অতল রাতের থেকে তুলে আনি পাখি ও পাপ। পাপ সে এক হিরণ্ময় অ›ধকারের ডাক নাম। অ›ধকারের একশো তিনটা নাম। পাখি তার মধ্যবর্তী। একটি গান বেজে বেজে ডুবে যায় কণ্ঠের ভিতর। কোনো সুর কেঁপে কেঁপে ডুবে যায় সেতারের নির্লিপ্ত তারে। তবে আমরা এখানে এসেছি কেনো? কারো সবুজ আঙুলে ঝুলে আছে মহাকাল। ঘিরে আসছে আতপ্ত ছায়া। এতো সেই দূর বনের প্রত্যাখ্যাত করুণ। কেউ বলেছিলো দূরবর্তী তীরে আছে নকশার আকর। ভুল জেনেছি। জেনেছি বিলম্বিত সন্ন্যাস। বাগানগুলি জংলা হয়ে উঠে, জংলার ঝাড়ে পুরুষপাখি নাচে।
ইথারের ভাষা কী? হালকা কম্পন। যে বাদক অবিশ্রাম বাজায়Ñ যে বাদক জন্মা›ধÑ তার নখের আয়নায় কি জেগে থাকে কোনো দ্বীপদেশের অভাবনীয় রেখাচিত্র? আমরা কাদার ভাষা জানি না। যে-কাদা মাছের গায়ে আঁশ হয়ে লেগে থাকেÑ তার প্রয়োজনীয়তা দুর্বোধ্য রোদের অক্ষরে খরার খবর বলে নিÑ এইকথা বলা যাবে না। সন্ন্যাসেরও প্রকার থাকে। যেমন কাদা ও মাছের পারস্পরিক সন্ন্যাস। একজন অন্যজনের সাথে একা হয়ে থাকা। একজন জড়জীবনÑ অন্যে অবাধ সন্তরণ বা সাঁতার। সাওতাল পরগনায় ধুয়ে গেছে বিলাস এবং বিদ্যুতের রাহিত্য আদিকালে খুবি স্বাভাবিক একটা বিষয়। বিষয়বিষাদ আজ আমাদের শেখরের খোঁজে ছড়িয়ে পালক। কখনো অস্ট্রিক, নিষাদ, কখনো অনার্য দ্রাবিড় উপবন।
পাখি আর পাপ তার দীনতার নাম। সূর্যাস্তের পাড়ায় শাহরিক মুগ্ধতা ও ক্লান্তি নিয়ে সে তাকিয়ে একটি শোকযাত্রার অলৌকিক জামা পরে। যেমন আছে প্রেমিকা ও সহোদরার মৃত্যুর বিশদ বিবরণ। মলাটে নদী নেই, পিকাসোর রেখাচিত্র। বালিকার হাতে দোলে অব্যক্ত অভিমান। ইদানীং অভিমান ঠাকুর ঘরে বিনোদিনীর পদতলে ছড়ানো সিঁদূর। যেখান ফল্গুলতা, উজ্জ্বল গ্রাম, ত্বকের মসৃণতা, পেলব পাথরের যকৃতে লুকোনো বীজাণু। তারপরও সে সব কথা আমাকে বলেÑ তার পাহাড় ও পাতালের কথা। ঘুড়ির দেশের রঙ ও সুতোর কথা। সুতো কাচের গুড়ো মাখানোর অবিশ্রান্ত কথা সে আমাকে বলে। আমি শুনতে চাই না। পুরনো দর্জির দোকানে গিয়ে কান সেলাই করি। আর সে নতুন করে আমার কান তৈরি করে তাতে ঢেলে দেয় কথার পাথর। এক একদিন সে শুধু মৃতদের কথাই বলে। আর বলে বাদকের ডাক নাম অ›ধকার। তার ঘরের একটা পেইন্টিং এ দুটো গাছ আমার কাছে প্লাস্টিকের মনে হয়। অনেকটা নৃশংস।
বন্যার কথা ভাবি। একবার বন্যা হয়েছিলো পাহাড়ের দেশে। বনজ-মানুষ বন্যাকে উপহাস করে বন্যার স্রোতে শাল এবং সেগুনের জোড়া জোড়া পাতা ভাসায় রাত তৃতীয়প্রহরে, পাতার উপর হালকা মাটির প্রদীপ। আমি শাল বনে হারিয়ে যাই শূন্যতার হাত ধরে। শূন্যতা আমাকে বাদামি এবং কালো বিষয়ে কিছু কথা বলে। বন্যার তরল আরেকটু গাড় হলেই শুকনো পাতারঙ। সে তারপরও থামে না এক একদিন সেজেগুজে আসে। আমি তাকে বকাবকি করি, দূরে নগ্ন বকপাখি আর কাক দেখাই। কাকপাখির বাসায় রূপার নথের কথা বলি। সে রাগ করে শান্ত হয়ে উবু হয়ে বসে মাঠের ঘাসে। ঘাসের জ্বরজ্বর শরীর, তাতে সিনেমার ক্লান্তি। ছায়াছবি যেদিন সিনেমা হলোÑ সেদিন আমরা হারালাম শ্যাওলার মন কেমন করা রঙগ›ধ।
আমি তার ডায়েরি অনুবাদ করতে গিয়ে পেলাম প্রজাপতির কাছে লেখা তার দুটি চিঠি। চিঠিতে হরিদার এবং নিকট আশ্রমের কথা আছে। শ্যাওলার রঙ আমাদের পুকুরে গাঢ় হলে তার কথা ভাবি। সে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতো না। অন্যদের জলরঙের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। আমি দৃশ্যখাদকের চোখে ঘুমটুম সব ভাঁজ করে রেখে একটা গুইসাপের দিকে তাকিয়ে থাকি। গুইসাপ মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখে। কেননা আমিই প্রথম জেনেছি, পাখিদের মধ্যে পুরুষরাই নর্তক হয়।
আমিও তার মতো থাকি জেগে শাহরিক মুগ্ধতা ও ক্লান্তিÑ আমি অবিশ্রাম বাদক, আমি মৌনপাখি, আমি অ›ধকার। আমি নিদারুণ পাপ এবং সুন্দর।