অমীমাংসিত- প্রথম পর্ব (গল্প)
চিনকী আস্তানা স্টেশনটা বেশ নির্জন। যখন ওখানে ট্রেনটা গিয়ে থামল তখন রাত সাড়ে দশটার মত বাজে। বাহিরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার- তার মাঝে টিপটিপিয়ে বৃষ্টি। ছাতা আনা হয়নি। ব্যাগ হাতে প্লাটফর্মে নামার সাথে সাথে ভেজা শুরু করলাম। লোকাল ট্রেনে করে এসেছি বলে স্টেশনের বৃষ্টিতে নামা মাত্র মনে হল একটু শান্তি পেলাম। এতক্ষণ ট্রেনের টয়লেট বিহীন কামড়ায় মুরগীর খাঁচার মত অবস্থায় ছিলাম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে বেশি সেটা লোকাল ট্রেনে উঠলেই বোঝা যায়। ঘামে পাঞ্জাবী পিঠের সাথে লেগে গেছে। বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটা গুলো গায়ে লাগতেই মনে হচ্ছে শান্তিতে ঘুম এসে যাবে। ব্যাগ হাতে হাটতে লাগলাম। হিঙ্গুলী গ্রামটা এখান থেকে আরো মাইল খানেক উত্তর-পূর্ব দিকে। এত রাতে সেখানে যাওয়াটা সামান্য ঝামেলার মনে হল। একে তো ইলেক্ট্রিসিটি নেই এ অঞ্চলটায়, তার ওপর রাত দশটার পর রিক্সা-ভ্যান কোনোটাই যাবে না।
স্টেশন মাষ্টার আক্ষরিক অর্থেই মাছি মারা কেরানী গোছের লোক। দশটা প্রশ্ন করার পর একটা জবাব দেন। যাওবা দেন সেটা কাজে লাগার মত না। মাষ্টার সাহেব ম্যাচের কাঠি দিয়ে খুব যত্নের সাথে কান খোঁচাচ্ছিলেন আমি যখন তার অফিসে ঢুকি। কেবল একটা হারিকেন জ্বলেছে। ময়লা হারিকেনের তেল যাই যাই অবস্থা, আলোই নেই।
“আসসালামুয়ালাইকুম, ভাই- হিঙ্গুলী গ্রামটায় যাওয়ার নিয়মটা বলতে পারবেন? এখানের কোনো রিক্সা-ভ্যান যাবে না বলছে।”
“উঁ?”
“হিঙ্গুলী যাওয়ার ব্যবস্থাটা কি?” ভাবলাম শুনতে পায়নি, তাই আবার বললাম।
“ঊঁ?” আবারো কোনো জবাব না দিয়ে বিদঘূটে শব্দ করলেন।
“ভাই আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।” সামান্য উষ্ণ গলায় বললাম।
কান চুলকাতে চুলকাতেই বেদম জোরে কেঁশে উঠলেন মাষ্টার সাহেব। ম্যাচের ভাঙ্গা কাঠিটা চোখের সামনে এনে বিরক্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। বাকি অংশটা কানের ভেতরে আটকা পড়েছে বোধ হয়। দেখলাম মাথা একপাশে কাত করে বার কয়েক ঝাঁকি দিলেন।
আমি গলা খাকারি দিলাম, “ ভাই? হিঙ্গুলী.........”
হাত তুলে থামিয়ে দিলেন, “ যে কোনো ভ্যান ধরে উইঠা যান, লয়া যাইবো। এখানে খাঁড়ায়া লাব নাই।” একটা চিমটা বের করে কানের কাঠি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। বোঝাই গেল ভাঙ্গা কাঠি প্রায়ই কানে আটকা পড়ে তার, এবং সেটা উদ্ধার কাজেও সিদ্ধ হস্ত। কারণ আমি থাকা অবস্থাতেই কাঠিটা টেনে বের করলেন। মুখে প্রশান্তির হাসি। আমি বেরিয়ে এলাম বিরক্ত হয়ে।
হাত ঘড়িতে রাত এগারোটা দশ বাজে। বৃষ্টির পরিমান বেড়েছে আরো অনেক। এ বয়সে ভিজলে জ্বর আসতে সময় নেবে না। হিঙ্গুলী গ্রামটায় পৌছানো জরুরী। আগে যদি বুঝতাম এত রাত হবে, তাহলে আরো সকাল সকাল করে বের হতাম। ভ্যান-রিক্সা কোনোটাকেই রাজী করাতে পারলাম না শত চেষ্টার পরেও। শেষে মহা বিরক্ত হয়ে স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম সকাল হবার। এর বেশি আর কিছু করার নেই আমার।
রাত যত গভীর হয় স্টেশন তত বিচিত্র ভাবে জেগে উঠতে থাকে। গাঁজা আর জুয়ার আড্ডা বসল সামনে একটা প্লাটফর্মে। ট্রেন আসলে স্টেশনটা জীবন্ত হয়, নয়ত মরার মত পড়ে থাকে।
গাঁজার আড্ডায় গান ধরেছে কয়েকজন, তাস খেলা চলছে। আমি দেখছি তা...... এক সময় ঝিমানির মত শুরু হল...... গাঁজার আড্ডার গানটা কানে বাজছে...... ক্রমশ চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতে লাগল..... দূরে কোথাও ঘন্টা বাজছে...... অদ্ভূত শোনাছে শব্দটা... মনে হচ্ছে অনেক লোকজন কথা বলছে... তার মাঝ দিয়ে গানটা ঘুর পাঁক খাচ্ছে মাথার ভেতর...
“বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই ভেবে
সাক্ষি কেউ ছিলনা সে সময়......”
চোখ মেললাম যখন- তখন প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই গোরস্থানের গাছটার নিচে! যেখানে নিজেকে পেয়েছিলাম জুলাইয়ের ৩১ তারিখে! ধরমরিয়ে উঠে বসলাম। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে গোরস্থানের ভেতর দিকে চার্জার লাইটের আলো। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ঠিক সামনেই আবছা ভাবে সেই বাচ্চা ছেলেটার কবরের অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে। আমার হৃদপিন্ডটা অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। চার্জারের আলো আসছে আরো ভেতরের দিক থেকে। আমি প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে দ্বিধান্বিত পায়ে হাটতে লাগলাম আলোটার দিকে। পায়ের নিচে প্যাঁচ প্যাঁচে কাঁদা। বার কয়েক পুরনো কবরে পা ঢুকে যেতে যেতে সামলে নিলাম। গাছ গুলোর অন্য পাশ থেকে আলো আসছে, তাতে বেশ কিছু মানুষকে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা করছে সবাই। সবার হাতে ছাতা, ছাতার জন্য বোঝা যাচ্ছে না কি করছে তারা। আমি এগোতে এগোতে টের পেলাম অসম্ভব একটা ভয় ভেতরে দানা বাধতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে যতই এগোচ্ছি, ভয়টা ততই বাড়ছে...... চার্জারের আলো ভেবেছিলাম যেটাকে এতক্ষণ- কাছে আসায় স্পষ্ট হল, হ্যাজাক বাতি। সাদা কাপড় পরা বেশ কিছু লোক ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
আমি আর হাটতে পারছিলাম না, একটা গাছে হেলান দিয়ে কোনো মতে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে দেখলাম একটা লাশের দাফন কাজ চলছে। দুজন লোক একটা নতুন খোঁড়া কবরে নেমেছে। ওপর থেকে কাফন পরা লাশটা নামিয়ে ওদের হাতে দিচ্ছে লোক গুলো। কেউ একজন জোরে জোরে দরুদ পাঠ করছে সুর করে। আমি টলতে টলতে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ছাতা হাতে ওরা কেউই আমাকে লক্ষ করছে না। হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম কবরের ভেতর জমে ওঠা পানির মাঝে কাফন পরা লাশটাকে উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে নামাচ্ছে লোক দুটো। লাশটার দৈর্ঘ্য দেখেই অনুমান করলাম বয়ষ্ক, বড় মানুষের লাশ। কবরের পানিতে রাখা মাত্র কাফন ভিজে অনেকখানি ডুবে গেল লাশটা। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ভয়টা ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে শুধুই। তীব্র একটা ভয়।
কেউ একজন বলল, “লাশের মুখ শেষবারের মতন দেখবেন কেউ? নাইলে বাঁশ লাগায় দিক।”
দেখলাম কেউ মুখ দেখার মত আগ্রহ দেখাল না। লোক দুটো কবরের ওপর আড়া আড়ি বাঁশ দেয়া শুরু করল। দ্রুত চাটাই বিছিয়ে ঢেকে ফেলল কবরের ওপরটা। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি দেয়া শুরু করল লোক গুলো।
আমি বসে পড়েছি মাটিতে। কেউ লক্ষ করছে না আমাকে। কিন্তু হ্যাজাকের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম কবরের অন্য পাশে ছাতা ওয়ালা লোক গুলোর ভীড়ে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে! শীতল শান্ত চোখ দুটোয় ক্রুড়ো একটা দৃষ্টি। সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে...... তখনি মাথার ভেতর তীব্র ব্যথা শুরু হল আমার! মনে হল কেউ যেন আমার মগজটা ধারাল ক্ষুর দিয়ে পোঁচ দিচ্ছে......
ঝটকা দিয়ে জেগে উঠলাম। আমার দু পা আর প্যান্টের নিচের দিক কাঁদায় মেখে আছে! ঘড়িতে দেখলাম- রাত আড়াইটা বাজে। ট্রেন এসেছে স্টেশনে। জীবন্ত মনে হচ্ছে রাতের মৃত এ স্টেশনকে এখন। কতক্ষন জীবন্ত থাকবে?
আমার হিঙ্গুলী গ্রামে আসাটা যে বিরাট একটা ধাক্কা দিয়ে শুরু হবে জানা ছিল না। আমি পরদিন সকাল বেলা একটা চা দোকানে পাউরূটি আর কলা খেয়ে রওনা দিলাম ভ্যানে করে হিঙ্গুলীর দিকে। তবে তার আগে ওয়েটিং রুমে গিয়ে কাঁদা মাখা প্যান্টটা বদলে নিলাম। সকালে ভ্যান ওয়ালারা কেউ ‘না’ বলল না, বলা মাত্রই আমাকে নিয়ে রওনা দিল। হিঙ্গুলী যাওয়ার পথটা পাঁকা না, কাঁচা রাস্তা। তারওপর বর্ষা কাল বলে রাস্তা ঘাটের করুণ অবস্থা। ভ্যান একেকবার এমন কাত হয়ে যাচ্ছে যে মনে হয় তখন সোজা গিয়ে কাঁদার ওপর পড়বো!
হিঙ্গুলী প্রামে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট খাট ধাক্কার মত খেলাম। আমি শৈশবে যে গ্রামটায় মানুষ হয়েছিলাম অবিকল সেই রকম গ্রাম এটা। ধাক্কাটা যে কারণে খেলাম তা হল- আমি যেখানে, যে রকম বাড়ি, গাছপালা, সাঁকো, রাস্তা দেখেছি আমার শৈশবের গ্রামে- এখানে ঠিক সে রকম- হুবহু এক! কোথাও কোনো অমিল নেই! অবাক হবার কারণটা হল আমার শৈশবের গ্রামটা দিনাজপুরে! আর এটা চট্টগ্রামে।
“হিঙ্গুলী” গ্রামটা আমার জন্য বেশ কিছু রহস্য নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার প্রথমটার সাথে সাক্ষাত হল গ্রামে ঢোকা মাত্রই। হিঙ্গুলী মাদ্রাসার মোয়াজ্জ্বেনের সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেল গ্রামে ঢুকেই। বাজারে যাচ্ছিলেন সম্ভবত। এখানে থাকার মত কোনো হোটেল কিম্বা বোর্ডিং আছে নাকি আর মাদ্রাসাটা কোন দিকে তাকে জিজ্ঞেস করার জন্য আমি ভ্যান থেকে সবে নেমেছি - আমাকে নামতে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন! কিছু বোঝার আগেই চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালালেন! আমি ব্যাপারটা বোঝার জন্য কাউকে যে জিজ্ঞেস করব তা সম্ভব হল না- গ্রামের কেউ আমাকে যে’ই দেখছে এখন- সবাই ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে!
আমি ভীষণ অবাক হলাম। এক রকম হতভম্ব! আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে এমন? ভ্যান ওয়ালা ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ ফালাইলো ক্যান বাই?”
আমি বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়ালাম, “জানি না, আপনি মাদ্রাসায় চলেন।”
আমি ভ্যান ওয়ালাকে নিয়ে মাদ্রাসাটা খঁজে বের করলাম। আমার স্বপ্নে দেখা মাদ্রাসাটার সঙ্গে খুব একটা মিল নেই। পুকুরটা বেশ ছোট, পানিও পরিষ্কার। শ্যাওলা নেই। তবে মিলও রয়েছে। মসজিদের সেই বারান্দা অবিকল এক। এখানে এসেই আমি প্রথম রহস্যটার সাথে জড়িয়ে পড়ি। মাদ্রাসার প্রধান ঈমাম মোহাম্মদ ইদ্রীস শেখের সঙ্গে পরিচয় যখন হল তিনি আমাকে দেখে অবাক হলেন ঠিকি, কিন্তু ভয় পেলেন না। মাদ্রাসার শত শত ছাত্র ততক্ষণে আমাকে দেখতে চলে এসেছে। মসজিদের বারান্দায় বসে আমি প্রথম ইদ্রীস সাহেবের কাছে জানতে পারলাম- আমি “মোঃ নজরুল হোসেন” গত চার দিন ধরে এই হিঙ্গুলী মাদ্রাসায় ছিলাম! এবং গত কাল বিকেলে আমার মৃত্যু হয়েছে- মৃত্যুর আগে আমি বলে গেছি এখানের গোরস্থানে আমাকে কবর দিতে। এবং আমার ফুফুর জন্য চিঠিও লিখে গেছি আমি! গত রাতে আমাকে তারা সবাই কবর দিয়েছে গোরস্থানে!
আমি মসজিদের বারান্দায় বসে ঘোরের মধ্যে সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়লাম যেটা ‘আমি’ ঈমাম সাহেবকে দিয়েছি আমার ফুফুকে দিতে! আমার’ই হাতের লেখা! আমি কাঁপতে শুরু করলাম মৃগী রোগীর মত। সে অবস্থাতেই আমি কবরটা খুঁড়তে অনুরোধ করলাম ঈমাম সাহেবকে।
বলা বাহুল্য আমি বলার আগেই কবর খোঁড়া শুরু হয়ে গেছে। মোয়াজ্জ্বেন সহ আরো কয়েকজন লোক কবরটা খুঁড়লো। আমি নিজে সেখানে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছিলাম না। তাই ঈমাম সাহেব আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন সেখানে। এটা সেই জায়গা, গত কাল রাতে স্বপ্নে যেখানে আমি কবর দিতে দেখেছিলাম কাউকে!
দিনের বেলা সূর্যের আলোতেও আমার ভয়ংকর একটা অশুভ ভয় করছিল কবরটার পাশে দাঁড়িয়ে। কাঁদা আর পানিতে অর্ধেক ডুবে আছে কাফন জড়ানো লাশটা। কবরের ভেতর অনেক পানি। একজন লোক নামল কবরে মুখ দেখানোর জন্য।
মুখের কাপড় সরানোর পর যাকে দেখলাম- আয়নায় একে আমি বহুবার দেখেছি- আমি, মোঃ নজরুল হোসেন। কাঁদা লেগে থাকলেও না চেনার কোনো কারণ নেই...... আধ খোলা চোখে পৃথিবী দেখছে কবরের পানিতে ভাসতে ভাসতে।
নিজের পায়ের ওপর ভর টিকিয়ে রাখতে পারলাম না আর...... এ যদি নজরুল হোসেন হয়, তাহলে আমি কে? আর আমিই যদি আসল জন হয়ে থাকি- তবে এ কে?
আমি সেদিন গোরস্থানে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারাই। ঈমাম সাহেব উপায় না দেখে আমাকে মস্তান নগর হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে আমি প্রচন্ড জ্বরের মাঝে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তিন দিন ছিলাম। অবশ্য টানা তিন দিন অজ্ঞান থাকিনি। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরতো। কিন্তু বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারতাম না। প্রচন্ড ভয় আর জ্বরের ঘোরে বার বার জ্ঞান হারাতাম। বলা বাহুল্য এই দীর্ঘ সময়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে। কিন্তু প্রতিটাই একটার সাথে আরেকটা যুক্ত। আশ্চর্যের বিষয় হল এই দীর্ঘ সময়ে আমি নাকি কিছুই খাইনি।
আমার ঠিক মনে নেই কখন স্বপ্ন দেখা শুরু করি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। কেবল মনে আছে প্রথমবার হঠাৎ করেই আমার নাকে মুখে পানি ঢোকা শুরু করে। মাথায় যেতেই ভীষণ জোরে কেঁশে উঠে চোখ মেলে তাকাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে! আমি পানির ভেতরে রয়েছি অর্ধেক! ভেসে আছি পানিতে! অবাক হয়ে চারপাশে হাত বুলাতে লাগলাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাটু পানি জমে থাকা একটা ছোট ঘরের ভেতর। সেটা যে একটা কবর বুঝতে সময় লাগল আমার। জায়গাটা কবর কারণ মাথার ওপরে হাত দিতেই বুঝলাম শক্ত বাঁশের টুকরো দিয়ে ঢেকে দেয়া। চার কোনা আয়তাকার ছোট একটা ঘরের মত। হাটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছি। উঠে দাঁড়ানো যায় না, মাথা লেগে যায় বাঁশের ছাদের সাথে। ওপরে ছাদ মাটি দিয়ে ঢেকে থাকায় সমস্ত গায়ের শক্তি দিয়েও ধাক্কা দিয়ে বাঁশের পড়ত গুলো সরাতে পারলাম না। তবে অবাক হবার বিষয় হলঃ আমি এক সময় খেয়াল করলাম আমার গায়ে কাপড় বলতে একটুকরো থান কাপড়। কি রঙের সেটা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারলাম কাপড়টা বেশ লম্বা।
আমি অজানা একটা ভয় পেতে শুরু করলাম। কারণ যতই সময় যেতে লাগলো, মনে হল আমি দম নিতে পারছি না...... বাতাসের জন্য ফুসফুসটা আঁকু পাঁকু করা শুরু করেছে...... আমি পাগলের মত মাথার ওপরের ছাদটা ধাক্কা মেরে ওঠাতে চাইলাম। কিন্তু একটু নড়েই স্থির হয়ে গেল। আমি আবারও ধাক্কা দিতে লাগলাম। শক্তি কমে আসছে শরীরের...... ধাক্কা দিয়ে একচুলও নড়াতে পারছি না আর। মনে হল কবরের ওপর খুব ভারী কিছু একটা জিনিস চাপিয়ে দেয়া হল...... আমার ভয়টা দ্রুত আতংকে রুপ নেয়া শুরু করল। আমি অক্সিজেনের জন্য দেয়াল খাঁমচাতে লাগলাম, আচঁড়াতে লাগলাম পাগলের মত...পানিতে পা ছুড়তে লাগলাম পশুর মত...... তার মাঝেই খেয়াল করলাম এই ঘুটঘুটে অন্ধকার কবরের অন্য মাথায় কেউ একজন বসে আছে...... কেবল অবয়বটা বোঝা যায়...... অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম সেই ন্যাড়া ফ্যাকাসে মেয়েটা জ্বলন্ত অঙ্গার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির হয়ে বসে আছে কবরের পানির মাঝে...... আমি জান্তব একটা চিৎকার করে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য দেয়াল খাঁমচাতে লাগলাম। কিন্তু ফুসফুসের বাতাস ফুরিয়ে এসেছে...... ধীরে ধীরে পানিতে ডুবতে শুরু করেছি... এখনো মেয়েটা আমার দিকে স্থির চোখে চেয়ে আছে......
গভীর রাতে জ্ঞান ফিরল আমার। হাসপাতালের সব বাতি নেভানো। তারপরও বুঝতে পারলাম আমার সারা শরীর কাঁদায় লেপ্টে আছে। আমার নাকে মুখে কাঁদা পানি...... কেঁশে উঠলাম। মাথা জ্বালা করছে প্রচন্ড। পাগলের মত বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলাম। আহা! বেঁচে থাকাটা কত অদ্ভূত! আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসলাম। আমি এখন জানি- হিঙ্গুলী মাদ্রাসা গোরস্থানে কাল সকালে আবারো খোঁড়া হবে “মোঃ নজরুল হোসেন”-এর কবরটা। কারণ সেটার ওপর থেকে মাটি সরে গেছে অনেকখানি। আর অনেকেই একটা চিৎকার শুনেছে......
আমি শুয়ে পড়লাম ধীরে ধীরে। ভয় লাগছে ভীষণ। কেন যেন মনে হচ্ছে হাসপাতালের অন্ধকার করিডোরে, জানালার পর্দার ওপাশ থেকে সেই ন্যাড়া-ফ্যাকাসে মেয়েটা শীতল শান্ত চোখে আমার প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ করছে......
আমি তখনো জানতাম না আমার জন্য আরো কিছু অপেক্ষা করছে......
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৪৫