মেঘলা আকাশ। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি। নাবিলের প্রিয় একটা আবহাওয়া। ঘুম থেকে উঠেই বিছানার মাথার কাছের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকায় ৫ম শ্রেণীতে পড়া ছোট্ট নাবিল। উঠানময় কাঁদা। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। নাবিলের নানা ছোট্ট একটা কোদাল হাতে কাঁদা চাঁচছেন। ফুলের টব গুলতেও পানি জমেছে। নাবিল ঘুম ঘুম চোখে বের হয় উঠোনে। সব শক্তি খাটিয়ে বড় টব টা একটু কাত করে পানি ফেলে। নাহলে গাছের গোঁড়া তো পচে যাবে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়াতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ছিটা। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। কদিন যা গরম পড়েছিল,উফফ।
খিচুড়ির গন্ধ আসছে। নানি খিচুড়ি রাঁধছে। গন্ধে সারা বাড়ি মৌ মৌ। নিশ্চয়ই নতুন পোলাওয়ের চাল। দৌড়ে যায় নাবিল রান্নাঘরে। চাকা করে বেগুন কেটে রাখা আছে, একটু হলুদ মাখানো। ৩ টা ডিম ও রাখা। মনটা অকারনেই খুশি হয়ে ওঠে নাবিলের। আম্মু বাসায় নেই। স্কুলে গেছে পড়াতে। কি দরকার পড়ানোর? প্রতিদিন পড়াতে হবে ???একদিন না পড়ালে কি হয়?
একা একাই দাঁত মাজে নাবিল। ফ্রেশ হয়ে আবার জানালার ধারে বসে। বৃষ্টির দিনের মধ্যে কেমন একটা আনন্দ আছে। নানা উঠোনটা পরিষ্কার করে বিজয়ীর বেশে ফিরছে। এখন নানা খবরের কাগজ পড়বে আর নাবিলকে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করবে, যেটা নাবিলের মাথায় কিছেতেই ঢুকবে না।
কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। রিমোট টা নিয়ে টিভি ছাড়তেই সকালের খবর দেখান শুরু হল। উফফ!!! বিরক্তিকর। আম্মু আসে না কেন? আম্মু আজ বেতন পাবে। নাবিলের জন্য নতুন বই নিয়ে আসবে। আম্মু আসে না কেন ???
নাস্তা খাওয়া শেষ। পরীক্ষা শেষ। পড়ার কিচ্ছু নেই। পুরানো গল্পের বই গুলো ও মুখস্ত হয়ে গেছে। পাশের বাসার নীলাভ্র ভাইয়ার আছ থেকে আনা বই গুলো ও পড়া শেষ। অস্থির লাগে নাবিলের। নানি দুপুরের রান্না বসিয়েছে। কই মাছ কাটা হচ্ছে। নাবিলের কাজ নেই, তেমন কোন এলাকার বন্ধু ও নেই। নানির রান্না দেখে তার অবসর কাটে। কই গুলো লাফাচ্ছে। গতকালের কাঠের চুলার ছাই গুলো কই এর গায়ে ভাল করে মাখিয়ে সেগুলোকে বটির উপর থেকে নিচে টান দেওয়া হচ্ছে। তারপরও ওগুলোর লম্ফ ঝম্ফের শেষ নেই। একেই বলে কই মাছের প্রাণ। আম্মু আসে না কেন??? আম্মু আসলে এত্ত মজার একটা জিনিশ দেখতে পেত।
রান্না প্রায় শেষ। আর ভাল্লাগছে না। এখন কি করা যায় ?? নাবিলের মন ভাবে। আরেকটু টিভি দেখি। নাহঃ হিন্দি ছিনেমার মারা মারির দৃশ্য হচ্ছে। কার্টুন নেটওয়ার্ক এ ও বাচ্চা মার্কা কার্টুন দেখাচ্ছে। ধুর.।.।.। আম্মু আসে না কেন??? আম্মু আজ একটা নতুন গল্পের বই নিয়ে আসবে।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। স্কুল শেষে নাবিলের কর্মজীবী মা ঘরে ফেরে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নাবিলের সাথে তার মা'র প্রথম দেখা। নাবিল উশখুশ করতে থাকে। নাহ!!! এখন বই চাওয়া যাবে না। আম্মু ক্লান্ত। ভাত খাবার পর দেখা যাবে। নাবিলের মা গোছল সারে, দুপুরের ভাত খাওয়া হয়। তাও বই বের হয় না। মনমরা মুখ নিয়ে নাবিল এঘর ওঘর করে। এরপর এত্তগুলো ছাত্র ছাত্রি পড়তে আসে। আম্মু এত্ত ছাত্র ছাত্রী পড়ায় কেন? স্কুলে তো পড়ায়েই, ঘরেও পড়াতে হবে??? আম্মু আমার সাথে একটুও কথা কেন বলে না ??? আম্মু কি আমাকে ভুলে গেল??? আমার বইয়ের কথাও ভুলে গেল??? অভিমানে নাবিলের চোখে পানি চলে আসে। নাহঃ কোন ভাবেই আম্মুকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে কষ্ট পেয়েছে।
সন্ধ্যার পর সবাই চলে যায়। কাজ নেই। নাবিল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাস্তার সোডিয়াম বাতির আলো আম গাছটার উপর পড়েছে। পাতার ফাঁক দিয়ে ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটা দেখা যায়। পেছনে কার যেন পায়ের আওয়াজ। পেছনে ফিরেই নাবিলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ১ টা না, ২ টা না, তিন তিন টা বই হাতে আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। নাবিল বই গুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই একটাই তো বন্ধু আছে ওর। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জন্মদাত্রীর মুখের পরিতৃপ্তির হাসি দেখার সময় নাবিলের নেই এখন।
বহু বছর পার হয়েছে। নাবিলের এখন সময় কাটাবার জিনিশের অভাব নেই। আসলে, সময় ই নেই, যে সে কাটাবে। সকালে উঠেই ফেসবুকে দেখে মা দিবস মা দিবস করে মানুষজন হুল্লোড় তুলেছে। আজ নাকি মা দের দিবস। আজ মাকে ভালবাসতে হবে। নিঃশব্দে হাসে সে। মা কবে পণ্য হল?
সব পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমাদের ফলো করতে হবে? মা বাবাদের তো তারা বুড়ো বয়সে ব্রিদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। আমাদের সেটাও ফলো করতে হবে??? সারাদিন এই হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে স্বপ্ন পুরন করা মানুষ গুলোর কি আমাদের কাছে বছরে একদিনের ভালোবাসা পাওনা??? আমি আমার মা কে তথাকথিত মা দিবসের ভালোবাসা জানাব না। মুখে উচ্চারনের প্রয়োজনও মনে করি না। বাহারি পোস্ট আর ওয়াল পেপারে ভালবাসাও জাহির করব না। মাকে মনে করে ছোট্ট একটা হাসি হাসলাম। আমি যেমন ই আছি ভাল আছি, বেঁচে আছি, হাসছি। মা দিবসে সন্তানের হাসি থেকে বড় উপহার আর কি হতে পারে ???