আমার চোখে সকাল নামে সাধারণত সকাল দশটার পর তাই সকালের নরম রোদের স্বাদ আমি পাইনা। ভোরের শিশির যদি কখনো গায়ে মাখতে পারি তখন সারাদিন খুব আরামেই কাটে কিন্তু আমি হয়তো অত আরাম চাইনা বলে শিশিরের স্পর্শ থেকেও দূরে থাকি। রাতের নির্জনতাকেই আপন করেছি বলে ভোর দেখাও হয়না খুব একটা। ভোর যখন আমার জানালার পাশে তখন আমি নাকে লোশন দিয়ে ঘুমাই (তেলে এখন ঝাঁঝ বেশি তাই লোশন দিই) তবুও মাঝে মাঝে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় না ঘুমিয়েই। অতিসম্প্রতি একদিন না ঘুমিয়েই ভোর চলে আসে আমার দরজায়। আমি দরজা খোলে বের হই ততক্ষণে রাস্তায় অফিসমুখো মানুষের দৌড় ঝাপ শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হয়ে দেখি ষাটোর্ধ্ব আমার এক প্রতিবেশী চাচা বগলে ব্রিফকেস নিয়ে জীভ বের করে দৌড়াচ্ছেন। তাকে আমি কখনো দৌড়াতে দেখিনি বলে তাকে থামানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলাম চাচা এতো জোরে দৌড়াচ্ছেন কেন, কি হয়েছে ? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন বাবা দাঁড়িয়ে উত্তর দেবার সময় আমার হাতে নেই উত্তর শুনতে হলে তুমিও আমার সাথে দৌড় লাগাও। কি আর করা আমিও দৌড় শুরু করলাম। অনেক দিন জগিং করা হয়নি আজ চাচার উত্তর শোনতে শোনতে জগিংয়ের কাজটাও হয়ে যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি কে না মারতে চায় ? দৌড়াতে দৌড়াতে চাচা বলতে লাগলেন, বাবারে আগে সি,এন,জি তে চড়ে অফিসে যেতাম তখন সকাল সাড়ে আটটায় বের হলেও ন'টার মধ্যে অফিসে পৌছাতে পারতাম কিন্তু হুট করে সি,এন,জি'র দাম বেড়ে যাওয়াতে সি,এন,জি ছাড়তে হলো। পরিবহন ব্যয় কমাতে তাই কাউন্টার বাস ধরা শুরু করলাম। তখন আমাকে কাঁটায় কাঁটায় আটটায় বের হতে হয়। কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে গুঁতো খেয়েও সময় মতো অফিসে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটাও স্থির থাকলো না, জ্বালানী তেলের দাম আবার বাড়লো কিন্তু আমার বেতন বাড়েনি তাই আবারো পরিবহন ব্যয় কমাতে লোকাল বাসের ধকল সইতে হচ্ছে। এখন সাড়ে সাতটায় বের হয়ে দৌড় না দিলে লোকাল বাসের গেট পর্যন্ত পৌছাতে পৌছাতেই ন'টা বেজে যায়। স্বল্প আয়ের অফিসমুখী মানুষের এই চিত্র এখন সর্বত্র। দফায় দফায় জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে এসব স্বল্প আয়ের মানুষেরাই বেশি বিপাকে পড়ে তা সরকারের নজরে আসে না। কারণ সরকারও আমার মতো দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে তাই সকালের চিত্র সরকারে চোখে ধরা পড়েনা।
কাঁচা বাজারে এখন পাঁকা টাকা অচল ! কাঁচা বাজারে যেতে হলে কাঁচা টাকা নিয়েই যেতে হয় নইলে পাঁকা টাকায় থলি ভরে বাড়ি ফেরা যায়না। কাঁচা মরিচের ঝাঁঝ কমেছে রাসায়ানিক সারের বদৌলতে কিন্তু ঝাঁঝ বেড়েছে দামে, কাঁচা মরিচের কেজি এখন ২৫০টাকা ! ভাবতেও কষ্ট লাগে। আগে বিত্তহীনরা একটা কাঁচা মরিচ আর একটুকরো পেঁয়াজে এক থালা পান্তা পেঠে ঢুকাতে পারতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বিত্তহীনের পান্তার ঝুল থেকে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ অভিমানী প্রেমিকার মতোই অধরা হয়ে যাচ্ছে। কুদ্দুস সাহেব দুদিন আগেও ১৮টাকা কেজি দরে আলু কিনেছেন কিন্তু আজ সকালে তিনি কাঁচা বাজারে গেলে দোকানী আলুর দাম ২৫টাকা হাঁকানোতেই কুদ্দুস সাহেবের টেঁকো মাথায় খাঁড়া চুলের অস্থিত্ব ঠেঁর পেলেন। কুদ্দুস সাহেব নিয়মিত পেপার পত্রিকা পড়েন তাই তার জানা হয়ে গেছে জ্বালানী তেলের দাম আরেক দফা বেড়েছে তাই তিনি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন জ্বালানী তেলের দাম বেড়েছে কিন্তু আলুর দাম ত বাড়েনি তাহলে আলুর দাম বেশি চাইছো কেন ? জবাবে দোকানী কিঞ্চিত তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো গোডাউন থেকে ত আর আলু খালি পায়ে হেঁটে কাঁচা বাজারে ঢুকেনা। গাড়িতে করেই আনতে হয়। আলুর পথ খরচ যদি বাড়ে তাহলে কি আর আগের দামে পাবেন ? কুদ্দুস সাহেব এবার মুখে কুলুপ আঁটলেন। আর কোন বাক্য ব্যয় না করেই ৩কেজির বদলে ২কেজি আলু সহ অন্যান্ন সদাই নিয়ে ঘরে ফিরলেন উদাস ভঙ্গিতে। যারা তিন'কে ছয় বানাতে সিদ্ধহস্ত তাদের দৈনন্দিন পাতে ১৮টাকার আলু ২৮টাকায় পৌছালেও কোন প্রভাব ফেলেনা কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে কুদ্দুস সাহেবদের "সাহেব" উপাধীটাই যেন ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছে। কাঁচা বাজারের কোন এক পণ্যের দাম যদি বাড়ে তবে সেই দাম অন্য পণ্যকে প্রভাবিত করেনা কিন্তু জ্বালানী তেলের দাম বাড়লে সব কিছুর দাম হু হু করে বাড়তে থাকে কারণ জ্বালানী তেলের সাথে সব কিছুই সংশ্লিষ্ট।
আড্ডার টানে বন্ধুদের কাছে যাবো, প্রতিদিনই যাই। আমার পরিচিত অনেক রিক্সাওয়ালা আছে যাদেরকে ডাকতে হয়না ইশারা করলেই চলে আসে। বলতেও হয়না আমার গন্তব্যস্থল কারণ তারা জানে আমি স্বাভাবিক ভাবে কখন কোথায় যাই। তেমনি পরিচিত এক রিক্সাওয়ালাকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলাম ছুটে এলো আগের মতো। কিন্তু তার মুখ ফ্যাকাশে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কিছু কি হয়েছেরে ? তখন সে বললো এখন থেকে আর দশ টাকায় যাবো না ভাইজান কিছু বাড়ায়ে দিতে হবে। আমি বললাম দাম ত তেলের বেড়েছে তোমার না। তোমার রিক্সাতে ত আর তেল লাগেনা তাহলে তুমি ভাড়া বাড়াচ্ছো কেন ? সে বললো আমার রিক্সায় তেল লাগেনা ঠিক কিন্তু আমার ঘরে ত তেল জ্বালাতে হয় আর ওই তেল আমি রিক্সা চালিয়েই কিনি। আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না, নিশ্চুপ হয়ে রিক্সার সিটে বসে পড়লাম রিক্সাও তার চেনা গন্তব্যে আমাকে নিয়ে ছুটে চললো।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম যতখানি বেড়েছে, বাংলাদেশে বেড়েছে তার চেয়ে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনের ৭০ ভাগই এখন চলে যাচ্ছে খাদ্য কিনতে। গত এক বছরে দেশে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ আর পাম তেলের ৩৩ শতাংশ। অথচ অন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩৩ ও ২০ শতাংশ। ইউরোপ ও আমেরিকায় চিনির দাম বেড়েছে ১৪ ও ৮ শতাংশ আর বাংলাদেশে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। তেল-গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বাস ও অন্যান্য গণপরিবহনের ভাড়াও নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্তু পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষ ভাড়া আদায় করে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে কিছু জরিমানা আদায় করা হয়। পরে সব কিছু চলে পরিবহন মালিকদের ইচ্ছামতো। সরকারনির্ধারিত ভাড়া কোনো দিনই কার্যকর হয় না। এমনকি জরিমানার টাকাটাও মালিকরা আদায় করেন ভাড়া বাড়িয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষের যতটুকু সমস্যা হওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি সমস্যা হয় সরকারের তদারকির অভাবে। প্রশাসনিক দুর্বলতা মানুষকে বেশি ভোগায়। তাই দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করে রাখতে প্রশাসনিক নজরদারী আরো কঠোর ভাবে বাড়াতে হবে নইলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে দেশটা একদিন সত্যি সত্যি মগের মুল্লুকে রূপ ধারণ করে ফেলতেও পারে।
এবার অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মানবিক একটা বিষয় তুলে না ধরলেই নয়। জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় সবচে বেশি বিপাকে পড়েছে প্রেমিকের দল। তারা এখন আর আগের মতো যখন তখন তাদের প্রেমিকাদের সাথে দেখা করতে পারছেন পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে। পারছেন না আগের মতো ভালো কোন রেষ্টুরেন্টে গিয়ে প্রেমিকার পছন্দ অনুযায়ী খাবারের অর্ডার দিতে। বিবাহিত প্রেমিকের দলরাও পারছেনা তাদের বৌয়ের মন রক্ষা করতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্ব গতির কারণে। তাই তাদের মনে সর্বদা বিষন্নতা বিরাজ করছে। তাদের মাথাও ঠিক মত কাজ করছেনা চাহিদার যোগান না হওয়ার কারণে। তারা এখনো কিছুটা শান্ত অবস্থায় আছে কিন্তু তাদেরকে অশান্ত করা বা বিরক্ত করা ঠিক হবেনা কেননা প্রেমিকের দল যদি একবার জ্বলে উঠে তাহলে তাদেরকে নিভানোর সাধ্য কারোর হবেনা। তাদের প্রেমের খেসারত দেশকেই গুনতে হবে। ঘসেটি বেগমের প্রেমের খেসারত দিতে গিয়ে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ট্রয় নগরীও ধ্বংস হয়েছিলো হেলেনের প্রেমের খেসারত দিতে গিয়ে। ইতিহাসের লেজ ধরে টান দিলেই দেখা যাবে প্রেমের টানাপোড়নে কত দেশ, কত রাজা-মহারাজা ধ্বংস হয়ে গেছে অকালেই। তাই সরকারকে এসব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রেমিক গোষ্ঠীরা যদি একবার ফুঁসে উঠে তবে দেশ নয় গোটা পৃথিবীকেই ধ্বংস করে দেবে। তাই জ্বালানী তেলের দামের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকারকে এখনি দরকারী পদক্ষেপ নিতে হবে নইলে কে জানে কাল কি হবে...
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২৪শে সেপ্টেম্বর ২০১১ খৃষ্টাব্দ।