদের ফিরিয়েও দেন। কিন্তু সেটা খুবই অল্প সময়ের জন্য। সেই অল্প সময়ে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ আছে যারাই কেবল বুঝতে পারে প্রকৃতি সেই মানুষটাকে আবার ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তখন তাদের কাজ হয় সেই মৃত মানুষটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। জুবায়ের আলী নতুন কবরের নাম, তারিখ, সাল দেখে বলে দিতে পারত এই কবরের ব্যক্তি কি দ্বিতীয় বার বেঁচে উঠবে নাকি। সে এসব কিভাবে জানতে পেরেছিল সেটা আমার কাছে ধোঁয়াটে। হতে পারে সেই ন্যাড়া ফ্যাকাসে মেয়েটার মাধ্যমে জানতে পারতো।
জুবায়ের আলী ছোট ছিল বলে ভয় পেত জিনিসটা। কারণ ও শখের বশে নয়, ভয়ের বশে কাজটা করতো। খুব সম্ভব ও কোনো কবরের লাশের জীবন্ত হওয়ার পর ভয় পেয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে পালিয়ে গিয়েছিল মাদ্রাসা ছেড়ে। আর সে কারণেই শাস্তি সরুপ তার দ্বিতীয় একজন অস্তিত্বকে এখানে পাঠানো হয় এবং অসুখ হয়ে মারা যায়, তারপর কবরের ভেতরে সেই কষ্টটা পেয়ে মৃত্যু হয় তার- যে কষ্টটা অন্য কেউ একজন পেয়েছিল কবরের ভেতর দ্বিতীয়বার বেঁচে উঠেও শ্বাস নিতে না পেরে মারা যাওয়ায়।
জুবায়ের আলি যে রাতে কবরের ভেতর মারা যায়- সে রাতে আমিও একই কাজ করেছিলাম। ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। হয়ত সে কারণেই আমার দ্বিতীয় সত্ত্বাকে পাঠানো হয় এবং কবরের ভেতর জেগে উঠে শ্বাস বদ্ধ হয়ে মরার কষ্টটা পেতে হয়। আমি স্বপ্নের মাঝেই আমার যাত্রা করি- হয়ত জুবায়ের আলীও সেরকম কিছু করে। হয়ত আমার মত দুঃস্বপ্ন যাত্রা সে করে না, সে তারিখ মিলিয়ে খুঁজে বের করে কার পুনরাগমন ঘটবে আবার? কে জানে হয়ত এখনো করে।
তবে জুবায়ের কবরের নাম, তারিখ দেখে যে কাজটা করতে পারত আমি তা পারি না। হয়ত আমাদের ধরন আলাদা। আমি জানি না কে জেগে উঠবে কবরের মাঝে? শুধু এটুকু আন্দাজ করে বলতে পারি- আমি যে রাতে কবরের ভেতরে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাই- সে রাতে আমার কবরের ওপরে কিংবা আশে পাশে কেউ একজন ছিল...... হয়ত আমার মত কেউ...... যে ভয় পেয়ে আমাকে বের করতে যায়নি। হয়ত এভাবেই প্রকৃতি তার বিচিত্র শৃংখ্যলটা সৃষ্টি করেছেন। হয়ত এভাবেই এই মানুষ গুলো তাদের নিজেদেরকে আবিষ্কার করবে......
আমি দিনাজপুর চলে আসার দীর্ঘ দিন পর হিঙ্গুলী মাদ্রাসার ঈমাম ইদ্রীস শেখের চিঠি আসে আমার কাছে। চিঠিতে সাধু-চলিত মিশিয়ে ফেলেছেন ভদ্রলোক। তিনি লিখেছেনঃ-
“ভাই মোঃ নজরুল হোসেন,
আমার সালাম নিবেন। আমি আসলে ঠিক কিভাবে লেখবো ব্যাপারটা বুঝতে পারিতেছি না। আমি আপনি চলিয়া যাওয়ার পর খেয়ালের বসেই পত্রিকায় জুবায়ের আলীর নিখোঁজ সংবাদ দিয়া খবর ছাপাই। অনেকেই আমাকে পাগল ঠাউরেছিল সেই সময়।
ইহা মহান আল্লাহ তা আলার বড় অদ্ভূত কুদরত- এক মাসের মাথায় জুবায়ের আলীকে ব্রাক্ষ্মণ বাড়িয়ায় খুঁজিয়া পাওয়া যায়! বড়ই আশ্চর্যের বিষয় সে সুস্থ আছে এবং মতি ভ্রমও হয় নাই! বর্তমানে মাদ্রাসায় আছে সে। আপনি একবার তাকে দেখিতে আসলে খুশি হইতাম। সে এখনো নতুন কবরের নাম, তারিখ পড়িয়া বেড়ায়।
- আরজ গুজার
মাওলানা মোঃ ইদ্রীস শেখ”
আমি যাইনি। চিঠির জবাবও দেইনি। ইদ্রীস সাহেবের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, তবুও কেন যেন এড়িয়ে গেলাম চিঠিটাকে। কারণ এখন আমার কাছে কোন প্রশ্ন জমা নেই। যেটার উত্তর জুবায়ের আলী দেবে আমাকে। হ্যা, কবরের নাম, তারিখ দেখে কিভাবে সে বের করে যে এই কবরের মানুষ পুনরুত্থিত হবে- সেটা জানার আগ্রহ ছিল। কিন্তু মনে হয় না সে আমাকে বলবে। কারণ আমরা দুজনেই ভয় পাই, অজানা একটা ভয়......
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
প্রচন্ড মাথা ব্যথা আর জ্বরে কাঁপছি। সাথে বুকের ভেতর কফ জমেছে। ঘড় ঘড় করে সারাক্ষণ। দুপুরে দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছি। তাতেও শিতে মানছে না। কিছুদিন হল বাসার কাজ করে দেয়ার জন্য গ্রামের বাড়ি থেকে ফুফু একটা ন্য বছরের বাচ্চা মেয়েকে পাঠিয়েছে। অনাথ। কেই নেই বলেই আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি ত সারাক্ষণ রোগে শোকে ভূগি, তাই ও এখানে থাকলে খাওয়া দাওয়াটা অন্তত করা হয়। নামটা বলা হয়নি- পারুল। শ্যামলা মত হালকা পাতলা মানুষ। বাতাস এলে উড়ে যাবে এরকম। আমার জ্বর আসলেই খুব ব্যস্ত হয়ে পরে পারুল। মাথায় পানি ঢেলে দেয়, কপালে জলপট্টি দেয়। আজকেও মাথা ব্যথা আর জ্বরে যখন কাঁপছিলাম, পারুল আমার গায়ের ওপর আরো দুটো কাঁথা চাপিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “চাচা আপনের তো অনেক জ্বর! আপনে শুইয়া থাকেন। আমি ডাক্তার ডাকে আনতেছি মোড়েরই ডাক্তারের দোকান।”
আমি কিছু বলার শক্তি পাচ্ছিলাম না। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় মগজটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার, জ্বরের ঘোরে কেবল গোঙ্গাচ্ছি...... পারুলের কথা শুনতে পেলাম না...... তলিয়ে যাচ্ছি কোথাও আমি......
ভীষণ স্যাঁত স্যাঁতে কোথাও বসে আছি। ঠান্ডা আর ভ্যাপসা একটা স্থির বাতাস। নিজের হাত পা কিছুই দেখতে পারছি না। কিন্তু হাত বুলিয়ে চারপাশে বুঝতে পারলাম একটা কবরের ভেতরে আছি। আমার পা নাড়াতেই এই কবরের লাশটার গায়ে লাগল। স্থির হয়ে গেলাম। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে লাশটা। খারাপ ধরণের একটা গন্ধ। নাকে হাত দিলাম। বুকের ভেতর ঢাকের মত আওয়াজ করা শুরু হয়েছে। শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম নিজেকে। বোঝার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি। মাথার ওপরের ছাদ মাটি চেপে সিমেন্টের মত হয়ে গেছে, তবে দেয়ালের মাটি খুব আলগা। হাত দিতেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ল। পুরনো কবর। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। বাতাস ফুরিয়ে গেলে মরতে হবে...... চারপাশে পিনপতন নীরবতা। জমাট নিস্তব্ধতা।
হঠাৎ মনে হল খুব চাপা, গুমোট একটা কান্নার শব্দ কানে এল...... কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কোত্থেকে আসছে। কিছুতে থাবড়ানো, আচঁড়ানোর শব্দ শুরু হল। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কবরের দেয়ালে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম শব্দটার উৎসটা কোথায়......
হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম এই কবরের পাশেই আরেকটা কবর! ওটা থেকেই আসছে শব্দটা! বাচ্চা কোনো মেয়ের কান্নার শব্দ। কিন্তু খুব দ্রুত কান্নাটা আতংকের চিৎকারে রুপ নেয়া শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম কি ঘটতে যাচ্ছে। আমি গায়ের শক্তি দিয়ে আমার কবরের ঐ পাশের দেয়ালের মাটি খাঁমচে ভেঙ্গে ফেলতে লাগলাম। মাটি নরম। দ্রুত পাতলা হয়ে আসতে লাগল দেয়ালটা। ওপাশের চিৎকার থামছে না।
দেয়ালে ছিদ্র হওয়া মাত্রই ওপাশের বাচ্চা মেয়েটা প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে এক কোনায় চলে গেল ভয়ে। আমি আরো দ্রুত দেয়াল ভেঙ্গে ওপাশের কবরে এসে ঢুকলাম। অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু সময় নেই হাতে। আমি কেবল বললাম, “ মা, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে বের করে দিচ্ছি।” মেয়েটার দিক থেকে আরো ভয়ার্ত কান্নার শব্দ হল। কিন্তু বেশ দূর্বল। নিঃশ্বাস না নিতে পেরে দূর্বল হয়ে আসছে মেয়েটা।
আমি দেরি না করে কবরের ছাদের এক পাশে জোরে জোরে ঠেলা দিয়ে বাঁশ, চাটাই খুলে ফেলতে লাগলাম। বাচ্চার কবর বলে সবকিছু অল্প ছিল। তাই ছাদটার এক পাশে দ্রুত একটা ফোঁকর করে ফেলতে পারলাম। গায়ে বালু মাটি লেগে একাকার অবস্থা। ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালাম। অন্ধকারে মেয়েটার সারা আর না পেয়ে চমকে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে দেখলাম খুব দূর্বল হয়ে এসেছে শ্বাস নিতে না পেরে। কেবল মাটিতে পা ঘসছে নিস্তেজ ভাবে। আমি কোলে তুলে ওকে নিয়ে এলাম ফোঁকরটার মুখের কাছে। তুলে ধরলাম। খোলা বাতাসে শ্বাস নিতেই শক্তি পেল মেয়েটা। হাঁচড়ে পাচঁড়ে বেরিয়ে গেল কবর থেকে। ভেবছিলাম আমার জন্য দাঁড়াবে। কিন্তু দাঁড়ালো না, ভয় পেয়ে পালাতে লাগল...... চাঁদের আলোয় হারিয়ে গেল......
আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটু নিঃশ্বাস নিলাম ফোঁকরটা দিয়ে। রাতের ভাঙ্গা চাঁদের আলোয় গোরস্থানটা চিনতে পারলাম না। কে জানে কোথায় এটা?
আস্তে আস্তে বসে পড়লাম আবার কবরের ভেতর। চাঁদের আলো ঢুকছে ফোঁকর দিয়ে কবরের এ পাশে। আমি জানি অন্য পাশের অন্ধকার কোনাটায় এখনো মূর্তির মত বসে রয়েছে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটা...... স্থির চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে......
চোখ মেললাম। জ্বরের তেজটা কমে এসেছে। মাথা ব্যথাটাও নেই একদম। হালকা লাগছে খুব মাথাটা। দেখলাম আমার মাথার কাছে একটা টুলে বসে আমার মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালছে পারুল আর হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছছে। ঘরের জানালাটা খোলা। মধ্য রাতের চাঁদের আলো এসে আমার ঘরটা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কাঁপা হাতে পারুলের মাথায় হাত রাখলাম। মেয়েটা এখন আরো জোরে কাঁদা শুরু করল।
আহারে...... বুকের ভেতর অদ্ভূত একটা শূণ্যতা মোচড় দিয়ে উঠল। বিয়ে করিনি বলে জানি না সন্তান হলে কেমন লাগে। কিন্তু কেন যেন হঠাৎ মনে হল আমার মেয়ে থাকলে মেয়েটা ঠিক পারুলের মতই হত, এভাবেই হয়ত কাঁদত আমার মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে...... ঝাপসা হয়ে এল আমার চোখের দৃষ্টি......... আহারে...... মমতা বড় কঠিন জিনিস। স্রষ্টা এই একটা জিনিস দিয়ে জগৎটাকে এত সুন্দর করে ফেলেছেন!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:৩৫