গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে যখন আমি অফিসের কাজে ব্যাস্ত ঠিক তখনই আমার মোবাইলে একটি ফোন আসলো। আমার বন্ধু এবং এক্স কলিগ তানিম আমাকে ফোন দিলো।
বললো... দোস্ত তুই কই? অফিসে?
আমি- হ্যা।
তানিম-তুই বারান্দায় যা এর পরে আমাকে ফোন দে।
আমি বারান্দায় গিয়ে তানিমকে ফোন ব্যাক করলাম।
তানিম ফোন রিসিভ করেই বললো- দোস্ত তুই বর্তমানে যে জব টা করস, তার চাইতে আরো বড় কোম্পানীতে আর বর্তমানের চাইতেও ১০০০০ টাকা বেশী বেতন যদি পাস, তুই কি যাবি?
আমি উত্তর দিলাম হোয়াই নট?
তানিম বললো- তাইলে তর সিভি তুই আমাকে মেইল কর আমি সেটা এইচ আর ম্যানেজারের কাছে ফরোয়ার্ড করেদিচ্ছি।
আমি তাকে আমার সিভি মেইল করে দিলাম।
যথা রীতি দুই দিন পরেই সেই কোম্পানী থেকে ফোন আসলো। আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য কল করা হয়েছে। ঠিকানা দিয়ে বললো আগামীকাল সকালে ১০টায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ওদের কোর্পোরেট হেড অফিসে উপস্থিত থাকতে।
পরের দিন আমি বাসা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ইন্টারভিউ দেয়ার উদ্দেশ্যে সেই অফিসে গেলাম। বরাবর ১০টায় ওদের রিসিপশনে হাজির হলাম। অফিসের ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তীব্র ঠান্ডা। আমি বর্তমানে যেখানে জব করি সেখানেও ঠান্ডা তবে এতো কড়া ঠান্ডা না। বাইরের তীব্র রোদের থেকে হঠাৎ তীব্র ঠান্ডায় প্রবেশ করলে যে অবস্থা হয়। ঘর্মাক্ত শরীরের শীত করতে লাগলো।
রিসিপশনে তিনজন মেয়ে বসেছিলো আর ক্রমাগত ফোন রিসিভ করছিলো। আমি বললাম আমার নাম আর আমি কি জন্য এসেছি- আমি আসবো সে জন্য আগে থেকেই একজন দপ্তরী কে বসিয়ে রাখা ছিলো। রিসিপশনের মহিলা কিছু বলার আগেই ঐ ব্যাক্তি বললো আপনি কি ইমন সাহেব? আমি বললাম জ্বী। উনি বললেন আসেন আমার সাথে- উনি আমাকে অফিসের ভিতরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। ভিতরে একটি রুমে আমাকে বসতে বললেন। রুমটি সাজানো গুছানো আর ওদের কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ভর্তি। রুমের ভেতরে ঢুকে আমি কিঞ্চিত অবাক হলাম। আমার পুরোনো আরো একজন কলিগ জামিল সেখানে আছে। আমার বন্ধু তানিম আমার সিভির সাথে ওর সিভিও এই কোম্পানীর এইচ আর ম্যানেজারের কাছে ফরোয়ার্ড করেছিলো। জামিল আমাকে দেখে হেসে কথা বলা শুরু করলো। আমাদের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য কুশল বিনিময় চলছিলো। আর এই রুমটা এতোটা ঠান্ডা ছিলো মনে হচ্ছিলো আমি আন্টার্ক্টিকার চাইতেও হিমশিতল কোনো যায়গায় আছি। ঠান্ডার লাভা স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম।
কিছুক্ষন করেই জামিলের ডাক পড়লো। সে ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখী হবার জন্য অন্য রুমে গেলো। আমি একা একা বসে রইলাম। নিজে থেকে মনে মনে ভাবছিলাম –তানিম আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলো-ওদের সিষ্টেম ও নেট ওয়ার্ক এডমিন দরকার। যারা ইন্টারভিউ নিবে ওরা খুব একটা এক্সপার্ট নয়। ওরা সাধারন ম্যানেজমেন্টের কাজ করে আর একজন আছে নেটওয়ার্ক এডমিন তাও সেমি এক্সপার্ট। তর চাইতে বেশী কিছু জানে না। ভাবতে ভাবতে ৩০ মিনিট.... আমার এক্স কলিগ জামিল রুমে এসে ঢুকলো, এসেই বললো বস আমার এটা হচ্ছে না, আপনার শিওর হয়ে যাবে ওরা লিনাক্স বেইজড সার্ভার মেন্টেইন করবে, আপনার কপাল খুলে গেলো।
২/৩ মিনিট পরে আমাকে এসে ডেকে নিয়ে গেলো ওদের ইন্টারভিউ রুমে। ওই খানে গিয়ে দেখলাম ইন্টার ভিউ নেয়ার জন্য ৬ জন মেম্বার আছে।
আমাকে বসতে বললো।
মেম্বার ১ ঃ আপনার নাম তো অমুক তাই না?
আমি- জ্বী হ্যা।
মেম্বার ১ঃ আপনি বর্তমানে কি কাজ করেন আমাকে ডিটেইলস বর্ননা করেন।
আমিঃ- আমি একটি কোম্পানীর সার্ভারে সিষ্টেম নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছি। আমি যেই সার্ভাবে কাজ করি সেই সিষ্টেমে ৫০ এমবি ব্যান্ডিউইথ আছে। সরাসরি বিটিসিএল থেকে লেভেল ওয়ান সুইচে কানেক্টেড। সেখান থেকে বিজিপি রাউটার বিজিপি রাউটার থেকে বিল্টিন মাইক্রোটিক রাউটার আছে যেটা লিনাক্সে কনফিগার করা। বিজিপি রাউটার থেকে আউটপুট দিয়ে সিসকো সুইচে ওয়ান তৈরি করা আছে যেখানে সুইচ কনফিগার্ড। ওয়ান থেকে ইনপুট দিয়ে মাইক্রোটিক পিসি এর পরে ল্যান এর পরে ট্রাঙ্ক পোর্ট এর পরে ফাইবার অপটিক কানেক্টিভিটি ....টোটাল ৫ মিনিট বর্ননা দিলাম। খেয়াল করলাম কয়েকজন কিছু না বুঝে বেকুবের মতন চেয়ে আছে।
মেম্বার ২ঃ আমাদের এখানে উইন্ডজ ২০০৩ সার্ভারে আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে, আপনাকে সেটা ম্যান্টেইন্যান্স করতে হবে।
আমিঃ- জ্বী, আমি এটা পারবো।
মেম্বার ২ঃ আপনি মেইল সার্ভার করতে পারেন ?
আমি- জ্বী পারি।
মেম্বার ২ঃ আইপি ক্লাস সাবনেটিং ও ব্যান্ডউইথ ট্রান্সফরম?
আমিঃ জ্বী, এটা তো আমারই কাজ।
মেম্বার৩ ঃ আপনাকে আমাদের অফিসের (টোটাল ১২০ টা পিসি) টোটাল লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক দেখতে হবে। আর রাউটার দিয়ে শেয়ারিং ও করতে হবে।
আম- ভদ্রভাবে জবাব দিলাম এগুলো আমার অফিসের সাধারন টেকনিশিয়ানেরা করে।
** এর পরে শুরু হইলো আসল খেলা ঃ
মেম্বার ৪ঃ আচ্ছা আপনি কি ফটোশপের কাজ পারেন ? আপনাকে ফটোশপের কাজও করা লাগতে পারে।
আমি- (কিঞ্চিত টাস্কি খেয়ে নেটওয়ার্ক এডমিনের কাছ থেকে সাধারন ফটোশপের কাজ চায়) জ্বী, না আমি ফটোশপ পারিনা।
মেম্বার ৪ ঃ আচ্ছা আপনি কি ওয়েবপেইজ ডিজাইন করতে পারেন?
(আবারো টাস্কি! ওদের কি সামান্য জ্ঞান নেই নেট ওয়ার্ক আর ওয়েব প্রোগ্রামিং কম্পিউটার সায়েন্সের দুইটা ভিন্ন সাবজেক্ট?)
আমি- ওয়েব সাইট ডেভেলপমেন্ট খুব ভালো ভাবে পারিনা। তবে সাধারন পেইজ তৈরি আর সেখানে ইনফো দেয়া আর ভেলু ইনপুট করে সেটা পিএইচপি মাই এস্কিউএল আর সাথে লিঙ্ক করে দিতে পারবো। ডাটা শো-ডিলিট করতে পারি।
মেম্বার ১ঃ আচ্ছা আপনি ইআরপি কাজ পারেন? আমাদের এখানে যিনি আসবেন তাকে ইআরপি প্রোগ্রাম আর ক্রিষ্টাল রিপোর্ট পারতে হবে।
(আমি আবারো টাস্কি !! ইআরপি একটি সম্পুর্ন ভিন্ন সাবজেক্ট আমার ফ্রেন্ড শুধু ইআরপি নিয়ে জব করে ৩০ হাজার+ বেতন)
আমি- জ্বী আমি ইআরপি নিয়ে কাজ করিনি।
ওরা কিঞ্চিত নিজেদের ভিতরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
এতোক্ষন পরে ৫ম ব্যাক্তি মুখ খুললো।
আচ্ছা আপনি মাষ্টার্স করেন নাই কেন?
( অপ্রাসঙ্গীক প্রশ্নে কিছুটা বিরক্তি আসলো যেহেতু ওদের রিক্যারমেন্ট ছিলো কম্পিটার বিজ্ঞানে স্নাতক)
আমি- জ্বী, আসলে আমি গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জব হয়ে যায়। চাকুরীতে ব্যাস্ত হয়ে যাওয়ার জন্য আর পেরে উঠিনি, আর বর্তমান জব নিয়ে আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি, তবে ইচ্ছা আছে খুব শীঘ্রই মাষ্টার্স করে ফেলবো।
মেম্বার ২ঃ আসলে বেসরকারী ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের একটাই সমস্যা, আপনারা চাকুরীতে সফলতা পেয়ে গেলেই অন্য বিষয় গুলোর উপর থেকে হাল ছেড়ে দেন। বুয়েটের ছাত্রদের সাথে আপনাদের এখানেই অনেক পার্থক্য, ওরা গ্রাজুয়েট হবার পরেও সকল বিষয়ের উপরে অগাধ দক্ষতা রাখে।
( আমি বুঝে নিলাম এই চাকুরী টা আমার হচ্ছে না। আমি মনে মনে রেগে গিয়ে –তাইলে তোরা বুয়েটের পুলাপাইন কল করস না কেন?)
সবাই ৬ নাম্বার মেম্বারকে জিজ্ঞাসা করলো- স্যার আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করবেন কিনা?
উনি বললেন। না ঠিক আছে, আমার কিছুই বলার নাই।
টানা এক ঘন্টার ইন্টারভিউয়ে আরো অনেক হাস্যকরর আর বিব্রতকর প্রশ্ন করেছিলো। শেষপর্যন্ত ইন্টারভিউ শেষ হয়েছিলো। সব লিখতে গেলে পোষ্ট অনেক বড় হয়ে যাবে।
সবাই বললোঃ ওকে মিষ্টার ইমন! আমার সাথে হ্যান্ড শেক করলো, আর বললো আমরা আপনাকে সময় করে কল করবো।
সিড়ি দিয়ে বেড় হবার সময়ে দেখলাম আমার জন্য জামিল অপেক্ষা করছে।
সিড়ি দিয়ে লিফটে করে নামার সময়ে একটা কথা মনে পড়লো। ওরা বিডিজবস ডট কমেও চাকুরীর বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো, কিন্তু তাদের মন মতন কাউকেই পায় নাই। এখন বুঝলাম আসল কাহিনী কি। এই রকম আবুল মার্কা ইন্টারভিউয়ার যদি কোনো কোম্পানীর সিলেকশন বোর্ডে থাকে তাহলে বুয়েট কেনো, অক্সফোর্ড-কেমব্রীজ থেকে পুলাপাইন আইলেও এখানে চাকুরী পাবে না। ওদের যেই কাজ তার জন্য ন্যুনতম ৪ জন লোক দরকার- অথচ সিষ্টেম এডমিনের থেকে ওরা চার রকম যোগ্যতা চাচ্ছে। আসলেই করুনা হলো ওই কোম্পানীর প্রতি। এতো বড় কোম্পানীর এই করুন অবস্থা দেখে।
রাস্তায় নেমেই ফোন দিলাম আমার দোস্ত তানিমকে- শুরু করলাম হারামজাদা!! বলে, এর পরে টানা ৫ মিনিট ঝাড়লাম । ঘটনা খুলে বলে ফোন কেটে দিলাম। ওই প্রান্তে আমার বন্ধু হতভম্ব হয়ে রইলো।
আমি রাস্তা পার হয়ে সিএনজি খুজার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।