দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি বিদ্যমান থাকলেও এসব চলছে চুক্তির কোনো তোয়াক্কা না করেই। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনেক ক্ষেত্রেই এ সংক্রান্ত ব্যাপারে অবগত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেনেও তারা উদাসীন। ভারতীয় নামি-দামি শিল্পীদের এনে প্রোগ্রাম করে ‘জাতে ওঠার’ এক ধরনের হীনম্মন্য প্রবণতার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটছে— বিপরীতে দেশের প্রতিভাবান শিল্পীরা অবজ্ঞা, উপেক্ষার ন্যক্কারজনক শিকার হচ্ছেন।
বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, চিটাগাং ক্লাব, সোনারগাঁও, শেরাটন, রেডিসন, ওয়েসিল্টন, ঢাকা রিজেন্সির মতো বিলাসবস্লল ভেন্যুতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই শিল্পীদের নিয়ে এসে অবাধে অনুষ্ঠান করছে। সর্বশেষ পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও বিজেএমইএ নিয়ে এসেছে একদল ভারতীয় শিল্পী। গত তিনদিন ধরে চীন মৈত্রী ও সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাদের কনসার্ট।
এ ব্যাপারে অনুসন্ব্দানে জানা গেছে, পারফর্মেন্সের নামে ঢাকায় দলে দলে আসছেন ভারতীয় শিল্পী। পারিশ্রমিক হিসেবে বিপুল অংকের টাকা স্লন্ডি করে ভারতে পাঠানো হচ্ছে। কোনো প্রকার ট্যাক্স দেয়ার বালাই নেই। এক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে একেকজন শিল্পী কমপক্ষে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। বাংলাদেশে আসার আগেই মোটা অঙ্কের আগাম সম্মানী দিয়ে তাদের বুকিং করতে হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে কোনো শিল্পী ভারতে যেতে পারছেন না। বড় ধরনের কোনো অনুষ্ঠানও হচ্ছে না। গত এক বছরে ভারতে বাংলাদেশী শিল্পীদের অংশগ্রহণে বড় কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের দুই জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীনের কোনো কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়নি আজ পর্যন্ত। অথচ সে দেশের নামি-দামি শিল্পীরা বাংলাদেশে এসেছেন। কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ভারতীয় শিল্পীরা বাংলাদেশকে তাদের গানবাজনা ও চ্যানেলের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সংস্কৃতি-সচেতন মহলের মন্তব্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক বৈষম্য যেমন রয়েছে, তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাট বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে এ ধরনের একতরফা সাংস্কৃতিক বাণিজ্য কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এদের রুখতে হবে। এদের রুখতে না পারলে দেশের সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাবে।
জানা গেছে, যথাযথ অনুমতি ছাড়াই ভারত থেকে শিল্পীরা বাংলাদেশে আসছেন। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে স্লন্ডি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তারা। যেসব মন্ত্রণালয় বা দফতরের অনুমতি প্রয়োজন সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করে ভারতীয় শিল্পীদের ঢাকায় আনা হয়। ম্যানেজ করা হয় অনুষ্ঠানের টিকিট বা অন্য উপঢৌকন দিয়ে। ওইসব ব্যক্তি সপরিবারে জামাই আদরে অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে বসে উপভোগ করার আমন্ত্রণ পান। এছাড়া দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়েও যথাযথ অনুমতি নেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশকে বলা হয় বাউলের দেশ । এ মাটিতে বস্ল বাউলশিল্পী জন্ম নিয়েছেন। গান গেয়ে বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত করেছেন বাংলাদেশের বাউলসমাজ। বাংলাদেশের বাউলকুলকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তথাকথিত কিছু সংগঠনের নামে ভারত থেকে বাউলশিল্পী এনে ঢাকায় কনসার্ট করানো হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত থেকে একদল বাউলশিল্পী দিয়ে উত্তরা ক্লাবে বাউল গানের আসর বসানো হয়। অথচ বাংলাদেশ থেকে একজন বাউলশিল্পী সে দেশে গিয়ে কনসার্ট করতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
জানুয়ারি থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় এসেছেন ২৩ জন ভারতীয় শিল্পী। তবে এই সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে অভিজাত ক্লাবগুলো যেসব ভারতীয় শিল্পীকে বাংলাদেশে আনছে তাদের গোপনীয়তার কারণে সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়। যেসব শিল্পী আনা হয়েছে এরা হলেন—মান্না দে, হৈমন্তী শুক্লা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, জগজিত্ সিং, পঙ্কজ উদাস, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধায়), নচিকেতা, সনু নিগম, শান, অনুরাধা ঘোষ, ইন্ডিয়ান আইডল ইমন, কৈলাস খের, সারেগামাপার সঞ্চিতা ও মনীষা, ফেইম গুরুকুলের রূপরেখা, চন্দ্রিমা, আইটেম গার্ল শেফালী ও শিরিন, পূর্ণদাস বাউল, স্বপন বসু, দিব্যেন্দু দাস বাউল।
ভারত থেকে নামি-দামি শিল্পীরা বাংলাদেশে এলে মিডিয়া তাদের সংবাদ ফলাও করে ছাপে ও প্রকাশ করে। কিন্তু অভিজাত ক্লাবগুলোতে যেসব শিল্পী আনা হয়, সেখানকার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লুকোচুরি করে ভারতীয় শিল্পীদের ঢাকায় আনা হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে আয়োজকরা এই লুকোচুরি করেন। অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় আইটেম গার্ল ও ডিজিটাল জকিদের (জকি) নিয়ে অনুষ্ঠান করেন অনুমতি ছাড়াই। যার কারণে ওইসব শিল্পীর আসার খবর পাওয়া যায় না। ক্লাব চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে।
গত আগসল্ট মাসে স্থানীয় একটি হোটেল ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম গার্ল শেফালীকে দিয়ে একটি ডিজে নাইট শোর আয়োজন করা হয়। ‘কাঁটালাগা’ খ্যাত আইটেম গার্ল শেফালী সেখানে পারফর্মেন্স করেন। ওই অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। জানা গেছে, ওই অনুষ্ঠানে শেফালী অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করেন। বিত্তবান শ্রেণীর ছেলে-মেয়েরা ওই অনুষ্ঠান বিপুল পরিমাণের টাকা খরচ করে উপভোগ করে। সর্বনিম্ন টিকিট ছিল ১০ হাজার টাকা।
২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গাইতে আসেন ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী কুমার শানু। সঙ্গে ছিলেন অপর ভারতীয় শিল্পী অনুরাধা ঘোষ। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইর আয়োজনে ‘গার্মেন্ট মেলা বাটেক্সপো ২০০৯’ উপলক্ষে তারা এসেছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন ভারতীয় শিল্পী মান্না দে। তিনি তিনটি কনসার্টে অংশ নেন। এর মধ্যে দুটি ছিল ঢাকায়, অন্যটি কক্সবাজারে।
এমব্রোজার ফিল্মস এবং প্রিয়ন্তী অ্যান্ড ইফেক্টস যৌথভাবে এই কনসার্টের আয়োজন করে। মান্না দের প্রথম কনসার্টটি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে। দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইমে। এ দুটি কনসার্ট উপভোগ করতে দর্শক-শ্রোতাদের ৫০০০, ৩৫০০ এবং ২৫০০ টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। তৃতীয় কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজারের হোটেল সি প্যালেসে। মান্না দের সঙ্গে এসেছিলেন আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। তিনিও মান্না দের সঙ্গে এসব কনসার্টে অংশ নেন। জানা গেছে, তিনটি কনসার্টে অংশ নিয়ে এই দুই শিল্পী প্রায় এক কোটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন।
৬ মে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের জনপ্রিয় সুফি ব্যান্ড দলের কৈলাস খের। তার পরের দিন তিনি বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইম মিলনায়তনে সম্পূর্ণ একটি বাণিজ্যিক কনসার্টে অংশ নেন। কনসার্টটি এতই বাণিজিক ছিল যে সাংবাদিকদের পর্যন্ত অনুষ্ঠান কাভারেজে ডাকা হয়নি। কনসার্টটির আয়োজন করে ইউনিট্রেন্ডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মোমেনটাম। কৈলাস খের প্রায় ২০টির মতো গান গেয়ে পারিশ্রমিক নেন ৫০ লাখ টাকা। কৈলাস খের বাংলাদেশে গান গাইবেন তবে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে বলে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেন আয়োজকদের। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল গণমাধ্যমে সাক্ষাত্কার দিতে হলে তাকে সেজন্য পারিশ্রমিক দিতে হবে এবং একই সঙ্গে কনসার্টটি টিভিতে প্রচার করা যাবে না। প্রচার করতে হলে আলাদা রয়েলটি দিতে হবে তাকে। কনসার্টটি উপভোগ করার জন্য দর্শক-শ্রোতাকে ৪০০০, ৩৫০০ ও ২৫০০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয়েছে।
বলিউডের প্লেব্যাক সিঙ্গার হচ্ছেন শান। বাণিজ্যিক কনসার্টে অংশ নিতে ১৯ জুন ঢাকায় আসেন তিনি। ২০ জুন বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইম মিলনায়তনে শো করেন এই শিল্পী। এই কনসার্টটির আয়োজক ছিল অন্তর শোবিজ। একই কনসার্টে অংশ নেন ভারতীয় চ্যানেল জিটিভির গানের প্রতিভা অন্বেষণমূলক প্রতিযোগিতা সারেগামাপার এবারের সেরা পঞ্চম স্থান অধিকারী মনীষা। শান এই কনসার্ট থেকে ৬০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন বলে জানা গেছে।
২৫ জুন ঢাকায় আসেন ভারতীয় শিল্পী নচিকেতা। তিনি দুটি কনসার্টে অংশ নেন। কনসার্ট দুটি অনুষ্ঠিত হয় ওয়াটার গার্ডেন রেডিসন হোটেল ও উত্তরা ক্লাবে। নচিকেতার গানের পাশাপাশি ডিজে শোতে অংশ নেয় ভারতীয় আইটেম গার্ল ডিজে শিরিন। আয়োজক ছিল বিমস কমিউনিকেশন।
ভারতের প্লেব্যাক গায়িকা অলকা ইয়াগনিক ঢাকায় এসেছিলেন ১৫ জুলাই। রেড এন্টারপ্রাইজের আয়োজনে ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইম মিলনায়তনে শো করেন তিনি। তার এই কনসার্টটি উপভোগ করার জন্য হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। টিকিটের দাম ছিল ৪৫০০, ৩৫০০ ও ২৫০০ টাকা। অলকা ইয়াগনিক সাধারণত বাণিজ্যিক শোতে ১ কোটি টাকার নিচে পারিশ্রমিক নেন না। তিনি এই কনসার্টে ১ কোটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
১১ আগসল্ট ঢাকায় পারফর্মেন্স করেন ভারতীয় শিল্পী ফেইম গুরুকুলের রূপরেখা, সারেগামাপার লিটল চ্যাম্পের সঞ্চিতা, ইন্ডিয়ান আইডল ইমন এবং কাঁটালাগা খ্যাত আইটেম গার্ল শেফালী।
১৬ অক্টোবর চিরকুটের আয়োজনে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে কনসার্টে অংশ নেন কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়)।
৩০ অক্টোবর উত্তরা ক্লাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাউলশিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় বাউল গানের আসর ‘সংস অব দ্য বাউল’। বাউলশিল্পীরা ছিলেন—পূর্ণদাস বাউল, স্বপন বসু ও দিব্যেন্দু বাউল।
২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতীয় শিল্পীদের দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিত্তবানদের ক্লাব ঢাকা ক্লাবে একক বাঁশি সন্ব্দ্যায় বাঁশি বাজান ভারতীয় বাঁশিবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। একই দিন ফায়ারফক্সের আয়োজনে বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কনসার্ট করেন সনু নিগম।
৪ নভেম্বর বিকেএমইএ’র আমন্ত্রণে ভারতীয় জনপ্রিয় গজলশিল্পী জগজিত্ সিং কনসার্ট করেন বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইমে।
বিজিএমইএ’র দুই কোটি টাকার ভারতীয় শিল্পী রফতানিজাত পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দু’দিনের বাটেক্সপো নাইট পালনের জন্য ভারত থেকে একটি শিল্পী গ্রুপ নিয়ে আসে। এর মধ্যে নামি দামি শিল্পীর সংখ্যা ৫-৬ জন হলেও তাদের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে বিজিএমইএকে। খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বোম্বের এক সময়কার নায়িকা রাভিনা ট্যান্ডন ও মডেল মালাইকা অরোরা, সঙ্গীতশিল্পী অভিজিত ভট্টাচার্য। দলের বাকিরা হলের যন্ত্রশিল্পী ও মডেল গার্ল।
উল্লেখ্য, বাটেক্সপোর এর আগের অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশী শিল্পীদের বেশি গুরত্ব দেয়া হতো। দেশের প্রথিতযশা শিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনসহ অন্যান্য খ্যাতিমান দেশীয় শিল্পী আমন্ত্রিত হতেন অনুষ্ঠানগুলোতে। ভারতীয় শিল্পী আনা হলেও তাদের গুরুত্ব দেয়া হতো কম। এবারই প্রথম দেশীয় শিল্পীবিহীন বাটেক্সপো নাইট অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত, ৫ ও ৬ নভেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দু’দিনব্যাপী বাটেক্সপো নাইট উদযাপিত হয়।
জানা গেছে, এই শিল্পী দলের সম্মানী হিসেবে বিজিএমইএকে দুই কোটি টাকা দেয়া ছাড়াও তাদের এখানে থাকা-খাওয়া ও বিমান ভাড়ার জন্য আরও এক কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। তবে কোটি টাকা খরচ করলেও এই শিল্পীরা এবার বাটেক্সপো নাইট জমাতে পারেননি। এজন্য সাধারণ সদস্যদের ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়েছে আয়োজক কমিটি। দেশে অনেক নামি-দামি শিল্পী থাকতেও তাদের না এনে ভারতীয় নিম্নমানের শিল্পী কেন—এ আলোচনা ছিল দর্শকদের মধ্যেও। দেশীয় শিল্পীবিহীন বাটেক্সপো নাইট কেন এ বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ আমার দেশকে বলেন, এ প্রশ্ন আমারও।
বলিউড সিনেমার আগ্রাসন : বলিউড সিনেমার আগ্রাসন এরই মধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বলিউড সিনেমার প্রচণ্ড ভক্ত। অলি-গলি থেকে শুরু করে সিডি দোকানগুলোতে বলিউড ও হিন্দি গানের সিডি-ভিসিডি-ডিভিডিতে সয়লাব। বলিউডে ছবি মুক্তি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে সিডি আকারে চলে আসে। তরুণ প্রজন্ম সেসব সিডি কেনার জন্য দোকানগুলোতে স্লমড়ি খেয়ে পড়ে। হিন্দি গানের প্রভাব তরুণদের মাঝে এতটাই বিস্তার করে, এফএম রেডিওওয়ালা তাদের জন্য হিন্দি গানের আলাদা অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়েছে। হরদম হিন্দি প্রচার করছে রেডিও এবিসি, রেডিও ফুর্তি, রেডিও টুডে, রেডিও আমার। এসব রেডিওর জকিরা তরুণ প্রজন্মকে প্রলুব্ধ করছে হিন্দি গান শোনার ব্যাপারে। এই চারটি এফএম রেডিওতে ঘণ্টায় ৪ থেকে ৫টি করে হিন্দি গান প্রচার হচ্ছে। মোবাইল ফোনের রিং টোনে ব্যবহার করা হচ্ছে হিন্দি গান।
হিন্দি সিরিয়ালের ভয়াল থাবা : ভারতে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল দেখা না গেলেও বাংলাদেশে তাদের চ্যানেলের আধিপত্য বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভয়াল থাবা পড়ছে মারাত্মকভাবে। এসব হিন্দি সিরিয়াল মহিলাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে উচ্চবিত্ত গৃহিণীদের কাছে এসব সিরিয়াল বেশি জনপ্রিয়। গৃহিণীদের সময় কাটে এসব সিরিয়াল দেখে। অনেকের ঘুম আসে না এসব সিরিয়াল না দেখলে।
বর্তমানে এসব সিরিয়ালের খারাপ দিক এতটাই মারাত্মকভাবে দেখা গেছে, হিন্দি সিরিয়াল দেখার জন্য ঘরে ঘরে ঝগড়া পর্যন্ত হচ্ছে। হিন্দি সিরিয়ালগুলোর কাহিনী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরকীয়ার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মহিলা এসব সিরিয়াল দেখে থাকেন। সল্টার প্লাস, জিটিভি, সনি টিভিতে প্রতিদিনই ৭ থেকে ৮টি সিরিয়াল প্রচার হয়। অবৈধ প্রেম আর সম্পত্তি দখল নিয়ে নানা উদ্ভট বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এসব সিরিয়ালে। জিটিভিতে প্রতিদিনই প্রচার হচ্ছে—তিন বস্লরানিয়া, রাখি অটুট রিস্তে কি দোর, ছোটি বস্ল, হামারি বেটিও কা বিবাহ।
দেশের শিল্পী সংস্কৃতিসেবীরা ক্ষুব্ধ
ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে এসে ঘটা করে কনসার্ট করার ঘটনায় দেশের শিল্পীসমাজ ও সংস্কৃতিসেবীরা ক্ষুব্ধ। এ বছর ভারতীয় শিল্পীদের আনাগোনা বিগত বছরের চেয়ে অনেক বেশি। বছরের আরও দু্ই মাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে অর্ধশত ভারতীয় শিল্পী এসেছেন বাংলাদেশে। বিনিময়ে তারা নিয়ে গেছেন কোটি কোটি টাকা। অথচ আমাদের দেশের গুণী শিল্পীদের নিয়ে পাশের দেশেটিতে এ ধরনের কোনো আয়োজন করা হয় না। অনুষ্ঠান করা তো দূরের কথা অনেক সময় আমাদের দেশের শিল্পীদের ভিসা পেতেও বেগ পেতে হয়। বিদেশ থেকে শিল্পী এলে আমাদের দেশের শিল্পীদেরও ওই দেশে কনসার্ট করার সুযোগ দিতে হবে এমনটিই স্বাভাবিক বলে মনে করেন শিল্পীসমাজ। অথচ আমাদের দেশের বরেণ্য শিল্পীদের এক রকম অবহেলা এবং অবজ্ঞা করেই অহরহ চলছে বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে মাতামাতি।
সৈয়দ আবদুল হাদী : বিদেশি শিল্পী আমাদের দেশে অবশ্যই আসবেন। তবে দেখতে হবে কারা আসছেন। যারা আসছেন তাদের দিয়ে আমাদের কোনো উপকার হচ্ছে কি-না। তাদের থেকে আমরা কিছু নিতে পারছি কি-না। তাদের থেকে আমরা যেমন নিচ্ছি তেমন আমরাও তাদের কিছু দিতে চাই। আমাদেরও অনেক অর্জন রয়েছে। কিন্তু আমাদের ডাকা হচ্ছে না। তাদের যে দুয়েকজন প্রিয়ভাজন আছেন তাদেরই ডাকা হয়। এর পেছনে হয়তো অন্য কোনো কারণ রয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে আমরা অনেক এগিয়ে রয়েছি। তারপরেও আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো সেখানে দেখানও হয় না। আমাদের চ্যানেলগুলো ওই দেশে প্রচার হলে আমাদের বাজারটা আরও বাড়ত। কিন্তু তা হচ্ছে না। সংস্কৃতির ভারসাম্য তারা রক্ষা করছেন না। আমি এই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়েও কথা বলেছি। এই বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি।
আবদুল জব্বার : সবাই আগে নিজের দেশের শিল্পীদের প্রাধান্য দেন। কিন্তু আমাদের দেশে তার উল্টোটি দেখা যায়। এখানে সবাই বিদেশি শিল্পীদের নিয়েই মাতামাতি করেন। এ জন্য তো আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করিনি। আমাদের দেশে অনেক গুণী শিল্পী রয়েছেন অথচ তাদের গান গাইতে ডাকা হচ্ছে না। কিন্তু আমরা পাশের দেশের নগণ্য শিল্পীকে নিয়েও মাতামাতি করছি। এটি আমাদের জন্য অপমানজনক। অবিলম্বে এই প্রবণতা বন্ব্দ হওয়া উচিত। শুধু বিদেশি শিল্পীরাই আমাদের দেশে এসে গান শোনাবে আর আমরা তাদের দেশে গিয়ে গান শোনাব না তাতো হয় না। তাদের ভাব দেখে মনে হয় আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক অঙ্গন নেই। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির কোনো কার্যকারিতা আছে বলে আমার মনে হয় না। এজন্য সরকারকে একটি নীতিমালা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত, যেন বিদেশি শিল্পী এলে সেই মঞ্চে দেশের শিল্পীদেরও রাখা হয়।
খুরশিদ আলম : বানের জলের মতো এখন আমাদের দেশে বিদেশি শিল্পী আসছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয়। আমি বিদেশি শিল্পী আসার বিপক্ষে নই। তবে বাইরের দেশ থেকে যদি দশজন শিল্পী বাংলাদেশে আসে তাহলে আমাদের দেশের অন্তত পাঁচজন শিল্পীকে তাদের দেশে নিয়ে যাওয়া উচিত। এদেশের অনেক শিল্পীই ভালো গান করেন। তাদের উচিত অন্তত একজন সৈয়দ আবদুল হাদি, আবদুল জব্বার, রুনা লায়লা, কনক চাঁপা, শাকিলা জাফরের মতো শিল্পীকে তাদের দেশে নিয়ে গান গাওয়ার সুযোগ দেয়া। আমাদের দেশে শুধু বিদেশ থেকে শিল্পী আসছেন কিন্তু যেতে পারছেন না। এমনকি কোনো শিল্পী ব্যক্তিগতভাবে দেশের বাইরে যাওয়ার সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আপনি কি কাজে যাচ্ছেন। গানের অনুষ্ঠান করলেও কাগজপত্র দেখান? আমি অনেকের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে ভারতীয় শিল্পীদের গান করতে দেখেছি। একজনকে আমি পারিশ্রমিক হিসেবে ৮০ লাখ টাকা নিতে দেখেছি। তার সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, বাদ্যযন্ত্রি এবং অন্যান্য খরচ বাদে এই টাকা দেয়া হয়েছিল। তিনি কি এই টাকার কর পরিশোধ করেছিলেন। এখন যারা বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে আসছেন তারা কি সরকারকে ঠিকমত কর দিচ্ছেন? এই বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে।
ফরিদা পারভীন : আমাদের দেশের শিল্পীরা হয়তো সেভাবে গাইতে পারেন না বলেই বিদোশ শিল্পীদের এত আগমন। আমাদের দেশের শিল্পীরা কী সত্যিই গাইতে পারেন না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমাদের দেশের শিল্পীরা যা গাইতে পারেন সারা পৃথিবীতে আমি দেখি না অন্যরা তা গাইতে পারেন। আমাদের শিল্পীদের সঙ্গে আমাদের গানের সঙ্গে অন্যদের তুলনাও দেয়া যায় না। সাংস্কৃতিক বিনিময় যাকে বলে যদি সেটা হতো আমাদের শিল্পী ও বিদেশি শিল্পীরা একসঙ্গে গাইতেন তাহলে তো কোনো সমস্যাই ছিল না। এই যে সম্প্রতি পণ্ডিত চৌরসিয়া এসে বাঁশি বাজালেন, পুণ্যদাস বাউল এলেন তাদের সঙ্গে তো আমাদের স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্ক, কিন্তু সাস্কৃতিক বিনিময় না হয়ে যখন একতরফা বিদেশি শিল্পীদের প্রতি অতিসম্মান দেখানো হয় তখন দেশীয় শিল্পী দেশীয় সংস্কৃতির কী অবস্থা হয়?
আইয়ুব বাচ্চু : বিদেশি শিল্পী আমাদের দেশে এলে আমরা তাদের দেশে যাব এটিই তো স্বাভাবিক নিয়ম। সাংস্কৃতির বিনিময় হিসেবে এমনটিই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টোটি হচ্ছে। বিদেশি শিল্পীরা আমাদের দেশে এসে গেয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমাদের তাদের দেশে নিচ্ছে না। এই দেশের নাগরিক হিসেবে তো আমি বিষয়টিকে সহজে মেনে নিতে পারি না। বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে মাতামাতি করে আমাদের দেশের বরেণ্য শিল্পীদের ছোট করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমরা যখন কোনো অনুষ্ঠান করতে যাই তখন একটি কথাই শুনি ‘টাকা নেই’। অথচ বিদেশি শিল্পীদের কোটি কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা যারা গান করি তাদের মানুষের বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতে হবে।
কুমার বিশ্বজিত্ : প্রথমত, আমি একটি কথা বলতে চাই, সংস্কৃতির কোনো প্রাচীর নেই। কোন দেশ থেকে শিল্পী আমাদের দেশে এলো এটি কোনো মুখ্য বিষয় নয়। তবে সাংস্কৃতিক বিনিময়টা যথার্থভাবে হচ্ছে না। আমি মনে করি আমাদের দেশের শিল্পীদের প্রফেশনালিজমের অভাব রয়েছে। এমনটি অনেক দেশেই আছে। যারা নিজেদের ভালোভাবে প্রেজেন্ট করতে পারবেন তারাই এখানে এগিয়ে যাবেন। আমরা যদি নিজেরা এই যোগ্যতা অর্জন করি তাহলে আমরাও এই সুযোগ পাব। আমাদের পাশের দেশে আমাদের অডিও অ্যালবামের প্রচার হয় না। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সেখানে দেখানো হলো ওই দেশের শ্রোতার মাঝে আমাদের পরিচিত তৈরি হতো। তখন ওখানে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো, যেমনটি ওই দেশের শিল্পীদের বেলায় হয়েছে।
ফাহমিদা নবী : বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে মাতামাতি যেভাবে বেড়েছে তাতে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে যে, আমরা আর গান-বাজনা করব কি-না। বিদেশি শিল্পী আমাদের দেশে অবশ্যই আসবে, আমি এর বিপক্ষে নই। কেননা সুরের কোনো বাধা নেই, দেয়াল নেই। কিন্তু তারা আমাদের দেশে আসবে আর তাদের দেশে আমাদের নেবে না এটা তো হয় না। একতরফাভাবে শুধু বিদেশি শিল্পীদের দিয়ে কনসার্ট করে আমাদের দেশকে ছোট করা হচ্ছে বলেই আমি মনে করি। এটি খুবই দুঃখজনক। এই ধারা বন্ব্দ হওয়া উচিত। আমাদের দেশের শ্রেতাদের নষ্ট করা হচ্ছে এসব বিদেশি শিল্পীকে নিয়ে এসে। যারা এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন তাদের বুঝতে হবে বাঙালি সম্মানী জাতি। তাদের এভাবে অসম্মানিত করার কোনো অধিকার তাদের নেই।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ২:১৫