মেয়েটা আমার দিকে তাকাতে পারছে না লজ্জায়, আঠারো বছর বয়সী মেয়েদের চোখে এমন লজ্জা মানায় কিন্তু পঁচিশ পেরিয়ে যাওয়া একটা মেয়েকে এমন লজ্জাবনত দৃষ্টিতে একটু বেমানানই লাগে। আমি বসে আছি তার মুখোমুখি চেয়ারে, আমার পাশের চেয়ারে আমার বোন নাবিলা, সম্পর্কে আপন বোন না হলেও কোন ক্ষেত্রে তা থেকে কম নয়। মেয়েটা নাবিলার বান্ধবী, নাম চৈতী। খুবই কাছের বান্ধবী, ওদের ভাষায় ওরা একে অপরের 'কলিজার টুকরা'।
চৈতীর সাথে এটা আমার দ্বিতীয়বারের মতো দেখা, প্রথমবার দেখা হয়েছিল বছর সাতেক আগে এক বিকেলে খানিক সময়ের জন্যে জিন্দাবাজারে। এতদিনে সে অনেক বদলে গেছে, আগের সেই কিশোরী ভাবটা এখন আর নেই চোখে মুখে তবে আচার আচরনে এখনও বড় হতে পারে নি। ইংল্যান্ড থেকেছে গত সাত বছর, এই সাত বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কথার মধ্যে প্রচুর ইংরেজীর ব্যবহার, চেহারাও যেন আগের চেয়ে অনেক ফুটে উঠেছে, উজ্জ্বল শ্যামলা থেকে ফর্সাই হয়ে গেছে। ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছে গত মাসে, বেড়াতে এসেছে, চলে যাচ্ছে আগামী সপ্তাহে। আমার সাথে দেখা হওয়ার কোন কথাই ছিল না, হুট করে একদিন নাবিলা ফোন করে বলে, 'ভাইয়া, চৈতীর কথা মনে আছে? দেশে এসেছে, চলে যাচ্ছে ১৭ তারিখে, তোমার সাথে দেখা করতে চায়, একদিন আসতে পারবে সিলেটে? হাতে সময় নিয়ে।'
আমি আগপিছ না ভেবেই বললাম, 'আচ্ছা ঠিক আছে, আমাকে কখন আসতে হবে জানাবি, আসব।'
আজকে অবশেষে সবার হাতের সময় বের করেই একসাথে হওয়া, নাবিলার বিয়ে হয়ে গেছে দুবছর আগে। সাংসারিক মেয়ে, সংসার ছেড়ে বেরুতে পারে না আর আমি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, ব্যবসার জন্যে অন্য কোন দিকে সময় দিতে পারি না। এদিকে চৈতীরও চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে তাই ব্যস্ত, কেনাকাটা ও সব আত্নীয় স্বজনদের সাথে দেখা করায়।
চৌহাট্টার পাশেই মানরু শপিং সেন্টারে নতুন একটা কফিশপ 'ক্যাফে দ্যি আলপাইনো' খুলেছে, আগে দেখি নি। অবশ্য দেখার কথাও না, আমি অনেকদিন ধরে সিলেটের বাইরে এবং সিলেটে আসাও হয় না।
আমি চৈতীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এই মেয়ে? এই মেয়েই কিনা ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার আগে আমাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল! হুট করে তখন একদিন সে আমাকে ফোন করে বলে, 'আমি ডিসাইড করেছি আপনাকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাব, এইবারই।'
এর আগে অবশ্য কিছুদিন ফোনে টানা কথা হয়েছিল কাজে-অকাজে, অবসরে, বেশ আড্ডাও হয়েছিল। আমার সম্পর্কে আগে সে তেমন কিছুই জানত না, যা জানত তা নাবিলার মুখে শুনে শুনেই। আমি তাকে বুঝিয়েছিলাম তখন, হুট করেই বিয়ে সম্ভব না, তাছাড়া তার বাসায় মেনে নিবে কিনা এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিতও নয়। আনাড়ি একটা সিদ্ধান্ত হবে সেটা যদি বিয়ে করি এবং আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার প্রতি তার যে আবেগ তা ভালবাসা নয়, মোহ; আর সেই মোহ মুগ্ধতা কিংবা ভালবাসা থেকে নয়, করুণা থেকে। আমি কখনোই কারো নিকট থেকে করুণা নিতে আগ্রহী ছিলাম না, নয়ত জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক মেয়ে যে কিনা বিয়ের পরপরই সাথে করে নিয়ে যাবে ওদেশে! বেশ লোভনীয় প্রস্তাব, তাছাড়া তখন আমার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা খুবই করুণ ছিল। তাকে বিয়ে করলে হয়ত আমার অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যেত রাতারাতি, অভাবকে পিছনে ফেলে খুব সহজে বিলাসিতা গ্রহন করতে পারতাম। এছাড়াও কিছু ব্যাপার ছিল তার মধ্যে, আমি যেরকম চঞ্চল, অমায়িক, বাকপটু, ভদ্র মেয়ে চেয়েছিলাম সে তেমনই। উপরি হিসেবে আমার খুব পছন্দের ব্যাপার, ঠোঁটের নিচে থুতনীতে ছোট্ট তিল ছিল ও গালে টোল পড়ত তার। আমি দূর্বলতা কাটিয়ে বাস্তবতা চিন্তা করতে বলেছিলাম তাকে তখন। আস্তে আস্তে তার চলে যাওয়ার সময় হয়ে আসছিল, চলে যাওয়ার দিন দুয়েক আগে এক রাতে ফোন করে খুব কান্নাকাটি করল, আমি বেশ শক্ত ছিলাম তখন। হয় নি, তারপর সে চলে গিয়েছিল। তার যেদিন চলে যাওয়ার কথা ছিল, ঐদিন কেন জানি না আমি বিমানবন্দরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, একটু পর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছিলাম। হঠাত্ আবিষ্কার করি আমার চোখ গড়িয়ে দু ফোঁটা পানি পড়ছে, তখন মনে হয়েছিল, হারিয়ে ফেলেছি তাকে, একটু যদি ইচ্ছে করতাম হয়ত ধরে রাখতে পারতাম!
আমি ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, ঘোর কাটলো চৈতীর ডাকে, 'কী ব্যাপার! এতক্ষণ আমি চুপ ছিলাম, এখন আপনি চুপ হয়ে আছেন কেন?'
আমি একটু মুচকি হাসি ফুটিয়ে দীর্ঘশ্বাস লুকানোর চেষ্টা করে বলি, 'নাহ এমনি।'
তারপর আবার চুপ সবাই, তারা দুজনে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি ইতস্তত বোধ করছি। অনেকক্ষন পর, হঠাত্ চৈতী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, 'আপনি বিয়ে করলেন কেন? আমার জন্যে অপেক্ষা করতে পারলেন না?'
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে জল টলমল করছে, একটু এদিক ওদিক হলে যেকোন মূহুর্তে গড়িয়ে পড়বে। বাঁধ ভেঙ্গে গেল, সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার বুকে যেন 'ছ্যাত্' মেরে উঠল, উনুনের গরম তেলে পানি পড়লে যেমন হয়।