২০০৪ সাথে আমার বাবা একবার ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ডায়বেটিকস থেকে জিবিস হয়ে উনি প্রায় প্যরালাইজড হয়ে দিয়েছিলেন। চট্রগ্রামের সব ডাক্তার উনার চিকিৎসার জন্য ঢাকার বারডেম হসপিটালে ভর্তির জন্য বলেছিলো। প্রায় মুমুর্ষ অবস্থায় তাকে বারডেম হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিলাম। আমি তখন ছিলাম ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র।
আমার নানা বাড়ী ঢাকা শাহজাহানপুরে। সেখান থেকে প্রতিদিন যেতাম বারডেমে বিভিন্ন কাজেই।
দিন তারিখ মনে নেই- বারডেম হসপিটালে উপরে যাবার জন্য লিফট ছিলো। কলাপসিপল গেটে পাস দেখিয়ে তার পরে লাইনে দাঁড়িয়ে লিফটে উঠতে হয়। আমি লিফটে উঠবো আমার সামনে আরো ৪/৫ জন দাঁড়িয়ে ছিলো আর পিছনেও ছিলো আরো ৬/৭ জন। এই সময়ে ততকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন হঠাৎ করে সেখানে হাজির হয়েই আমাদের সাথে লাইনে দাড়ালেন। ওই খানে উপস্থিত হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী এসেই সাথে সাথে উনাকে বললেন-স্যার আগে দাড়ান, আগে দাঁড়িয়ে যান। উনি লাইন ভেঙ্গে আগে যেতে চাচ্ছিলেন না- এর পরে কিছুটা জোড়াজুড়িতে উনি সবার সামনে গিয়ে দাড়ালেন। উনি একটু লজ্জিত ভাবে আমাদের দিকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে বললেন- আপনারা কেউ মাইন্ড করেন নাই তো? পেছনের দুই-তিন জন বলে উঠলো-না, না ঠিক আছে কোনো সমস্যা নাই।
এর পরে লিফট নেমে আসলো-উনি লিফটে উঠলেন, সাথে ওনার সাথের দুইজন ছিলো তারাও উঠলো-সম্ভবত উনার সিকিউরিটি। কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো কোনো পাবলিক আর উঠছিলো না। উনি বললেন –আরে আসেন আসেন আপনারাও আসেন, সঙ্কোচের কিছুই নাই। আপনারাও যাবেন,আমিও যাই। বারডেমের ওই পুরান লিফটে ২০ জনের মতন মানুষ আটে, এর পরে ঠাসাঠাসি করে অন্যরা লিফটে উঠলো। উনি নিজে থেকেই সবার সাথে কুশল বিনিময় করছিলেন, কার কে অসুস্থ। উনিও উনার এক আত্নীয়কে দেখতে যাচ্ছেন। আমি ছিলাম লিফটের এক কোনায়। উনি আমাকে চিনেন না- “কিন্তু হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি খবর আপনার?” আমি বলেছিলাম-আমার বাবা খুব অসুস্থ। উনি আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন- কোনো চিন্তা করবেন না। এখানে চিকিৎসা খুব ভালো। আপনার বাবা শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবেন। আমার রিলেটিভও এখানে আছে।
মানুষের প্রান প্রিয় কেউ অসুস্থ হলে স্বভাবতই সে উদ্বিগ্ন হয়ে যায়, অন্যরা সবাই অভয় দেয়। উনার শান্তনাকেও আমি স্বাভাবিক ভেবেছিলাম। লিফট ১০ তলায় পৌছালে উনি নেমে যান। আমার গন্তব্য ছিলো ১২ তলায়। সামান্য ১০-১৫ মিনিট হয়তো উনি ছিলেন আমাদের সাথে।
আমি যখন স্কুলে ছিলাম তখন একটা কবিতা পড়েছিলাম(নামটা মনে আসছে না)।
সেটার সারমর্ম ছিলো- কবি একদিন একটি গান গেয়েছিলেন সেই সুরেলা গানটি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো। তিনি সেটা দেখতে পাননি। তিনি একটি তীর হাওয়ার দিকে ছুড়ে মেরেছিলেন সেটা এতো দ্রুত গতীতে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো যে তিনি সেটাও দেখতে পাননি। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দুটোই ভুমিতে ফিরে আসে। সেটাও কবি বুঝতে পারেননি। কিন্তু অনেক অনেক দিন পড়ে তিনি যখন সবুজ মাঠে বিচরন করছিলেন তিনি সেই সুরেলা সু-মধুর গানটি কোনো রাখাল বা কৃষকের মুখে শুনতে পেয়েছিলেন। আর তার নিক্ষিপ্ত তীরকে তিনি খুজে পেয়েছিলেন একটি গাছের সাথে বিদ্ধ অবস্থায়। এখানে তীর আর গান রুপক অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছিলো। গানটিকে তুলনা করা হয়েছিলো সুন্দর ব্যাবহার আর তীর টিকে তুলনা করা হয়েছিলো রুষ্ট কঠোর ব্যাবহারের সাথে। মানুষ সুন্দর কোমল/ রুষ্ট ব্যাবহার ভুলে যায় না সেটা আঘাত প্রাপ্ত মানুষ বহু বছর মনে রাখে-আপনারা হয়তো সেই কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন।
সেই দিন আজকে ৭ বছর পার হয়ে গেছে। কি ভাবে যেন জীবন থেকে ৭ বছর চলে গেছে- সময় অনেক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, সরকার পরিবর্তীত হয়ে গিয়েছে। আমার পিতাও একজন সুস্থ মানুষের মতন হাটাচলা করেন । এই সাত বছরে জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছি- কিন্তু সেই দিনে তার সাথে সামান্য কিছু সময়ের জন্য একটি লিফটে অবস্থানের কথা এখনো মনে আছে। কবির সেই সুরেলা গানের মতন।
গতকালকে অফিসে দুপুরে লাঞ্চের ফাকে অফিসে বসে রেষ্ট নিচ্ছিলাম, তখন আমার কলিগ পত্রিকা পড়ে উচ্চস্বরে হাসছিলেন। কিছু ক্ষন পর পর উচ্চ স্বরে হো হো হা হা করে হেসে উঠছিলেন। আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করার পরে উনি আমাকে পত্রিকা পড়ে শুনাচ্ছিলেন- এহসানুল হক মিলনের নামে ৭০ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষনের পর হত্যা সেই মামলার বিষয়ে, আরো বলছিলেন ছিনতাইয়ের মামলার বিষয়ে। আমি পত্রিকা পড়ে হতভম্ব। পৃথিবীর সেরা কমেডিয়ান কেও হার মানাবে আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা। উনি শতাধিক মামলায় এখন ৪৩৫ দিন ধরে জেলে আছেন। আরো নতুন নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। আর সরকার এই ব্যাপারে ছায়া মদদ দিচ্ছে। ছবিতে দেখলাম উনি হুইল চেয়ারে বসে আছেন, চরম অসুস্থ মনে হচ্ছিলো।
যথেষ্ট খারাপ লাগলো পত্রিকা পড়ে। এক সময়ে আমার বাবা অসুস্থ থাকায় আমি ছিলাম দিশেহারা-উনি আমার অপরিচিত হয়েও আমাকে অভয় দিয়েছিলেন, শান্তনা দিয়েছিলেন- তার সেই কথা কবির সুরেলা গানের মতই আমার মনে আছে।উনি আমাকে চিনেন না বা চিনবেন না কখনোই- তবে আমি যদি এখন তার সামনা সামনি হতাম তাহলে আমি তাকে আজ আশস্ত করতাম সেই দিনের মতন। বলতামঃ ঃ ডোন্ট ওয়ারি বস !! সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে আবারো পরিবর্তন আসবে।