পাহাড়ের ঢালে ঢলে পড়া সূর্যাস্ত !
কিছুদিন আগেও 'সাজেক' নামটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল। কিন্তু 'সাজেক' নামটাতেই কেমন যেন একটা আকর্ষণ আছে! ঠিক করে ফেল্লাম... সাজেক যেতে হবে।
সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। রাঙামাটির একেবারে উত্তরে এর অবস্থান। কিন্তু সড়ক পথে গেলে যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। সাজেকে গিয়ে 'সাজেক' নামে কোন গ্রাম বা লোকালয় পেলামনা, পেলাম তিন পার্বত্য জেলার (সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম) সর্ব উত্তরের সর্বশেষ বিডিআর বিওপি এবং আর্মি ক্যাম্প! এটাই সাজেক পয়েন্ট। পাহাড়ের উপরিভাগ পরিস্কার করে আর্মি এবং বিডিআর-এর পাশাপাশি দু'টি ক্যাম্প!
দূর থেকে সাজেক বিডিআর ক্যাম্প।
বলে রাখা ভাল.... মূলতঃ বাংলাদেশের এই অঞ্চলের সীমান্ত প্রহরাবিহীন বা বলতে পারেন উন্মুক্ত। ইন্ডিয়া অংশেও তাই। সাজেক বিডিআর বিওপি হতে পূর্বদিকে মিজোরাম বর্ডারের দূরত্ব একদিনের হাঁটা পথ, আর উত্তরের ত্রিপুরা সীমান্ত যেতে আপনাকে হাঁটতে হবে পুরা তিন দিন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পাহাড় আর গহীন অরণ্যে ঘেরা এই সীমান্ত রেখা প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত বলতে পারেন।
কুয়াশায় ঢাকা পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা সাজেক।
সাজেক আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি পাহাড়ী আদিবাসীদের দু'টি পাড়া আছে... রুই লুই এবং কংলাক। সাজেক পয়েন্টে যাবার একটু আগেই পরবে রুই লুই পাড়া। এই পাড়াটির উচ্চতা ১৭২০ ফুট। এটি ক্ষুদ্র জাতীগোষ্ঠী পাংখোয়া-দের বসতি। রাস্তার দু'ধারেই ঘর রয়েছে। চা খাওয়ার ছোট্ট দোকান রয়েছে। পাহাড়ী মেয়েরা হাতে টানা তাঁতে কাপড় বুনাচ্ছে অথবা কেউবা মোটা বাঁশের পাইপে তামুক খাচ্ছে। পাহাড়ী জনপদের জীবন-যাত্রা দেখতে আপনার ভাল লাগবে। তবে এখানেও যে যন্ত্রের ছোয়া লাগেনি, তা নয়! ডিজেল ইঞ্জিনে ধান ভাঙ্গানো দেখে আপনি হয়তো বলবেন.... পাহাড়ের এই শান্ত পরিবেশে এইসব উটকো ঘড়ঘড় যন্ত্র বড্ড বেমানান!
কংলাক পাহাড়ের পাদদেশে বন-প্রকৃতি।
পাহাড়ের চুঁড়ায় কংলাক পাড়ায় ঢোকার পথ।
সাজেক আর্মি ক্যাম্প হতে আরও তিন কিঃমিঃ কাঁচা রাস্তা পেড়িয়ে কংলাক পাহাড়। কংলাক পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত চাঁদের গাড়ী চলাচল করে। তারপর খাড়া পাহাড় বেয়ে অনেকখানি উঠতে হবে হেঁটে। পাহাড়ের মাথায় বড় একটা পাথরের চাট্টান পেরিয়েই কংলাক পাড়া - ছবির মত সুন্দর একটি আদিবাসী গ্রাম !
ছবির মত গ্রাম - কংলাক পাড়া
প্রতিটি বাড়ীর সামনেই রয়েছে ফুলের বাগান। ১৮০০ ফুট উচ্চতায় এই পাড়ায় পাংখোয়া আর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির প্রায় ৩০টি পরিবারের বসতি। এই পাড়া ঘুরে বেড়াতে আপনার ভাল লাগবে নিঃসন্দেহে! এখানে আপনি দেখতে পাবেন পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি চা বাগান, পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্ত বেশ কয়েকটি কফি গাছ... আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটু নীচে নামলে রয়েছে কমলা বাগান। গ্রামের কারবারী (গ্রাম প্রধান) আপনাকে স্বাগত জানিয়ে বলতেই পারে... কি খাবেন..... টি, কফি অর অরেঞ্জ জুস?! এখানে আপনি দূর্লভ সুগন্ধি 'আগর' গাছেরও দেখা পাবেন। এক কথায়... চমৎকার একটি গ্রাম দেখার সৌভাগ্য হবে আপনার!
বাঁশঝোপের পরেই বিচ্ছিন্ন একটি কমলা গাছ।
কংলাক পাড়ার এক উঠোনে শুকাতে দেওয়া কফি ফল।
কংলাক পাড়ায় মৃত ব্যক্তিদের স্মৃতি রক্ষার্থে পাথরের এপিটাফ।
ভারতের মিজোরামের সাথে পাংখোয়াদের যোগাযোগ ও যাতায়াত রয়েছে, রয়েছে আত্মীয়তাও! এখানকার অনেক পাংখোয়া ছেলে-মেয়ে মিজোরামের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলির বোর্ডিং-এ থেকে লেখাপড়া করছে। মিজোরাম সীমান্ত পেরুতে এদরে কোন পাসপোর্টি ভিসা লাগেনা।
কুয়াশায় ঢাকা দূরে উঁচু মিজোরামের পাহাড়।
কিভাবে যাবেন
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাবার রুটটা এমন....... খাগড়াছড়ি - দিঘীনালা - বাঘাইহাট - কাসলং - মাসালং - সাজেক। খাগড়াছড়ি থেকে মাসালং পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিঃমিঃ রাস্তা ভাল। কিন্তু মাসালং থেকে সাজেক পর্যন্ত ১৭ কিঃমিঃ রাস্তা খুবই খারাপ। রাস্তা পাকা করার কাজ করছে আর্মিদের একটা দল, ইসিবি-১৯। রাস্তার কাজ চলছে বলেই এখন রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। রিস্ক নিয়ে অনেকেই মাইক্রেবাসে নিয়ে সাজেকে যায় বটে, তবে ফোর হুইল ড্রাইভ ভাল কন্ডিশনের গাড়ী ছাড়া এই চড়াই-উৎরাই ভাঙ্গা রাস্তা পার হওয়া খুবই কষ্টকর। বরং মাসালং থেকে চাঁদের গাড়ী ভাড়া নেয়া যেতে পারে। ভাড়া প্রতিদিনের জন্য ২০০০ টাকা। সাজেকে পৌঁছানোর আগে পাঁচ কিঃমিঃ রাস্তা আপনাকে একটানা শুধু উপরের দিকে উঠতে হবে।
হাতে সময় থাকলে ঢাকা থেকে একটানা সাজেক পর্যন্ত না যাওয়াই ভাল। র্সূযাস্তের আগে পৌছাতে না পারলে আর সামনের দিকে এগুতে পারবেননা। সেক্ষেত্রে খাগড়াছড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে সাজেক রওনা হওয়া বেটার।
রাতে থাকার জায়গা
সাধারণের রাতে থাকার জন্য কোন রেষ্ট হাউজ বা কটেজ গড়ে উঠেনি এখনও। একমাত্র থাকার জায়গা আর্মিদের রেস্ট হাউজ। ইসিবি ১৯ এর নির্মাণ করা দু'রুমের চমৎকার একটি রেস্ট হাউজ! তবে আর্মি রেফারেন্স ছাড়া এখানে জায়গা হবেনা আপনার। আর্মি রেফারেন্স থাকলেও অন্ততঃ ১৫ দিন আগে বুকিং দিতে হবে এখাতে থাকার জন্য।
সাজেকে ইসিবি-১৯ নির্মিত ও পরিচালিত রেস্ট হাউজ।
কংলাক পাড়ায় বাঁশ-কাঠের তৈরী জেলা পরিষদের একটা ডাক বাংলো আছে বটে.... তবে সেটা থাকার অযোগ্য। সেক্ষেত্রে আপনি কংলাক পাড়ার কারবারীর আতিথেয়তা গ্রহণ করতে পারেন। আমরা যেদিন কংলাক পাড়ায় বেড়াতে গেছিলাম সেদিন কারবারী ছিলেন না, দায়িত্বে ছিলেন কারবারীর সহযোগী জারা পাংখু। কংলাকে রাত্রি যাপনের ইচ্ছে থাকলে জারা পাংখুর সাথে যোগাযোগ করে যেতে পারেন (যোগাযোগের নম্বর-০১৫৫৩২৮৭৪১৮)। ভাল কথা... সাজেকে টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাবেন। কোন কোন সেটে গ্রামীনের একদাগ নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় বটে, তবে নেটওয়ার্ক এই থাকে আবার এই নাই!
সন্ধ্যের আড্ডার আদর্শ জায়গা- সাজেক বিডিআর ক্যাম্পের একাংশ।
সাজেক রেস্ট হাউজে আমাদের রাতের আড্ডার আয়োজন।
ঢাকায় ফেরা
সাজেক ফেলে আসতে চাইবেনা আপনার প্রকৃতি প্রেমিক মন। অপরূপ এই পাহাড়ী প্রকৃতির স্মৃতি আপনাকে বারবার পিছে টানবে।
পিছে ফেলে আসা পাহাড়ী পথ
পথের ধারে নাম না জানা বুনো ফুলের ঝোপ।
পাহাড় থেকে সংগৃহীত কমলা পরিবহণের অপেক্ষায়।
পাহাড়ী পথে গোধুলী।
সাজেক ঘুরে দেখবার জন্য এক বেলাই যথেষ্ট! সাথে নিজেদের গাড়ী থাকলে সাজেক থেকে ফেরার পথে মারিশ্যা অথবা লংগদু ও মায়ানিমূখ দেখে আসতে পারেন। দু'টোই গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ী জনপদ! দিঘীনালা থেকে মারিশ্যা এবং লংগদু-এর রাস্তা ভাল। আমরা ফেরার পথে অতিরিক্ত দুই ঘন্টা (যাওয়া-আসা) ব্যয় করে দেখে এসেছি কাপ্তাই লেকের পাড়ের জনপদ লংগদু।
কাপ্তাই লেকের পাড়ে লংগদু ঘাট।
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পথটুকু চিটাগাং হয়ে না গিয়ে বারৈয়ের হাট ও রামগড় হয়ে গেলে সময় ও পথ বেঁচে যাবে অনেকটা। পাহাড়ী রাস্তার দু'ধারের দৃশ্যও মনোরম। ফেরার পথে হাতে অতিরিক্ত দু'ঘন্টা সময় থাকলে ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্ত-ও দেখে আসতে পারবেন এই ফাঁকে।
বিলোনিয়া সীমান্তের ২১৬০ নং সীমান্ত পিলার।
সামনের অনাবাদী ভু-খন্ডটি বিলোনিয়া সীমান্তের ডিজপুটেট ল্যান্ড - মুহুরীর চর।
তাহলে সুযোগ করে একবার ঘুরে আসুন সাজেক ভ্যালী। শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১১ রাত ৯:২৬