আমার ছাত্রজীবন এবং চাকরিজীবন মিলিয়ে- সোজা কথা আমার মেস জীবনের কোন এক সময়ে আমার সাথে একই রুমে থাকত আমার সিনিওর একজন। দেশের একটা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে চাকরী করতো। আপাতদৃষ্টিতে খুবই মিশুক, হাসি-খুসি একজন মানুষ। কিন্তু আমি তার রুমমেট হওয়ার সুবাদে তার ভেতরের কুৎসিত রূপটা দেখতে পেরেছিলাম। সে ছিল চূড়ান্ত নেগেটিভ একজন মানুষ। কোন কিচুই সে পজেটিভলি দেখতে অভ্যস্থ ছিলনা। আর ছিল চূড়ান্ত হিংসাপরায়ণ। ধরুন আপনি বাইরে থেকে এসে তাকে আপনার একটি ভাল খবর দিলেন। সাথে সাথে সে এর একটি মন্দ দিক খুঁজে বের করবে এবং এইটা অর্জন করার পেছনে আপনার যে কোন অবদান নেই এটা প্রমান করার জন্য এর একটা দুর্বল দিক বের করে নিবে। ধরুন একজন যুক্তরাষ্ট্রের স্টুডেন্ট ভিসা পেয়ে খবরটা তাকে দিল। সে তাকে অভিনন্দন না জানিয়ে বলবে, “আরে এসব পশ্চিমাদের যতসব টাকা কামানোর ধান্দা। ওরা ভিসা ফী হিসেবে যে টাকাটা পাচ্ছে এর পুরুটাই এদের লাভ আর এই কারনেই তোমাকে ভিসা দিছে। এতে তোমার কোন কৃতিত্ব নেই”। অথচ একমাস আগে সে নিজে ও একই ভিসার জন্য এমবাসি ফেইস করে রিজেকটেড হয়েছিল। ধরুন আপনি নতুন কোন একটা কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। আশে-পাশের সবাইকে জানিয়েই আপনি কাজটা করতে যাচ্ছেন এবং সবাই যার যার মত করে পরামর্শ দিচ্ছে, কাজের অগ্রগতির খোঁজ খবর নিচ্ছে। একমাত্র ঐ লোকের মুখে ছিল তালা। এমনকি তার কাছে পরামর্শ চাইলে ও সে কোন মন্তব্য করতো না। খুব বেশি পিড়াপীড়ি করলে বড়জোর মিনমিনিয়ে বলত ‘ দেখ যেটা ভাল মনে করো, সেটাই করো’। অথচ কোন কারণে আপনি অনেক পরিস্রম করে ও এই কাজটা করতে ব্যর্থ হলেই সে সবার আগে সবার সামনে গলা ফাটিয়ে বলবে-‘ আমি আগেই না করছিলাম”। “আমি আগেই জানতাম এটা হবেনা”। যেখানে অন্যসব লোকজন এর ময়না তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত কেন আপনি ব্যর্থ হলেন।
এতক্ষনে আপনি নিশ্চয়ই চিনে গেছেন লোকটা কে। সে আপনার খুবই পরিচিত একজন। তবে নাম বলার দরকার নেই। কারন আপনি কতজনের নাম বলবেন!! এমন কেউ কি আছেন যার আশে পাশে এই ধরনের লোক নেই। বরং আমার মনে হয় আমাদের সমাজে এই টাইপের লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ধরাতে নেই, ছোঁয়াতে নেই, ঝুকিতে নেই, সৃষ্টিতে নেই, উপকারে নেই, পরামর্শে নেই। শুরুতে নেই- শেষে ও নেই। শুধু এই কথাগুলু বলার সময় এদের অস্থিত্ব টের পাওয়া যায়- ‘আমি আগেই না করছিলাম’ অথবা ‘ এটা করা উচিৎ হয়নি”।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ মোটামোটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে। এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আরেক পক্ষ লোক ছিল যারা কোন কিছুতেই প্রকাশ্যে ছিলনা। শুরুর দিকে এরা আলবদর লিডারদের সাথে গোপনে সম্পর্ক রাখত। কিন্তু যখনই দেখল দেশ প্রায় স্বাধীন হয় হয় অবস্থা তখনই এরা দলবেঁধে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। দেশে ১৪ তারিখের( ডিসেম্বরের) মুক্তিযোদ্ধা নামে একটা শ্রেণী আছে বলে আমরা প্রায়ই শুনি। এরা হচ্ছে সেই শ্রেণী। শুনেছি এই শ্রেণীটাই দেশে পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করে নিয়েছে এবং যথারীতি দেশের বারটা বাজিয়েছে এবং এখনো বাজিয়ে চলেছে। এসবই আমাদের শোনা কাহিনী অথবা বই পড়ে জানা কাহিনী।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ অথবা অন্য কোন সংগঠন অথবা সুশীল সমাজের কেউ যখন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির জামাতঘেঁষা হওয়ার সমালোচনা করে তখন এক শ্রেণীর লোকের মুখে খুব মায়াকান্না শুনবেন কাদের সিদ্দিকির মত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অসম্নান করে বলে। ধন্যবাদ বঙ্গবীর। ধন্যবাদ বাঘা সিদ্দিকি। আপনি দিগন্ত টেলিভিশনে গিয়েছেন বলেই, আপনি জামাতিদের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছেন বলেই কিন্তু এই দেশের কিছু মানুষ জীবনে প্রথমবারের মত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ এই শব্দটা উচ্চারণ করল। আপনি যখন আওয়ামীলীগে ছিলেন তখনো আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন। শুধু ঐ শ্রেণীর লোকজনের নয়নের মনি ছিলেন না তখন।
বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকেই যখন অন্ধভাবে জামাতের পক্ষ নিয়ে কথা বলে, জামাতের প্রচারপত্র, ওয়েবসাইট কে নিজের ওয়েবসাইট মনে করে নিজ দায়িত্বে এর প্রচার করে, জামাতের এজেনডা কে নিজের এজেনডা মনে করে এর প্রচারে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে তখন আমার সন্দেহ হয় এরা আসলেই বিএনপি’র রাজনীতি করে কি না। নাকি বিএনপি’র ভেতরে জামাতের চর (যেমনটা ইদানিং শুনা যায় ছাত্রলীগের ভেতরে শিবির)। আবার এই লোকটাই যখন জিয়াউর রাহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে বলে মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলে তখন আমার আর চিনতে বাকি থাকে না যে, এই লোকটাই সেই লোক। যে বিএনপিকে জামাত বানায় আবার সুযোগমত জিয়াউর রাহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাবার জন্য পাগল হয়ে যায়। আর মনে মনে ক্ষেত্রবিশেষ প্রকাশ্যে পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য বঙ্গবন্ধুর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে।
এরা এমন একটা শ্রেণী, এরা নিজেরা ধর্মকর্ম খুব একটা করেনা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেলে হিন্দু লোকের মাথায় বাড়ি দেওয়ার জন্য অথবা মন্দির ভাঙ্গার জন্য লাঠি-সরঞ্জাম নিয়ে সবার আগে দৌড় দেয়। এরা বাংলাদেশে মুসলমান, ভারতে হিন্দু, ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ত্রেলিয়ায় সাদা নামে পরিচিত। এরা কখনই কিছু শুরু করবেনা কিন্তু কেউ যদি সাহস করে শুরু করে সফল হয় তাহলে কৃতিত্বের দাবী নিয়ে নির্লজ্জের মত সামনে এসে দাঁড়াবে আর ব্যর্থ হলে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়বে। এরা নিজেরা রাজনীতি করবেনা কিন্তু নষ্ট রাজনীতির ফায়দা তলে তলে এরাই নিবে আর প্রকাশ্যে রাজনীতিকে ধিক্কার দিবে। কেউই যদি রাজনীতি না করে তাইলে দেশ কিভাবে চলবে এই উত্তর এদের জানা নেই। নিষিদ্ধ জিনিসের দাম উচ্চ থেকে উচ্চতর হয় এদের অতিব্যবহারের ফলে, কিন্তু প্রকাশ্যে বিখ্যাত জিনিসের সুগন্ধে এদের সামনে দাঁড়ানো মুশকিল। মানুষের আবেগ নিয়ে এরা খেলা করে কিন্তু নিজেরা কখনো আবেগপ্রবণ হয়না। মানুষের বিবেকের কাছে এরা ভ্রান্ত প্রশ্ন রাখে কিন্তু নিজেদের বিবেকবোধকে এরা সবসময় কবর দিয়ে রাখে। এরা মানুষকে জনগণ বলে ডাকে অথচ নিজেরা কখনো জনগণ হয়না। এরা মানবতার বুলি আওরায় অথচ নিজেরাই হয় সবচেয়ে অমানবিক। এরা জনগণকে ধর্মের দোহাই দেয় আর নিজেই হয় সবচেয়ে অধার্মিক। এরা ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির ভেতরে একটা কুৎসিত কালো শরীরকে লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে রাখে কালো চশমার ভেতরে একটা ভয়ঙ্কর রক্তচক্ষু। সবচেয়ে বড় কথা এরা নিজেরা যা করেনা অন্যদেরকে তা করতে বলে।
আমার কাছে রাজাকারের সংজ্ঞা এরাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৩০