ঘটনাটা ৩১জুলাইয়ের।
জ্বর জ্বর লাগছে সেই গতকাল দুপুর থেকে। তার ওপর প্রচন্ড গরম- কারেন্ট নেই। বিছানায় শুয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করছি। ঘেমে বিছানার চাদর ভিজিয়ে ফেলেছি। ফেনারগান খেয়েছিলাম সর্দি আর কাশির জন্য। সারা দুপুর-রাত মাতালের মত বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। বার কয়েক মেঝেতে শুয়ে গরমের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। মশার কামড় শুরু হতেই আবার বিছানায় মশারির ভেতর ঢুকে পরতে হয়েছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুম। ওষুধ খেয়ে ঘুমালে স্বপ্নে যা দেখি সব হয় আবোল তাবোল। কিন্তু গতকাল সেরকম দেখিনি। প্রত্যেক ঘুমের ছোট ছোট অংশে অনেকটা খন্ড নাটকের মত স্বপ্ন দেখেছি দুপুর থেকে একেবারে ভোর রাত পর্যন্ত। স্বপ্নটা আবোল তাবোল নয়। খুব স্পষ্ট এবং প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে আমি ঐ সময়টায় সে জায়গাতেই ছিলাম।
স্বপ্নের প্রথম অংশে আমি একটা মাদ্রাসার পুকুর পাড়ে বসে ছিলাম। যোহরের আযান দেয়নি তখনো। দেবে দেবে এমন সময়। পুকুরের সবুজ শ্যাওলা ভরা পানি দাপিয়ে মাদ্রাসার বাচ্চাগুলো গোসল করছে। আমি সিঁড়িতে বসে দেখছি তা। দৃশ্যটায় কোনো বৈচিত্র নেই। খুব স্বাভাবিক। ওদের পানির ছিটে এসে আমার গায়ে পড়ছে। শ্যাওলার জমাট পানি শার্টটা ভারি করে তুলছে ক্রমশ। এ অবস্থায় হঠাৎ খেয়াল করলাম এতগুলো বাচ্চাদের ভীড়ে পানির মাঝে আরো একজন। দেখতে অনেকটা বাচ্চা ন্যাড়া মেয়েদের মত। কিন্তু গায়ের চামড়া অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাসে। চুপচাপ গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। এবং আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেমন গা শিরশিরে অনুভূতি হল হঠাৎ।
আমার প্রথম বারের মত ঘুম ভাঙ্গল। এবং আমি আবিষ্কার করলাম আমার গায়ের শার্টটা সবুজ শ্যাওলায় রীতিমত মেখে আছে।
শার্টের এ দশা হবার পেছনে কোনো যুক্তি সে সময়ে দাঁড় করাতে পারিনি। তারওপর কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণ- কোনোটাই খাটছিল না মাথার ভেতর। লাগছিল সবটাই খুব স্বাভাবিক। মাতালের মত বিছানা থেকে সে সময় উঠে পড়তে হয়েছে, হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসেছে ছেলেটা। সেটা রেখে দিতে হল। খাবার নেয়ার সময় আমার শার্টের এ অবস্থা দেখে কেমন ভাবে যেন তাকাতে লাগল ছেলেটা। কিছু জিজ্ঞেস করল না অবশ্য। বুড়ো মানুষের ভীমরতি ভাবল বোধ হয়।
নামায পড়ার জন্য গোসল সেরে নেয়া উচিত। তাই আর বিছানা মুখো হলাম না। যদিও এখনো ঘুমে শরীর অবশ প্রায়।
আমার দ্বিতীয় দফা ঘুম থেকে স্বপ্ন গুলো এতই জীবন্ত হতে লাগল যে আমি একবারও বুঝতে পারিনি এগুলো স্বপ্ন, এবং কোনো ধরনের প্রশ্নও জাগেনি আমার ভেতরে সে সময়।
আমি গোসল সেরে নামায পড়ে শুয়ে পড়ি। খেতে ইচ্ছা করছিল না তখন। খালি পেটেই ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়া। ঘুমে মাতালের মত লাগছে। শুয়ে চোখ বন্ধ করা মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
প্রায় সাথে সাথে চোখ মেললাম। আমি মাদ্রাসার মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি। ছোট ছোট বাচ্চারা পাঞ্জাবী পাজামা পরে নামায পড়ছে আমার সামনের দিকে। আমি ওদের পেছন দিকে। কেউ আমাকে খেয়াল করছে না মনে হল। তাকাচ্ছে না কেউ আমার দিকে দেখলাম। আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। চারপাশে তাকালাম। সরাসরি চোখ চলে গেল মসজিদের দান বাক্সের গায়ে লেখাটার ওপর। মসজিদের বারান্দার একটা থামের গায়ে ঝোলানো ওটা।
“ হিঙ্গুলী জামিয়া মাদ্রাসা মসজিদ
মেহেদীনগর, বারইয়ার হাট, মিরসরাই, চট্টগ্রাম”
আমি উঠে দাঁড়ালাম। টলছি মাতালের মত। আস্তে আস্তে হেটে এলাম দান বাক্সটার সামনে। ওখানে আরো একটা নতুন কাগজ টানানো দেখলাম। “অসুস্থ মাদ্রাসা ছাত্রের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন” একটা ছোট নোটিস দেয়া। বোধ হয় কোনো ছাত্র অসুস্থ। আমি মানিব্যাগ বের করে একটা দশ টাকার ছেঁড়া নোট বের করলাম। টাকা ঢোকানোর ছিদ্রটা জ্যাম হয়ে গেছে। ঢোকানো যাচ্ছে না। তালাটা খোলা। এমনি ছিটকিনিটার হুকে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। চুরি টুরির ভয় নেই মনে হয়। আমি তালাটা খুলে ছিটকিনি উঠিয়ে ঢাকনাটা খুললাম। সবে মাত্র টাকাটা ফেলেছি হঠাৎ দেখলাম উঠানে গায়ে চাঁদর মুড়ি দিয়ে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মাথার মেয়েটা এককোনায় বসে রয়েছে! এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!
ঝটকা দিয়ে জেগে উঠলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কারেন্ট আসেনি এখনো। কিন্তু ভীষণ অবাক হলাম একটা জিনিস দেখে। আমার হাতে ছোট একটা তালা! মসজিদের দান বাক্সের সেই তালাটা.........
আমার তৃতীয় দফার ঘুমটা হল শেষ বিকেলের দিকে। কারেন্ট এসেছে তখন। ক্যাপাসিটর নষ্ট ওয়ালা ফ্যানটা ঘটর ঘটর করে মাথার ওপর ঘুরছে। হাত দিয়ে ঘোরালে হয়ত আরো জোরেই ঘুরতো। চোখ বোজার সাহতে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এবারেও নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই মাদ্রাসাটায় আবার চলে এসেছি আমি।
এবার বেশ অবাক হয়ে দেখলাম মাদ্রাসার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো একটা লাশ নেয়া খাটিয়ার চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নিচু স্বরে ফোঁপাচ্ছে কেউ। আমি মাথা উঁচিয়ে দেখলাম। কোনো ছোট বাচ্চা মারা গেছে। কাফন দিয়ে পেঁচানো। কেবল মুখটা বার করা। চার পাঁচ বছর হবে বয়েস। জানাযা পড়ানো হবে এখন। মাদ্রাসার হুজুর-আলেমরা সহ সবাই এসে সারি করে দাঁড়িয়ে পরতে বললেন। ঈমাম সাহেব লাশটাকে সামনে রেখে জানাযা পড়ানো শুরু করলেন। আমি একরকম ঘোরের মধ্যেই নিয়ত বেঁধে জানাযায় দাঁড়িয়ে গেলাম।
এখানে অনেক লোকজন এসেছে। গ্রামের লোকজন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যে মারা গেছে- তার কেউ বোধ হয় আসেনি। অন্তত আসলে সেটা হাব ভাবেই প্রকাশ পেত। একবার সন্দেহ হল- বাচ্চাটা অনাথ না তো?
লাশটা কবর দেয়ার জন্য মসজিদের পাশের গোরস্থানের দিকে যখন নিয়ে যাচ্ছে খেয়াল করলাম গ্রামের লোক গুলো খুব অবাক মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছে না।
আমি নিজেও কিছুটা দ্বিধা দন্দ্বে ভূগছি। সবার সাথে আমিও কবর দিতে এলাম। প্রকৃয়াটা খুব দ্রুত হল। মাটি দেয়ার সময় কয়েক মুঠো মাটি দেয়ার পর যেই আবার মাটি নিয়েছি হাতে- দেখলাম আমার ঠিক সামনে, কবরের অন্য পাশে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটা! লোকজনের আড়াল থেকে স্থির চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে......
আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবং এ দফায় আবিষ্কার করলাম আমার ডান হাতে মুঠো ভরা কাঁচা মাটি!
আমার চতুর্থ ও শেষ স্বপ্নটা দেখি মধ্য রাতে। তখন জ্বর বেড়েছে ভীষণ। থেকে থেকে কাঁশছি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছি। জ্বরে সারা শরীর কাঁপছে। ঘুম আসতে সময় নিচ্ছিল তাই। কখন ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই।
চোখ মেলে দেখলাম আমি মসজিদের পাশের গোরস্থানটার একটা গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে আছি। আমার ঠিক সামনেই নতুন বাঁশের বেড়া দেয়া সেই কবর। আকাশে অর্ধেক চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট একটা শব্দ পাচ্ছি গোরস্থানের ভেতর। অনেকটা ছোট বাচ্চার ভয় পাওয়া কান্নার মতশব্দ। কিন্তু শব্দটা কেমন যেন চাপা। আমি ভয় পেলাম হঠাৎ ভীষণ রকমের একটা ভয়। হাত পা সব অসাড় হয়ে আসতে নিল- এমন একটা ভয়...... খুব হাচড়ে পাচড়ে এক রকম উঠে দাঁড়ালাম গাছটা ধরে। চাঁদের আলোয় কবরটার দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে উষ্ণ রক্তের একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ডের ওপর দিয়ে। আমার স্পষ্ট মনে হল কবরটা নিঃশ্বাস নেয়ার সময় যে ভাবে বুক ওঠা নামা করে- সে ভাবে বেশ জোরেই ওঠা নামা করছে! তারপর লাগল কবরের মাটিগুলো থেকে থেকে লাফিয়ে উঠে নেমে যাচ্ছে! যেন নিচ থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে বের হতে চাচ্ছে! সেই সাথে ছোট বাচ্চার ভয় পাওয়া গুমোট-চাপা কন্ঠস্বর!
আমি এত ভয় পেলাম যে দ্বিগ্বীদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে গোরস্থানের মাঝ দিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। তার মাঝেই দেখলাম সেই ন্যাড়া মাথার মেয়েটা একটা কোঁদাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের নিচে। হাত তুলে সেই নতুন কবরটার দিকে যেতে বলছে ইসারায় আমাকে। হাতের কোঁদালটা দেখিয়ে বোঝাচ্ছে কবরটা খোঁড়ার জন্য আমাকে!
আমি প্রচন্ড ভয়ে তখন সংজ্ঞাহীন প্রায়। পেছন থেকে আসা কবরের ধুপ ধুপ শব্দটা তাড়া করছে যেন আমাকে.........
আমি জেগে উঠি ফযরের আযানের মুহূর্তে। আমার সারা গায়ে ধূলো বালি, মাটি আর নানান জায়গায় ছিলে গেছে কাঁটার ঘষা খেয়ে...... বিমূঢ়ের মত বসে রইলাম আমি......
************************************************
আমি পেশায় সরকারী চাকুরীজীবি। টাইপিস্টের কাজ করি। নিজের চলে না বলে বিয়ে থা আর করিনি। পঞ্চাশের মত বয়স হয়েছে বলে এখন আর ওসব করার চিন্তাও মাথায় আনিনা। একা একা থাকি বলে নানান রোগে শোকে ভূগি। ছোট বেলা থেকে এক ফুফুর কাছে মানুষ হয়েছি। তাকে টুকটাক সাহায্য করি এখন। এছাড়া আমার জগৎ খুব সীমাবদ্ধ। সে রাতের স্বপ্ন গুলো নিয়ে খুব যে ব্যস্ত হয়ে পরব এমন মানুষও নই আমি। একা থাকি বলে হয়ত মনের ভূলে এসব দেখেছি। শার্ট, তালা, মাটি- এসবের ব্যাখ্যা মনের ভূল বলেই হয়ত চালিয়ে দিয়ে ভূলে যেতাম পুর ব্যাপারটা। কিন্তু নিছক স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি আমি সেটাকে।
৩১ জুলাইয়ের বিচিত্র ঘটনা গুলো আমার পক্ষে ভূলে যাওয়া সম্ভব হল না পত্রিকায় একটা লেখা দেখে। ৩রা আগস্টের একটা পত্রিকায় “হিঙ্গুলী মাদ্রাসা গোরস্থানে এক মাদ্রাসা ছাত্রকে জীবন্ত কবর দেয়া হয় ভূল বশত” শিরোনামে একটা আর্টিক্যাল চোখে পড়ে আমার। সব ওলোট পালট লাগতে শুরু করে তখন। কারণ সেখানে বলা হয়েছেঃ
৩১ জুলাই বিকালে জুবায়ের আলী নামের এক ছোট পাঁচ বছরের মাদ্রাসা ছাত্র মারা যায়। স্থানীয় ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করার পর বাদ আসর তাকে মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে কবর দেয়া হয়। পরদিন ভোরবেলা ফযরের নামায শেষে ঈমাম সাহেব কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দেখেন কবরের মাটি সরে গেছে অনেক। যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেয়েছে। তাঁর সন্দেহ হলে স্থানীয় লোকজন দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয় এবং সবাই বাক রুদ্ধ হয়ে দেখে কবরের কোনায় সাদা কাফন পরে ছেলেটা বাঁকা হয়ে বসে আছে। তার বসে থাকার ভঙ্গিটা খুব অস্বাভাবিক। কবরের দেয়াল জুরে ছেলেটার আঙ্গুলের আচোঁড়ের চিহ্ন। শ্বাস নিতে না পেরে দেয়াল খাঁমচে বের হবার চেষ্টা করেছিল বোঝা যায়। চোখ গুলো কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায়। পা দিয়ে কবরের মেঝে ঘষে লম্বা লম্বা খাঁজ করে মাটি উঠিয়ে ফেলেছে ভয়াবহ মৃত্যু যন্ত্রণায়!
আমি এই ঘটনা জানার পর টাকাপয়সা জমিয়ে সেই গ্রামে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন পর। সেখানে গিয়ে আমি আরো কিছু ধাঁধাঁর মাঝে পড়ে যাই। কিন্তু আজ সেটা আর লিখতে ইচ্ছা করছে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ৯:৫৫