আজ বাদে কাল ঈদ। গাঁয়ের কথা, মা-বাবার কথা, কলির কথাও মনের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে । একধরণের অস্থিরতা পেয়ে বসে শ্রাবণকে। পড়ার টেবিলে বসে স্মৃতির অ্যালবাম থেকে অনেক ছবিই উল্টালো ও। তারপর আনমনে ‘ভালোবাসার শ্রাবণ আকাশ’ নামের উপন্যাসটি নেড়েচেড়ে দেখছিলো।
দরজার আড়ালে এলো ঐশী। দাঁড়ালো টেবিল ঘেঁষে। তলপেট ঠেকলো টেবিলের আচ্ছাদনে। শ্রাবণ তাকালো সেদিকে। একটা উত্তেজক ঘ্রাণ ঘরের বাতাসে মিশে শ্রাবণকে করে তুললো চনমনে। ঐশীর মুখের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণ। খুব সুন্দর করে বাঙ্গালি ললনার মতো পরিপাটি ঐশীর সাজগোজ, বেশবাস। ভালো লাগলো শ্রাবণের- পোষাকের ফোকর গলিয়ে ঐশীর শরীরের যেটুকু চোখে পড়ে, তার সবটুকুই যেন মাখনে গড়া। একেই বলে নিটোল কিশোরী।
ঐশীই মুখ খুললো- চলুন তো! এখন কেউ পড়ার টেবিলে থাকে?
-কোথায় যেতে চাচ্ছো?
-পড়ে বলবো। আগে উঠুন তো—
শ্রাবণ টেবিল ছেড়ে দাঁড়ায়।
ঐশী পাশের ঘর থেকে আকাশ-নীল জিন্সের প্যান্ট আর কালো রঙের গেঞ্জিটা শ্রাবণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে- নিন, কাপড়টা বদলে নিন। এ পোশাকে সুন্দর মানায় আপনাকে।
সুবোধ বালকের মতো পোষাক বদল করে নেয় শ্রাবণ; আয়নার কাছে গিয়ে চুলটা ব্রাশ করে বলে- চলো।
ক’মিনিট পরই রাস্তায় নামে ওরা। ঐশী মৃদু হেসে প্রশ্ন করে শ্রাবণকে- বলুন তো, আজ যাবো কোথায়?
শ্রাবণ মেয়েদের মতো ছেলেমানুষি করে- আমি কী করে বলবো? তুমিই তো নিয়ে যাচ্ছো! যেখানে নেবে, আপত্তি করবো না।
শ্রাবণের কথায় ঐশী নিজেকে মুরুব্বির আসনে বসিয়ে বিজ্ঞের মতো বলে- এইতো লক্ষ্মীছেলের মতো কথা।
শ্রাবণ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে- লক্ষ্মীছেলের মতো আজ দেখছো—অন্যদিন শিবের মতোও দেখবে। তোমরা শিবরাত্রি করো না?
-আপনি শিব সম্বন্ধেও জানেন দেখছি!
-জানতে হয়েছে, শুধু তোমার জন্যে।
-কী জানেন, বলুন তো?
-সময় হলে জানবে। এখন কোথায় যাচ্ছো, চলো।
ঐশী আনমনা হয়ে বলে- আপনার শিব হতে ইচ্ছে হয় বুঝি?
-হ্যাঁ। সত্যম, শিবম, সুন্দররম।
-বাহ! ঐশী শবারণের চোখে মায়াবী চোখে তাকায়।
শ্রাবণ ওর পিঠে হাত রেখে বলে- চলো রিকশা নিই।
-না, রিকশা নেবো না। স্কুটার নিই, চলো।
ঐশী হাতের ইশারায় একটি স্কুটার থামতে বলে। চালক ব্রেক কষে। পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করে- কই যাইবেন আপা?
-টিএসসি। যাবা?
-চলেন।
-কত?
-ত্রিশ টাকা দিয়েন। আমি ওদিকেই যামু।
ওরা স্কুটারে উঠে বসে। চালক টান দেয়। ডানে-বায়ে জ্যাম উপেক্ষা করে সামনে এগোয় স্কুটার।
অল্প সময়ের ব্যবধানে টিএসসি এলাকায় এসে পড়ে ওরা। ‘ডাস’ এর পাশে এসে থামে স্কুটার। ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ে। রোকেয়া হলের কোল ঘেঁষে আইল্যান্ড দিয়ে কিছুক্ষণ সামনের দিকে লক্ষ্যহীন হাঁটতে থাকে। চোখে পড়ে ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মাখামাখি আর অন্তরঙ্গতা। হিল্লোল বয়ে যায় ঐশীর মনে। একসময় শ্রাবণের বাঁ হাতটি বোগলে চেপে ধরে ঐশী। শ্রাবণ লজ্জা পায়, এদিক-ওদিক তাকায়। এলাকার যুগলবন্দি প্রেমিক-প্রেমিকাদের নজরে পড়ে যায় ওরা। শ্রাবণ পরিচিত কারো মুখ চোখে না-পড়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে ফরিয়াদ জানায়।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা জগন্নাথ হল অবধি এসে যায়। আবার পেছনে ফেরে। রোকেয়া হলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হকারদের টক-ঝালের ভ্যানগাড়ি চোখে পড়ে ঐশীর। বড় বড় বরই ওর দৃষ্টি কাড়ে। কপোত-কপোতীর মতো জুটিবাধা নারী-পুরুষের হাস্যোজ্জ্বল কেনাকাটা বিলি দিতে দিতে টিএসসির কাছে এসে পড়ে ওরা। প্রেমিক-প্রেমিকার অবাধ মেলামেশা, পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে, কোলে মাথা রেখে, হাঁটুতে থুতনি রেখে, হাতের পিঠ গালে ঘষে কত-না প্রকার-প্রকরণে চলছে ওদের মনোরঞ্জন! তা দেখে ঐশী কাতর চোখে তাকায় শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ চোখ কুতকুত করে।
একসময় ওরা সোপার্জিত স্বাধীনতার পাশে এসে দাঁড়ায়। এখানেও জুটি। শ্রাবণ বললো- চলো, একটু সামনে ঐ ফাঁকা জায়গায় বসি।
নতুন রোপিত তল্লাবাঁশের ঝাড়টার পাশে জায়গা করে নেয় ওরা। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তার বাতিগুলো আলো-আঁধারির রহস্যময়তায় স্বপ্নিল করে রেখেছে এলাকাটা। ঐশী শ্রাবণের পাশে বসে। শ্রাবণ আরও কাছাকাছি হয়ে ঐশীর পিঠের ওপর হাত রেখে ওকে আপন করে নেয়। গদগদ হয়ে ঐশী শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে স্বপ্নীল আবেশে চোখ বুজে।
(চলবে)
উপন্যাসঃ নির্জনতার সমুদ্রে অবগাহন
লেখকঃ কবি বাবু ফরিদী ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৬ রাত ১১:২৮