১৯৮৫ সালের কোন এক ভোর। একদল শিশু বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসছে একটা বিল্ডিং এর নির্দিষ্ট একটা কক্ষকে গন্তব্য ধরে। উদ্দ্যেশ্য- সবার আগে পৌঁছানো এবং পছন্দের প্রথম সারিতে বসা। কিন্তু সবার লক্ষ্য যদি একই থাকে তাহলে সীমাবদ্ধ আঙ্গিনায় কাউকে না কাউকে তো পেছনে বসতেই হবে। এ যেন অনেকগুলি ঘোড়ার রেসে কেউ এগিয়ে আর কেই পিছিয়ে থাকা। তবু ও নিয়মের ব্যতিক্রম না করে প্রতিদিন সবাই এই রেসে অংশ নিয়েছে। পর পরাপর যা ই হোক, রেসে যারা অংশ নিয়েছে সবাই যে ঘোড়া- যা কিনা দ্রুতগামী। আমাদের প্রাইমারী স্কুলের ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসের শিক্ষার্থীদের এ ছিল নিয়মিত চিত্র। সেই রেসের আমি ও ছিলাম একজন। আসাদ, জিলু, রনি, মরিয়ম, বেলাল, আশিক, লুকু, শামসু, সায়েম, তুহিন, জামি, খাদিজা, জুয়েল মোল্লা, তাজ উদ্দিন, মাহবুব, নাজমুন, মহসিন, হুসনে আরা সবাই।
এই তোরা সবাই আজ কোথায়? কেমন আছিস রে? সব সময় সামনে থাকার জন্য সময় এবং বাস্তবতার রেসে আজো কি অংশগ্রহন করা হয়? নাকি অনেকগুলা গাধার রেসে নিজেকে প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ভেবেই আত্মতুষ্টির রাজপ্রাসাদে বসে রঙ্গিন বেলুনে বাতাস নিচ্ছি আমরা সবাই!? এই তুই না একদিন গরুর রচনা লিখতে গিয়ে লিখেছিলি “ গাধা খুব ধীরে চলে এজন্য গাধাকে আমি অপছন্দ করি।“ তুই না ঘরের ছাঁদ দেখার চেয়ে জানলা দিয়ে বিশাল আকাশকে দেখতেই বেশি ভালবাসতি! মনে পরে স্কাউটের প্রশিক্ষণে একজন জুয়েল মোল্লা’র কথা? পিচ্ছি দেহটা কি করে কঠোর শৃঙ্খলার সাথে লেফট-রাইট বলে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে একদিন দিগন্ত স্পর্শ করতে চেয়েছিল? মনে কি পড়েনা, বৃষ্টির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমরা একদিন আকাশের দরোজা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম? ফুটবলার পেলে’র ডান পায়ের জাদু আর বাম পায়ের বিদ্যুৎ বেগের কথা হেডমাস্টার স্যারের মুখে শুনতে শুনতে একদিন “জুলে রিমে” কাপটা স্পর্শ করার অঙ্গিকার করেছিলাম মনে মনে। এই তো সেদিনও। নাইট রাইডার, ম্যাকগাইভার অথবা সিক্স মিলিওন ডলারম্যান নিয়ে আমাদের মুখে খই ফুটত! কোথাও কেউ নেই’র বাকের ভাইয়ের ফাঁসী না দেয়ার দাবীতে আমরাই তো এই সেদিনও রাস্তায় নেমেছিলাম। ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর ক্ষোভে ঢিল ছুঁড়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদের বাসায়। কি আবেগ!!! মেলায় যাইরে’র তালে তালে নৌকা ডুবিয়ে পানিতে ভিজে একাকার হয়ে কি আনন্দের হিল্লোলই না আমরা তুলেছিলাম! আর আজ কিনা সেই তুই, সমুদ্রের বদলে একটা পুকুর পেয়েই সন্তুষ্ট!? বিমানের বদলে একটা স্বর্ণের গহনাই তোকে বেশি সন্তুষ্টি দেয়! কেনরে আমাদের কি বঙ্গোপসাগর নেই? গলায় কলসি নিয়ে গাঙ্গে নামার দরকার কি? অন্ধকারে যাবি? কেন ফেন্সিডিল আর হেরোইন কেন? আমাদের তো সুন্দরবনের মত চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল একটা অন্ধকার আছে। ওখানে ডুব দে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সাথে খেলে করতে করতে টাইগারের মত মর। এই ‘ধুম’ অথবা ‘ডন’ অথবা দাবাং এ হলিউডের নিষ্ফল অনুকরণ ছাড়া আর আছে টা কি? এই পেয়েই তুই ‘ভেনিলা স্কাই’ অথবা ‘ লাইফ অফ পাই’ নামটা পর্যন্ত জানলিনা!!! আমাদের কি ‘জন্ম থেকে জলছি, স্রাবন মেঘের দিন নেই? আমাদের ও তো আছে ‘রানি কুঠির বাকি ইতিহাস’, ‘মনপুরার’ মত অসাধারন সৃষ্টি আর ‘গেরিলা'র মত ইতিহাস। যে কিনা এক সময় আকাশের দরজার সন্ধান করতো, সেই তুই আজ চার দেয়ালের জানলা খুঁজে পাচ্ছিসনা!!!?
আয়নায় নিজের চেহারা দেখিস মাঝে মাঝে? Fountain Pen এর ভাঙ্গা কোন অংশও কি আজ তোর সংগ্রহে নেই? নিজের পুরনো ছবিগু্লি? একিরে তোর সমগ্রামের ইতিহাসটাই যে তুই ভুলে যেতে বসলি!! এই তুই-ই তো সে। রাতের আকাশে লক্ষ কোটি তারার ভীরে নিজের তারাটা খুঁজে নিতে যার একটু ও সময় লাগতনা। আজ তোর চোখে এ কোন দেশী রঙ্গিন চশমা, যার ভেতর দিয়ে তুই বটগাছের ছায়াটাকে রক্তাক্ত করিস অবলীলায়!!! কোথায় গেল তোর বিশালতা।
এই তুই আজকে যে এতো বড় ডিগ্রিধারী একটা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স। তোর লেখাপড়ার খরচ কে দিয়েছে? তোর বাবা-মা? কত? কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল-হল, খাওয়া-দাওয়া, বিশাল বিশাল লাইব্রেরী, দামি দামি যন্ত্রপাতিতে ঠাসা ল্যাবরেটরি এতোসব সুযোগ তোকে কে করে দিল? সরকার? সরকারের টাকা কোত্থেকে আসে? শিক্ষার বাজেট কোত্থেকে হয়? খবর নে তোর পাশের বাড়ির মাটিকাটাওয়ালা লোকটার ট্যাক্সের টাকা কোথায় জমা হয়। কিভাবে খরচ হয়। আর সেই তুই কোনমতে একটা ডিগ্রি বের করেই সামান্য দুয়েকটা ডলার, পাউন্ড আর স্টারলিং এর লোভে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলি অন্যের সেবাদাস হতে! যে দেশ তোকে গড়ে তুলল নিজের রক্ত আর ঘামের প্রতিটা ফোটা দিয়ে, তার জন্য কিছুই দিতে তোর মন চায়না আজ!? সম্পদের যাকাত তো দিসই না। শিক্ষার যাকাতটা অন্তত দে। তোর ঘরের পাশে একটা আলোকিত মানুষের জন্ম দিলে তোর তো কমবে না । বিদ্যা তো কমে না। এই তুই নাকি রাজনীতি hate করিস!? রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে, মন্দ লকের হাতে চলে গেছে। তুই কবে থেকে ভাল মানুষ। তুই তো একটা জলজ্যান্ত কাপুরুষ। সামনে অন্ধকার দেখে নিজের ভেতরের আলোটাই যে বের করে আনতে পারেনা, সে কিনা জাতির শিক্ষিত ছেলে!!! সাতে-পাঁচে নেই, নাদুস-নুদুস, নপংসুক, একমুখী, স্বার্থপর একটা ভদ্রলোক! আর তুই। তুই ও তো রাজনীতির অসৎ গলিটিকে নিজের চলার পথ হিসেবে বেছে নিলি। স্রোতের তালে দশের মধ্যে এগারতম না হয়ে দশের একজন হয়েই রইলি তাহলে। একজন নেই ই, আরেকজন অসৎভাবে আছে। জাতি দাঁড়াবে কিভাবে মাথা উঁচু করে!? জাতির দরকার একজন সিরাজদ্দউলা, মহনলাল, তিতুমির, ক্ষুদিরাম, নুরলদিন,সূর্যসেন, ভাসানি কিংবা একজন শেখ মুজিব। আমাদের মধ্যে কেউ কি নেই একজন বেগম রকেয়া, প্রিতিলতা সেন, সুফিয়া কামাল বা একজন জাহানারা ইমাম?
বঙ্গোপসাগরের তীরে উন্মাতাল দাপাদাপি করছে একদল কিশোর-কিশোরী। পাশের স্লটেই অনুসরণের অনুপম সৌন্দর্যের বোতাম খুলে ভাঙ্গাগড়ার অনুরণন তুলছে একজোড়া প্রেমিক। অদূরে এক বৃদ্ধ দম্পতি সমুদ্রকে লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে আর দীক্ষার দিচ্ছে নিজেকে নিজের অপারগতায়। দৃশ্যমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা শিশু অবাক বিস্ময়ে হজম করছে আকাশ আর সমুদ্রের বিশালতা। ওর উপর কি ভরসা করা যায়? আশায় থাকা ছাড়া যে আর গতি ও নেই। কেউ একজন তো আসছেই। তাই আমি আশায়ই রইলাম। তোরা সবাই ভাল থাকিস। মাঝে মাঝে চিঠি দিস, সরি মোবাইল এ কল দিস। ডাকপিয়ন তো অসুখে ভুগতে ভুগতে মরে গেছে অনেক আগেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:২৩