
এক.
ধান পাকার মৌসুম। অনেক দূর পর্যন্ত শুধু ধানক্ষেত..... সবুজ আর সোনালী মেশানো গালিচা! মাঝে মাঝে কাঁটাওয়ালা বাবলা গাছ। ফিঙ্গে পাখি ধান ক্ষেতের সামান্য উপর দিয়ে উড়ছে.... পোকামাকড় ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গিয়ে বসছে বাবলা গাছে। আছে অনেক শালিক...চড়ুই-ও।
গুলতি নিয়ে পাখি শিকারে নেমেছে একটি ছেলে। বয়স দশ কি এগারো। খুব সতর্ক হয়ে নিশানা ঠিক করে গুলতি ছুঁড়ছে সে... যুৎসই তাক হচ্ছেনা একটাও...কিন্তু উৎসাহে যেন কমতি নেই! একসময় ক্ষান্ত হলো সে। চারিদিকে চোখ ফেরালো। সূর্য তখন মাঝ আকাশে। ঢেউ খেলিয়ে বয়ে যাচ্ছে মাতাল বাতাস.... দোল খাচ্ছে ধানের শীষ! সূর্যের কিরণে চকচক করছে সোনালী ধান! আপনমনে সবুজে মেশানো সোনারোদ্দুর উপভোগ করতে লাগলো ছেলেটা! গোয়ালের গরুগুলোকে গাঙে নিয়ে যেতে ভুলেই গেল সে।
দুই.
অসময়ে বৃষ্টি...তাও অবার ঝমঝম বৃষ্টি! হারু মাতবরের কাচারী ঘরের খামে হেলান দিয়ে বাইরের পানে একমনে চেয়ে রয়েছে ছেলেটি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ....ঝমঝম!। মাঠে খুটা দেয়া একটা গরু ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজছে। কাঠাল গাছের উপর পড়েছে বৃষ্টি..... ভিজছে একটা বুলবুলিও। কুমড়ো মাচানে বৃষ্টি!...... বৃষ্টির ঝাপটায় কুমড়োর ডগাগুলো নেতিয়ে পড়েছে। ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে কিশোর ছেলেটি! বৃষ্টি ধোয়া কাঁঠাল পাতায় শেষ বিকেলের আলো পড়ে সতেজ সবুজ দেখাচ্ছে! বিমুগ্ধ চোখে সবুজে ভেজা সতেজ প্রকৃতি দেখছে সে ঠায় দাঁড়িয়ে.... বাড়ী ফেরার যেন কোন তাড়া নেই তাঁর!
তিন.
চারিদিকে বাঁধভাঙা জোছনা! সেই জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছে জয়নবদের বাড়ীর বিশাল উঠোন, টেপির মার ছনের ভাঙা ঘর, পেয়ারা তলায় আবুর মার কবর....পুকুর ঘাট, কলের পাড়! খালের উপরে এক বাঁশের সরু সেতুর মাঝখানে পা ঝুলিয়ে বসে আছে ছেলেটি। চারিদিকে হু হু বাতাস..... নারকেল আর সুপারি বাগানে পাতা নড়ার ঝিরিঝিরি শব্দ! আকাশে মস্ত থালার মত চাঁদ.... একখানা কম্পমান চাঁদ ঝকঝক করছে খালের পানিতেও। জোয়ারের পানি ঠেলে উঠে এসেছে খালে। একটা কলাগাছের ডোঙ্গা ভেসে গেল সেতুর নীচ দিয়ে...এরপর গেল একটা মরা গাছের ডাল, তারপর কিছু ঝরা পাতা.....।
বাবার পিটুনির ভয়ে আজ সন্ধ্যায় বাড়ী ফেরেনি ছেলেটি! হু হু বাতাস, পাতার ঝিরিঝিরি আর উত্তাল জোছনা প্রাণ ভরে উপভোগ করছে সে। চারদিকে আলোর বন্যা....মন ছেয়ে থাকা আশ্চর্য সুন্দর এক ভাললাগা অনুভূতি!

চার.
গত উনচল্লিশটি বছর ধরেই আলোর বন্যায় ভাসছে আবু মিয়ার অনুভব, অনুভূতি! প্রতিদিনই অনুভব করেন সবুজে মেশানো সোনারোদ্দুর..... প্রতিদিনই উপভোগ করেন আকাশ ভরা জোছনা, বৃষ্টি ভেজা সবুজ সতেজ প্রকৃতি! একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে বাবলার কাঁটা দিয়ে কিশোর আবুর চোখ নষ্ট করে দেয় সোবহান রাজাকার। সেই থেকে চোখ নেই আবু মিয়ার। কিন্তু আবু মিয়ার চোখে কখনও আঁধার নামেনি..... আবু মিয়াদের চোখে কখনও আঁধার নামেনা!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৪০