আব্দুর রাজ্জাক রানা, খুলনা : আইলার এক বছর কেটেছে কোটি কোটি টাকা আর হাজার হাজার টন চাল গম লুটপাটে। এ থেকে পিছিয়ে ছিল না এনজিওরা। এক বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সকল বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাঁধ মেরামতের ২৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও অর্ধ লাখ মেট্রিক টন গম, ত্রাণের ২ কোটি ৮ লাখ টাকা, গৃহ নির্মাণের ৬ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার টাকা এবং ৬ হাজার ২০৭ মেট্রিক টন চাল ঠিকাদার, জনপ্রতিনিধি আর পাউবো কর্মকর্তারা মিলে হজম করে ফেলেছে। একইভাবে আইলা দুর্গত অসহায় মানুষদের দেখিয়ে এনজিওগুলো রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে খুলনা ও সাতক্ষীরার ৪টি উপজেলার প্রায় ৮ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খবর প্রচার হবার পর বিদেশী বহু দাতাসংস্থা এগিয়ে আসে। আইলায় পানি উন্নয়ন বোডের্র আওতাধীন ৪টি উপজেলার প্রায় তিনশত কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে গত বছরই নগদ ৪২ কোটি টাকা এবং ৪০ হাজার মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করেন। কাজের চেয়ে সরকারি এই অর্থ আর গম লুটপাটই বেশী হয়। পরবর্তীতে জলাবদ্ধ মানুষকে উদ্ধারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড বাধঁ নির্মাণ, ক্লোজার নির্মাণ, বাঁধ সংস্কার কাজের জন্য একশত কোটি টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু পাউবোর আইনি জটিলতা আর সরকারি অর্থ ছাড়সহ নানা সমস্যায় শীতকালে বাঁধ নির্মাণের উপযুক্ত সময় পার হলেও কাজ শুরু না করে গত জানুয়ারি মাসে পাউবো মোট ৭৭ কোট ৮৮ লাখ টাকার টেন্ডার আহবান করে। এই টেন্ডার কাজ সিন্ডিকেটের কারণে আওয়ামী ঠিকাদাররা নিজেরা বাগিয়ে নেয়, যাদের বেশীর ভাগেরই বড় কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। তবে যৌথভাবে কাজের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে জাল জালিয়াতির কাগজপত্র দেখিয়ে টেন্ডার হাতিয়ে নেয়। ওয়ার্ক অর্ডার পাবার পর ঠিকাদারদের কাজ দাঁড়ায় কিভাবে টেন্ডারের অর্থ বৃদ্ধি করা যাবে। যার জলন্ত উদাহরণ কয়রা উপজেলার মঠবাড়িয়া শাখবাড়িয়া নদীর তীরে পবনা খালের ভাংগন। কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মহসিন রেজা বলেন, পবনার ক্লোজার করতে তিনি প্রথমে বিশ লাখ টাকা হলেই সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই কাজে গত মার্চ মাসে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয় তিন কোটি ৬০ লাখ টাকার। কিন্তু ঠিকাদার কাজে হাত দেয়ার পর থেকেই চলে কি করে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায় তার প্রচেষ্টা। ঠিকাদার পবনা ভাংগন ক্লোজ করার চেয়ে পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী, মহাপরিচালক আর পানি সম্পদ মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে তিন কোটি ৬০ লাখ টাকার কাজ বর্তমানে ৮ কোটিতে উন্নীত করেছে। এই ঠিকাদার নকশা বহির্ভূত কাজ করায় ইতোপূর্বে পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুশতাক আহমেদ প্রতিবাদ করায় ঠিকাদার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উক্ত তত্তাবধায়ক প্রকৌশলীকে বদলী করে দেয়। তার পর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ সমর্থক এই ঠিকাদার কাজের নিয়মকানুন না মেনে কাজের পরিধি বৃদ্ধি করে। পবনার এই ভাংগন ক্লোজ করার কথা থাকলেও শ্রমিকদের অর্থ না দেওয়ায় ৩ দিন আগে বেশীরভাগ শ্রমিক বাঁধ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তিনি আরো জানান, পবনার ভাংগনের কারণে কয়রা সদর উপজেলা সহ ৬টি ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার এবং ভিটেবাড়ি ছেড়ে উচু সড়কে অবস্থান নিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠিকাদার একদিকে কাজ না করে অর্থ বাড়ানোর পিছনে ঘুরছেন। আর সেই সুযোগে সাব কন্ট্রাক্টর, শ্রমিক সরদার, চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা লুটপাটের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছেন। কোন শ্রমিক সরদার ১০০ শ্রমিকের হিসাব দিলেও কাজ করেছে ৭০ জন, হিসাব নিতে গেলে দেখানো হয় বাকিরা বাথরুমে গেছে। একইভাবে এক বস্তা মাটি ৫ টাকা করে মজুরি নির্ধারিত, সেখানে ১ বস্তাকে ১৪/১৫ বস্তা পর্যন্ত হিসাব করা হচ্ছে। একইভাবে আইলা দেখিয়ে বিভিন্ন এনজিও দাতাদের কাছ থেকে যে অর্থ বরাদ্দ এনেছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এনজিওদের আইলা নিয়ে প্রাপ্ত অর্থের কোন হিসাব সরকারের কোন দপ্তরে নেই।
দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নের বিত্তবান কৃষক মনোরঞ্জন রায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আইলা নিয়ে সরকারি দলের এমপি আর চেয়ারম্যানরা ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের নিজেদের ভাগ্য গড়তে তারা বাঁধ নির্মাণ করছে না। মনোরঞ্জন রায় বলেন, প্রায় কোটি টাকার টেন্ডার করেও জেলে খালীর বাঁধ নির্মাণ করা যায়নি, অথচ প্রথম যখন ফাটল দেখা দিয়েছিল তখন মাত্র বিশ হাজার টাকা হলেই বাঁধ নির্মাণ করা যেত। তখন আর আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তিনি অভিযোগ করেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সমরেশ রায় আর এমপি বাবু আইলাবাসীদের দেখিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছে।
ক্ষোভের সাথে মনোরঞ্জন বলেন, তার বিশ বিঘা জমির ওপর পাকা ৫টি পাকা ভবন সবই আজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে শুধু ৪টি ধানের গোলা- আর আজ বছর খানিক ধরে তিনি পরিবার নিয়ে উচু বাঁধের ওপর অবস্থান নিয়েছেন। জেলে খালীর বাঁধ নির্মিত হতো, কিন্তু চেয়ারম্যন সমরেশ রায় বিলের পানির চাপ দিয়ে বাঁধটি পুনরায় ভেংগে দিয়েছে। যা আগামী বছর নির্মাণ ব্যয় ধরা হবে দশ কোটি টাকা। যা কিনা প্রথমে নির্মান করলে বিশ হাজার টাকায় সম্ভব ছিল। একই অভিযোগ করেন হরপ্রসাদ রায়, সুশান্ত মন্ডল, ফটিক রায় প্রমুখ। তাদের কথা আইলা থাকলে সাহায্য আসবে তাই নেতারা বাঁধ নির্মাণ করছে না।
দাকোপ উপজেলা কামারখোলা আর সুতারখালী দুটি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ বাড়ি ছেড়ে উচু ভিটায় বাস করছে। আইলায় ভিটা বাড়ি ছাড়া এই মানুষদের দেখিয়ে এনজিওদের কর্মকান্ড যাই থাক না কেন তাদের প্রচার প্রোপাগান্ডা অনেক বেশী। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে যেভাবে অসহয় মানুষগুলো বসবাস করছে ঠিক সেইভাবে দেখা যায় এনজিওদের সাইন বোর্ডের বাহার। এমনকি বাশের বেড়া আর ছেড়া ব্যাগ দিয়ে তৈরী ছাদ ছাড়া টয়েলেটের গায়ে সেটে দেয়া হয়েছে এনজিওদের সাইনবোর্ড। যে টাকা ব্যয় করে এই টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে তার চেয়ে বেশী টাকা ব্যয় হয়েছে টয়লেটের গায়ে সাইন বোর্ড দিতে। অক্সফাম নামে একটি এনজিও টয়লেট নির্মান করে প্রতিটির গায়ে সাইনবোর্ড লটকে দিয়ে লিখেছে এই টয়লেট নির্মাণ করেছে অক্সফাম।
উল্লাসী সৃজনী সংঘ একটি এনজিও আইলার ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন জিবীকার সহয়তা প্রকল্প নামে এলাকায় প্রায় দেড় হাজার নৌকা প্রদান করেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, তারা নৌকা পাবে এই আশায় উল্লাসী নামক এনজিও প্রতিনিধিদের কাছে নাম লিখিয়েছিল। এই নাম লিখতে গিয়ে সর্বনিম্ন ৫শত টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পযর্ন্ত ঘুষ নিয়েছে। তাদের ধারণা ছিল ৭/৮ হাজার টাকার নৌকা যদি হাজার খানেক টাকা ঘুষ দিয়েও পাওয়া যায় তবে ক্ষতি নেই নৌকা দিয়ে মাছ ধরেও সংসার চালানো যাবে। কিন্তু এই এনজিওটি আইলা বাসীদের যে নৌকা সাহায্য হিসাবে দিয়েছে তা নৌকা- পুকুর বা কোন পানিতেই চলে না। নৌকায় যে কাঠ আর পেরেক ব্যবহার করা হয়েছে তা সব মিলিয়ে মূল্য ২ হাজার টাকাও হবে না। নৌকা পাবার পর বেশীর ভাগ মানুষ নৌকাগুলো জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করেছে।
তাই এলাকাবাসী উল্লাসী এনজিওর নাম দিয়েছে ‘‘ খাদক উল্লাসী ’’ ।
এ ব্যাপারে দাকোপ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেন এসব ঘটনার কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেন, উল্লাসী নামক এনজিও যে নৌকা দিয়েছে তা কোন অবস্থাতে ব্যবহারের উপযোগী নয়। তিনি বলেন নৌকাটি এনজিও ব্যয় মূল্য দেখিয়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে ঐ নৌকা তৈরিতে ব্যয় দুই হাজার টাকার উপরে হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যান আরো বলেন, উপজেলা সভায় এনজিওদের কর্মকান্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি একটি এনজিও নাম উল্লেখ করে বলেন আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের দেখিয়ে এনজিওটি ৫০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান বাঁধ নির্মাণে পাউবোর বর্থ্যতাকেই দায়ি করলেন।
এব্যাপারে পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করলেও তিনি কয়রার পবনা ক্লোজারসহ ৬/৭টি বাঁধ মেরামত সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন শেষ মুহূর্তে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বাঁধ মেরামত করা যাচ্ছে না। আগামী শীত মওসুমে সেগুলোর কাজ সম্পন্ন করা হবে।
তিনি আরো জানান, বাঁধ নির্মাণ বাবদ তাদের মোট বরাদ্দ একশত কোটি টাকা। আর সেখানে তারা টেন্ডার আহবান করেছেন ৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার। অর্থ হাতে পেয়েছেন ২৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা যার মধ্য হতে ঠিকাদারদের পরিশোধ করা হয়েছে ২৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আইলার এক বছর পার হয়ে গেলেও বরাদ্দকৃত একশত কোটি টাকা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে অন্য ফান্ডের টাকা দিয়ে কাজ চলছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এবছর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করা যায়নি বলে তিনি স্বীকার করেন ।
খুলনা জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোঃ আতিয়ার রহমান বিশ্বাস জানান, আইলার পর থেকে এ পর্যন্ত ত্রাণের জন্য ২ কোটি ৮ লাখ টাকা, গৃহ নির্মাণের জন্য ৬ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হজার টাকা এবং খয়রাতির ৬ হাজার ২০৭ মেট্রিক টন চাল দেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে শাড়ি, লুঙ্গি ও ত্রিপল বিতরণ করা হয়েছে। যার বেশীরভাগই দেয়া হয়েছে কয়রা ও দাকোপ উপজেলায়। এসব মালামাল বিতরণের সময় লুটপাট করা হয়েছে বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। এ পর্যন্ত আমরা কোন লিখিত অভিযোগ পায়নি।