১)
স্কুল থেকে ফিরেই বিছানায় বইপত্রগুলো ছুরে ফেলে দিয়ে দৌড় দিলো রাসু।পিছন থেকে মায়ের বকুনী শোনা যাচ্ছে।সেদিকে কর্নপাত না করে দৌড়ের বেগ আরো বাড়িয়ে দিলো সে।হাঁপাতে হাঁপাতে কোন রকমে বাড়ীর পেছন দিকে একটু দূরে নদীর তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুরনো ভাঙ্গা বাড়ীর সামনে এসে দাড়ালো রাসু।বাড়ীটা দেখতে অনেকটা ভুতূড়ে বাড়ীর মত,চারপাশে সুপুরী গাছের সারি।আশেপাশে কাছাকাছি আর কোন বাড়ীঘর না থাকায় লোকজনের যাতায়াত ও কম এই জায়গাটায়।লোক চক্ষুর আড়ালে পড়ে থাকা প্রায় জনমানবহীন এই ছোট্ট ভু-খন্ডটির তথা এই বাড়ীটির আবিষ্কারক এই রাসুই।সে ই এর একমাত্র নাগরিক,ও দন্ডমুন্ডের কর্তা।
রাসুর পুরো নাম রাসেল।ক্লাশ সেভেনে পড়ে,বাবা-মা আদর করে রাসু নামে ডাকে।পড়াশুনায় খুব একটা ভালো না,তবে রাসুর বড় বোন মিলি পড়াশুনায় বেশ ভালো।বা-মা মিলিকে একটু বেশীই ভালোবাসে।এ নিয়ে রাসুর হিংসার শেষ নেই!বড় আপা মিলি কলেজে পড়ে,সামনেই পরীক্ষা তাই কিছুদিন ধরেই এক লোক মিলিকে পড়াতে রাসুদের বাড়ী আসছে,কালো কাঠির মত খ্যাংরা এক লোক,তার আবার গোফ ও আছে।চোখদুটী লাল লাল,বাবা কোথা হতে খুঁজে খুঁজে একে আনলো আপাকে পড়ানোর জন্য রাসু তা ভেবে পায়না।
লোকটাকে মোটেও পছন্দ হয়নি রাসুর,কেমন করে জানি তাকায়।লোকটার দিকে তাকালেই রাসুর শিড়দাড়া দিয়ে ভয়ের এক হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়।
কয়েকদিন আগে এই ভাঙ্গা বাড়ীটাতে বসেই এক অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছে রাসু। সে পরীদের সাথে কথা বলতে পারছে,তাদেরকে দেখতে পাচ্ছে।কয়েকদিন ধরেই সে দেখতে পাচ্ছে এ বাড়ীটাতে আসলেই কতগুলো পড়ী তার কাছে নেমে আসে,রাসুএ সাথে গল্প করে ,খেলে।ভীষন ভালো লাগে রাসুর।সে ইচ্ছেমত পরীদের কাছে বড়আপার বিরুদ্ধে নালিশ করে।
বড়আপাটা কেন যে এত ভালো হতে গেলো?সবাই ওকে কত্ত ভালোবাসে,রাসুর দিকে কারো কোন খেয়ালই নেই!পরীরা ওকে স্বান্তনা দেয়।একটা দুটো পরী না,অনেকগুলো পরী।লাল পরী,নীল পরী,সবুজ পরী,হলুদ পরী,সাদা পরী আরো অনেক।সবুজ পরীটাকে বেশী একটা পছন্দ করেনা রাসু।একদম বড় আপার মত,একটু বেশীই ভালো।বড় আপা যদি পরী হত তাহলে এই সবুজ পরীটার মতই হত। পরীটার কাছে গেলেই ওর ডানা থেকে কেমন যেন স্নিগ্ধ সবুজ ঘাসের সুন্দর একটা ঘ্রান পাওয়া যায়।বড় আপাও ঠিক এরকম।গাছপালা ওর অনেক পছন্দ,মাঝে মাঝে বড় আপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছের সাথে কথা বলে।রাসু দেখেছে অনেকদিন।চুপিচুপি। বড়আপাটা যে কি,পাগল একটা!!
২)
একবার,দুবার,তিনবার-পরপর তিনবার উপরিউপরি বিদ্যুত চমকালো।বিদ্যুতাঘাতে জর্জরিত আকাশ,মাঝে মাঝে গর্জে উঠছে সিংহের মত।বৃষ্টির একটি দুটি বড় ফোটাও পড়তে শুরু করেছে।হঠাৎ করেই ঝেঁপে বৃষ্টি এলো।মনে হচ্ছে এই বুঝি আকাশটা ভেঙ্গে পড়বে।বৃষ্টির এত বড় ফোটা আর কখনো দেখেনি মিলি।ফোটাগুলো যেন তীরের ফলার মত গায়ে এসে বিধতে চাইছে।সন্ধ্যা হতে চলেছে,রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।জানালা বন্ধ করতে বলছে মা।ধীরে ধীরে উঠে জানালাটা বন্ধ করে আবারো টেবিলে এসে বসলো মিলি।স্যারের পড়া একটুও ভালো লাগছে না,এমন দিনে কি দরকার ছিলো আসার।বৃষ্টির দিনে পড়তে ভালো লাগে কারো?
তারপরও বাধ্য হয়ে পড়ায় মনযোগ দিলো মিলি।হঠাত করেই টেবিলের তলায় নিজের পায়ের উপর অন্য একটি পায়ের শীতল স্পর্শ অনুভব করলো মিলি।হৃদপিন্ডটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার,কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা।প্রতিদিনই স্যার এরকম করেন,মাঝে কাঝে অকারনে পিঠে হাত দেন।মিলি ভয় পায় খুব,কিন্তু কাউকে কিছুই বলতে পারেনা।
৩)
রাত্রি শেষের বিজন রাস্তা,অবিশ্বাস্য রকমের নিঃস্তব্ধ,পথঘাট জনমানবশূন্য।মিলি জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে রইলো।ঘুম আসছেনা,কেমন যেন অস্থির লাগছে।বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মিলির মনে হচ্ছিলো কোন এক রুপকথার রাজকুমার যেন যাদুর কাঠি ছুঁইয়ে গোটা পৃথিবীটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে,শুধু সে ই জেগে আছে।এভাবেই অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো মিলি।রাত প্রায় শেষ,দূরের কোন দোকান থেকে হ্যারিকেনের টিমটিম আলো ভেসে আসছে।মনে হচ্ছে যেন একটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা।
ঘুম ভাংতে আজ অনেক বেলা হয়ে গেলো মিলির।শেষ রাতে ঘুমিয়েছে বলেই হয়তো এত দেরী ।পাশের ঘর থেকে বাবার রেডিওর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।এক্টার পর একটা চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন বাবা।নাহ! কোন খবরই তার পছন্দ হচ্ছেনা।ওদিকে রাসুও মা’র সাথে কি নিয়ে যেন চেচাচ্ছে।ঘুম থেকে উঠে দাত মাজতে মাজতে কলপাড়ে আসতেই রাসুর দেখা মিললো। মিলিকে দেখেই এক অদ্ভুত রকমের ভেংচী কেটে দিলো দৌড়।মিলিও রাসুর পেছন পেছন ছুটলো।কিন্তু দৌড়ে কি আর রাসুর সাথে পারা যায়?
মায়ের বকুনী শুনে শেষ পর্যন্ত মিলিকেই ফিরে আসতে হল।
কলেজে আজ একটা নাটক মঞ্চস্থ হবার কথা। মিলি অভিনয় করছে প্রধান চরিত্রে।হলের সুসজ্জিত পরিবেশ,মায়াবী আলো, গান-বাজনা,দর্শকের কোলাহল সব মিলিয়ে মিলির বেশ ভালো লাগছিলো।উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে।কি জানি কেমন হয়!অভিনয় চললো অনেকক্ষন ধরে,দর্শকরা নীরবে উপভোগ করলো মিলির অভিনয়।প্রিন্সিপাল স্যার নিজে মিলির মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।এত ভালো লাগলো মিলির,চোখ দিয়ে পানি চলে এল।আজ মা’ও এসেছিলো মিলির সাথে,বাবার শহরে একটু কাজ থাকায় আসা হয়নি।আর রাসুতো সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ায়।ফেরার পথে মা মাঝরাস্তায় নেমে গেলো,নানুবাড়ী হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরবে।সারাদিনের ধকল শেষে মিলির ভীষন ক্লান্ত লাগছিলো,অগত্যা সে বাড়ী ফিরে এল।
৪)
বারান্দার এক কোনার চেয়ারটাতে বসে পা দোলাচ্ছিলো মিলির স্যার।বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি লোকটার।স্যারকে দেখে মিলি বেশ অবাকই হল।আজ তো মা স্যারকে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন।তারপরও......
বাবা-মাও বাড়ীতে নেই,কেমন জানি ভয়ও করছিলো মিলির।হাত মুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসতেই এল ঝটকায় মিলির হাতটা টেনে নিলো স্যার।এত শক্ত করে চেপে ধরলো যে মিলির মনে হচ্ছিলো এই বুঝি তার হাড়গুলো গুড়ো হয়ে যাবে।
রাসু আজ আবারো সেই ভাঙ্গা বাড়ীটায় আসলো।অনেকক্ষন ঘোরাঘুরি করেও আজ কোন পরীর দেখা পাচ্ছেনা সে।বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর আস্তে আস্তে পরীদের নাম ধরে ডাকতে লাগলো রাসু। নাহ!কেউ নেই।তবে কি ওরা সবাই রাগ করেছে রাসুর উপর?
মিলি শতচেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারলোনা।বন্দী পাখির মত ছটফট করতে লাগলো।কেমন অস্থির লাগছে,ভয়ও লাগছে।টেবিলের উপরের ফুলদানিটাকেও আজ কেমন অসহ্য লাগছে,মনে হচ্ছে শূন্যগর্ভ ফুলদানীটা যেন হা করে তাকে গিলতে আসছে।নড়তে পারছেনা মিলি,গলা দিয়ে কোন শব্দও বেরুচ্ছেনা।
রাসু চারিদিকে হন্যে হয়ে পরীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।মনে প্রানে ডাকছে তাদের। অনেকক্ষন পর কোথা থেকে যেন সবুজ পরীটা উড়ে এলো।আজ উড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো পরীটার,এসেই ঝিম ধরে মাটিতে পড়ে গেলো।ডানাটা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে।কয়েকটা পালকও কে যেন নৃশংসভাবে উপড়ে নিয়েছে।ভীষন মায়া হল রাসুর।বললো,তোমার বাকী সঙ্গীরা কই?
পরীটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিলো না,কোন রকমে কষ্ট করে বললো, এখন আর আমি ওদের মত নই!
মিলি কিছুই ভাবতে পারছেনা।কোন কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।নিজের চোখ দিয়েই নিজেকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখছে সে।দূর থেকে কিসের যেন আওয়াজ আসছে।অসংখ্য ঝিঁ ঝিঁ পোকা এসে ঢুকছে মিলির ঘরে।মিলির অসহ্য লাগছে।এতো আলো! এতো আলো!
সে বুঝতে পারছেনা দিনের বেলায় এত ঝিঁ ঝিঁ পোকা কোথা থেকে আসলো?
রাসু আস্তে করে পরীটার পাশে এসে বসলো।ক্ষতস্থানটায় হাত বুলাতে গিয়ে দেখলো সেখানে অসংখ্য পোকা কিলবিল করছে,রাসু দেখতে পাচ্ছে কিভাবে পোকাগুলো ডানার মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঢুকছে!রাসু চেষ্টা করছে পোকাগুলোকে সরাতে,কিন্তু পারছেনা।পোকাগুলো মাংস ভেদ করে হাড়ে,হাড় ভেদ করে মজ্জায় পৌছে যাচ্ছে।
আর একটা একটা করে পালক খসে পড়ছে মাটিতে।