আজকে সকালের কথা। ক্লাশ ছিলো ১১টায়। আসলে পরীক্ষা ছিল, ক্লাসটেস্ট। কিন্তু এই অধমের বাসা উত্তরা নামক স্থানে, যা ঢাবি এলাকা হতে ক্রোশ দূর, বিধায় আমি রওনা হইসি ৯টার ও আগে। কারণ আমি জানি আমি ঢাকা শহরে থাকি!! এবং উত্তরা থেকে শাহবাগ আসতে, সকাল ৮টার পর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, দুপুর আর বিকালের মিলনের ঘন্টাখানেক ছাড়া বাকি সবসময় দুই থেকে আড়াই ঘন্টা লাগে। রিকশা থেকে আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমেই দেখলাম একটা মেট্রো আর একটা বেলাল পরিবহণ এর বাস চলে গেলো। অর্থাৎ শাহবাগ যেতে হলে ঢাকা পরিবহণ লিমিটেড (ঢাপলি) ই আমার ভরসা। গুনোগত মানের দিক দিয়ে এই রুটে এটাই সবচেয়ে ভালো বাস, কেননা এদের স্টপেজ অন্যদের তুলনায় কম, বেশ বড় বাস, সীট ও বেশ আরামদায়ক। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে, এদের বাস কম! একটা মিস হলেই মিনিট বিশের আগে আরেকটা পাওয়া মুশকিল। যাই হওক, উঠলাম, ঘড়ির কাঁটা ৯ ছুঁই ছুঁই। সীট পেলাম না। উহু,খালি সীট পেলাম না, আশাও করি নাই যদিও। এটা গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ছেড়ে আসা বাস,এখনো খালি সীট থাকার প্রশ্নই উঠেনা। তবু এই ভেবে খুশি হলাম তাড়াতাড়িই বাস পাইছি!
হঠাৎ ই বিশ্বরোড (তখনও ঝুলছি, খালি সীট এর অপেক্ষায়) পেড়িয়ে বেশ খানিক টা সামনে এসে বাস টা থেমে গেল। কি কারনে জানি না, ঠিক ওই জায়গাতেই টহল পুলিশের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ওখান থেকে আগে পিছে অন্তত মাইল খানেক এর মধ্যে কোনো বাসস্ট্যান্ড নাই। অন্য বাস থামবেও না। লোকাল ও না। কাহিনী কি, ইঞ্জিনে সমস্যা, আর যাবেনা। পুলিশ এসে ড্রাইভার কে হালকা ঝাড়ি। কিন্তু, আমারতো মাথায় হাত....
এই বাস এর যাত্রীরা যে পরের কোনো ঢাপলি এর বাসে উঠবে, তার কোন সম্ভাবনায় নাই। কারণ, এই বাস তার ধারণক্ষমতার প্রায় দেড়গুন যাত্রী নিয়ে চলছিল। এবং এই সময়ে এই পথে ঢাপলির যে বাস গুলো আসবে সবকটারই একি অবস্থা থাকবে। তার মানে এখন যামু কই!!! বাসের সবাই বেশ গালিগালাজ দিয়ে একে একে নেমে গেলো, আমিও নামলাম। গালি দিয়া তো আর লাভ নাই। বাস না চললে, ড্রাইভার করবে কি??!! আমার অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নাই, এতক্ষণ বাসের ভিতরে দাঁড়ায়েই ছিলাম, এখন বাস থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ায়ে আছি!! মাথায় চিন্তা একটাই, পরীক্ষা দিতে পারমু তো???!!!
যাই হোক, মিনিট দশেক পর, একখানা ঢাপলি এর বাস এসে দাঁড়ালো, পড়ুন আমরা দাঁড় করালাম। আমি তো অবাক, কারণ আমার হিসাবে, ১৫-২০ মিনিটের আগে বাস আসার কথা ছিলো না। কিন্তু, আফসোস এটার অবস্থা আমাদের টার চেয়েও খারাপ। তাও ঠেলাঠেলি করে জনাদশেক উঠে গেল, আমি পারলাম না, ধাক্কাধাক্কিতে পেরে উঠলাম না...
বিরস বদনে আগের জায়গায় ফিরে আসলাম। আবার মিনিট পাঁচ-সাতেক পর আরো একটি ঢাপলি এর বাস এসে দাঁড়ালো, আবারো পড়ুন আমরা দাঁড় করালাম। এবার আর অবাক হয়ে সময় নষ্ট না করে একটু আগে থেকে দৌড় দেয়ার জন্য এযাত্রা সৌভাগ্যবান দশ-পনের জনের মধ্য আমি একজন!!!! কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায় ঘটলো। আমার মতই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা একজন যাত্রী এবার ও উঠতে না পেরে, হাত দিয়ে বাড়ি দিয়ে বাসের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেললেন...!! নাহ, উনি কোন মাস্তান গোছের কেউ ছিলেন না। আমার যতটুকু মনে পড়ে, তার গলায় টাই ছিলো। এরই মধ্যে ড্রাইভার-হেলপার বাস থেকে নেমে গেছে ওই লোক টা কে মারার জন্য। মানে বাস চলছে না। একটু স্বার্থপরের মতই চিন্তা করছিলাম, কারণ আমার পরীক্ষা..
উহ, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাসের ভিতরে কি হলো তা তো বলতেই ভুলে গেলাম। যেই জানালার কাঁচটা ভাংলো, তার পাশে বসে থাকা যাত্রীর ততক্ষণে রক্তারক্তি হয়ে গেছে, হাত কেঁটে গেছে টার, সেই রক্তে শার্ট আর প্যান্ট মেখে গেছে। তার পাশের জন কে দেখলাম, হাত থেকে একটা কাঁচ টুকরা বের করলো। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন বললো, ভাগ্যিস সীট এ বসি নাই!! ওই দিকে টাইওয়ালার ও হাত কেঁটেছে, তার আর বেশী কেঁটেছে। তাকে পুলিশ ধরে রাখসে, বেচারার হয়তো কোনো জরুরী কাজ ছিলো। কাঁচ ভাঙ্গার ঘটনায় বাসের ভিতরে থাকা একজন যাত্রী আহত হলেও, বাকি দের কেউ কেউ ওই টাইওয়ালার পক্ষেও কথা বলতেছিলো। কিন্তু তাদের আক্ষেপ, ভাংলি যখন এইটা কেন, যেইটা থাইমা আছে ওইটার কাঁচ ভাঙ্গতি!!!! ওই বাস টা পুড়ায়ে ফেলা দরকার ছিলো!!!! (যেনো পুড়ালে বাস টা চলতে শুরু করবে!)
বেশ খানিকক্ষণ পর, ড্রাইভার ফিরে আসলেন। বাস চলতে শুরু করলো। তখন আমি খেয়াল করলাম, এই বাস টা আগেরটার চেয়ে ছোট!! অর্থাৎ এটা মনে হয় শাহবাগ যাবেনা! সীট এ বসতে না পেরে, নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে থাকা যাত্রীকে জিজ্ঞেস করতেই এমন একটা লুক দিলেন!! কি আর বলবো। তাও শেষমেশ জানলাম, এটা ঢাপলি এর ছোট বাসগুলোর একটি। এটি মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে অন্য পথে গুলিস্থান অভিমুখী.... কি আর করা, নেমে গেলাম কাকলী। সেখানে বিশাল জ্যাম। বাস কাউন্টার মেলা সামনে, হাঁটতে থাকলাম। ততক্ষণে আমি ঢাপলি এর বাস এ করে শাহবাগ যাওয়ার আশা ত্যাগ করেছি। ঠিক তখনি বেশ কিছুটা সামনে দেখলাম একটা ঢাপলি এর বাস!!! এটা হল সেই বাস টা, যেটায় উঠতে পারিনাই তখন, এবারতো জ্যাম এ দাঁড়ানো। ধীরে সুস্থে ছেঁড়া টিকিট দেখিয়ে উঠে গেলাম!! ওই বাস এ তখন সম্ভবত, ধারণক্ষমতার দুইগুন যাত্রী।
শেষ পর্যন্ত ১১টা ৫ এর দিকে ক্লাসে ঢুকলাম। আরো আগেই আসতাম, যদি না ফার্মগেট থেকে শাহবাগ আসতে আধঘন্টা লাগতো! স্যার আসচেন ১১টা ৩০ এর দিকে!! তাই বেঁচে গেলাম...
এবার এ ঘটনার সাথে জড়িত একটা প্রাসংগিক কথা। এই পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে হতে হতোনা। আমার ১১টায় ক্লাস, ঘুম থেকে উঠতাম ১০টায়, হেলেদুলে নাস্তা করে ফার্মগেট থেকে বাস এ করে ঢাবি চলে আসতাম। যদি ও কেবল যদি আমি IBA হোস্টেলে একটা সীট পেতাম....
আমার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, দুটোই চট্টগ্রাম। বাবা-মা চট্টগ্রামে, মেসে "উত্তরা"য় বন্ধুদের সাথে থাকি। আমি ভেবেছিলাম এই তথ্যটুকু হল এ একটা সীট পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু না। যথেষ্ট না। ঢাকাতেই বাসা এমন অনেকেই সীট পেল, তখন বুঝলাম আরো অনেক কিছু বলা দরকার ছিল। প্রায়ই আমার ৮টার ক্লাস মিস হচ্ছে, আমি কিন্তু বাসা থেকে বের হচ্ছি ৭টার ও অনেক আগে। যাই হোক দুঃখের গল্প আরেক দিন।
উহ, শাহবাগ এ বাস থেকে নেমে এক গ্লাস আখের শরবত পান করেছিলাম!! কি যে লাগতেসিলো তখন ওটা, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। অনেকেই বলে, রাস্তার পাশের আখের শরবত খেলে জন্ডিস হয়!! হতে পারে, কিন্তু যে তৃপ্তিটা পেলাম, তার জন্যে কয়েকবার জন্ডিস হলেও সমস্যা নাই। (আসলে কিন্তু বিরাট সমস্যা!!)
ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৩৭