আজকে সকালে ৯.১৫ টা বাজে ঘুম থেকে উঠেছি। আজকের দিনটা আমার জন্য অলস কারন আমি আজকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। গত বেশ কয়েকদিন ধরে রাতে ঠিক মতন ঘুম হচ্ছে না। অফিসে স্যারদেরকে ম্যানেজ করে অনেকটা জোড় করেই ছুটি নিয়েছি।
তাই ইচ্ছা হলো আজকের দিনটা একেবারেই নিজের সাথে কাটাবো। নিজের বিষন্নতাকে ঝেড়ে ফেলবো। ঘুম থেকে উঠে, হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নিলাম,মনটা আমার খুব বিষন্ন। নাস্তা খাওয়ার ফাকে ফাকে আম্মাজান আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। কিন্তু আমি মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম। আমার বিষন্নতার কারন হয়তো উনি কিছুটা বুঝেন।
বাসায় বললাম কাজ আছে ফিরতে দুপুর হবে বলে বেরিয়ে গেলাম। বাসার সামনে থেকে একটা রিকশা ঠিক করে বাস কাউন্টারের সামনে গেলাম। অফিস আওয়ারে বাসে উঠা যে কি ঝামেলা তা ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝে। ধাক্কা-ধাক্কি করে বাসে উঠলাম। চারিদিকে তীব্র রোদ আর ভ্যাবসা গরমের মাঝে যাত্রীদের কাহিল অবস্থা। এর মধ্যে বাসযাত্রীদের দুই একজন আবার রাজনৈতিক ক্যাচাল শুরু করছে। অনেকে বিরক্ত আবার অনেকে তাদের কথা শুনতেছে। আমি আবার ভাবুক টাইপের ছেলে। এই কষ্ট দায়ক বাস যাত্রায়ও ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম - জীবনের অনেক অনেক ঘটে যাওয়া স্মৃতি আমাকে নাড়া দিচ্ছে। নিজেকে অনেক কষ্ট দিয়েছি -সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজের অনেক খায়েস পুরন করিনি,হয়তো করিনি আরো ভালো ভবিষ্যতের আশায়। অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করতো, কিনতে ইচ্ছে করতো, ভ্রমনে যেতে ইচ্ছে করতো-কিন্তু করিনি। অনেকে বলে কিরে- বিয়া করস না কেন? আর কতো? এই করবো, করছি.....
ভাবতে ভাবতে হুশ ফিরে পেলাম- বাস প্রায় মতিঝিলে চলে এসেছে। ধাক্কা-ধাক্কি করে বাস থেকে নামলাম। আমার সামনে মধুমিতা সিনেমা হল। আর রাস্তার অপজিটেই হলো ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জ। তীব্র রোদ পুরে ঘামতে ঘামতে রাস্তা পার হয়ে ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জ ভবনে ঢুকলাম, আমার ব্রোকার হাউজ তিনতলায়। হাউজে ঢুকেই স্বস্থির নিঃস্বাস ফেললাম। ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঠান্ডা পরিবেশ। বেলা ১১টায় মাত্র ট্রেডিং শুরু হয়েছে। কিন্তু হাউজে মাত্র দুই তিনজন বিনিয়োগ কারী, এদের একজন আরিফ ভাই। চারিদিকে পিন পতন নীরবতা। আগে যেখানে ছিলো উৎসব মুখর পরিবেশ সেখানে কবরের নিস্তব্দতা যেন গ্রাস করে ফেলেছে এই অফিসটাকে। অফিসের কর্মচারী মোতালেব ভাইকে বললাম আমার পোর্টফোলিওর প্রিন্ট দিতে। আমি অনুমান করতে পারি আমার লসের পরিমান কতো, তার পরেও প্রিন্ট নিলাম।
পোর্টফোলিওতে চোখ রেখেই আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। আমি যা ভেবেছিলাম অবস্থা তার চাইতেও খারাপ। আমার টাকার অর্ধেকের বেশী হাওয়া হয়ে গেছে !!!
নিজের অজান্তেই যেন চোখের পানি কিভাবে আমার চোখকে ভিজিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কয়েক মিনিটের জন্য আমি স্তম্বিত হয়ে গেলাম।
নিজেকে সামলে নিয়ে কম্পিউটার স্ক্রীনের সামনে গিয়ে বসলাম। সেখানে আরিফ ভাই, সুজন সহ আরো দুই জন আছে। সবার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে।এই হাউজে মাঝে মাঝে ট্রেড করার সুবাদে ওদের কে আমি চিনি। সবাই বিষন্ন আর হতাশা গ্রস্থ-চুপচাপ বসে শেয়ার বাজারের প্রাইস দেখছে আর উপলব্দি করছে তাদের টাকা কিভাবে ভেনিশ হয়ে যাচ্ছে। তাদের যেন কিছুই করার নেই। আরিফ ভাইয়ের কাহিনী আরো করুন- শুনলে আপনারা সবাই আরো বিষন্ন হয়ে যাবেন। উনি সৌদিতে থাকতেন দেশে এসে তার সঞ্চয় নিয়ে শেয়ার বিজনেস এ নেমেছিলেন। উনি এখন অলমোষ্ট দেউলিয়া। যা হোক পোস্ট বড় হয়ে যাবে সে জন্য বললাম না।
এসির ঠান্ডা বাতাসের ভেতরেও বসেও যেন আমি অস্বস্তি তে পড়ে যাচ্ছি। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আর নিজের বিনাশ দেখতে ইচ্ছে করতাছে না। হাউজ থেকে বের হয়ে গেলাম।
ডিএসই বিল্ডিং এর নিচে গিয়ে দোকান থেকে বেনসন কিনলাম ৪ টা। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে লাগলাম। বাইরে এখন তেমন একটা রোদ নেই। সকালের রৌদ্রজ্জল আকাশ এখন মেঘাচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে মেঘ ঘন হচ্ছে। রাস্তার ওই পাড়ে যেখানে মধুমিতা হল অবস্থিত সেই সাইডে চোখ গেল। আশে পাশের বিল্ডিং এর গ্লাস একটাও নেই। শেয়ার বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর তান্ডবে ওই সব বিল্ডিং এর গ্লাস সব চূর্ন-বিচূর্ন হয়ে গেছে। গত ডিসেম্বর থেকে শেয়ার বাজারে ক্রমাগত ধ্বস নেমেছে। প্রথম প্রথম বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করতো, ভাংচুর করতো। এই গ্লাস গুলো সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এখন আর তারা তেমন বিক্ষোভ করে না। কারন অনেকেই নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে সর্বসান্ত হয়ে গেছে। অনেকের কান্না এই মতিঝিলের রাস্তায় কোলাহলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। তাদের আর্তনাদ সরকারের কাছে পৌছে না। ডিএসই বিল্ডিং এর ভিতরে বাইরে আগে যেমন থাকতো মেলার মতন ভীড়, এখন সেখানে মরুর শুন্যতা।
আমার সিগারেট টা শেষ পর্যায়ে। এতোক্ষনে হয়তো আমার একাউন্ট থেকে আরো ৫০-৬০ হাজার টাকা ভেনিশ হয়ে গেছে।
না! আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না।
জীবনে আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ভালো টাকা কামাই করেছি। কিন্তু কোনো টাকাই উত্তম ব্যাবহার করিনি। হয়তো অনেক সুযোগ ছিলো। নিজের ইচ্ছা আর আকাঙ্ক্ষা কে জলাঞ্জলি দিয়ে -শেয়ার বাজারে আমার প্রায় সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছিলাম। হয়তো আমার ভেতরের মনটা একটু উচ্চাকাংখী ছিলো।
হঠাৎ একটা ভিক্ষুক এসে হাত পাতলো- সে সম্ভবত আর্সেনিকে আক্রান্ত। সারা শরীর গোটা হয়ে শরীরে কাটা দেয়ার মতন দেখাচ্ছে। পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে ১০ টাকা দিলাম। পকেটে মাত্র ২৬শ টাকা আছে হাত খরচ হিসেবে বাকি ১৫ দিন চলার জন্য। এর পরে অফিস থেকে বেতন পাবো। আর বেতনের টাকাটা শুধুই আমার !! আসলেই অনেক স্বার্থপরের মতন শুনাচ্ছে না? কেন জানি স্বার্থপরের মতন হয়ে গিয়েছিলাম। ছোট ভাইয়ের অনেক আবদার সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও পুরন করিনি। চাইলে বাবা-মা কে খুশী করার জন্য অনেক কিছুই করতে পারতাম, কিছুই করিনি। আজকের এই দুঃসময়ে সব কিছুই মনে পড়ে। আমার টাকা গুলো ভেনিশ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আর আমার কাছে মনে হচ্ছে এটাই যেন স্বার্থপরের শাস্তি, যেটা বিধাতা মানুষের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য লিখে রাখেন। এটাতেই যেন সৃস্টি কর্তা আমার জন্য শাস্তি আর শিক্ষা দুইটাই রেখেছেন।
আমাকে আবার শুন্য থেকে শুরু করতে হবে। গ্রাজুয়েশন শেষ করার পরে যেভাবে শুন্য হাতে শুরু করেছিলাম ঠিক আবারো শুন্য হাতে শুরু করতে হবে। অনেক বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
আমি চাকুরী করি- এক ভাবে না হয় শুন্য থেকেই শুরু করা যাবে। কিন্তু যারা এই ষ্টক মার্কেটে রুজি করে খেতো, যাদের বিকল্প আয় নেই তাদের কি হবে? এখান থেকে যাদের সংসার চলতো তাদের কি হবে?
আমাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত না হয় আমরাই করলাম। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্রের চালকেরা- যারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আহবান জানিয়েছিলেন এই মার্কেটে বিনিয়োগ করার জন্য, তারা রোড শো করেছিলেন, মিডিয়াতে আহবান জানিয়েছিলেন। তারা এখন কোথায়? যারা আমাদের মতন ক্ষুদ্রবিনিয়োগকারীদের হাই প্রাইসে শেয়ার ধরিয়ে দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে তাদের বিচার কে করবে?
ভাবতে ভাবতে মতিঝিলের শাপলা চত্তরের দিকে হাটা শুরু করলাম। বাসায় যাবো সেজন্য বাস কাউন্টারের দিকে যাচ্ছি। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা, ঠান্ডা বাতাস প্রবাহ শুরু হয়েছে। আহহহ এখন আবহাওয়াটা ভালো লাগছে। বাসায় যাওয়ার পরে আর কোনো কাজ নেই-বাকি দিনটা রিলাক্স।......... আমার পকেট থেকে পোর্টফোলিওটা রের করলাম। সেটাকে ছিড়ে কয়েকটুকরো করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম। ঝড়ো বাতাসে উড়ে গেলো কাগজের টুকরো গুলো। হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ যেভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সেভাবে মিলিয়ে গেলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১১ সকাল ৯:৩৪