somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অণুজীব কর্পোরেট বিজ্ঞাপনগাঁথা (চতুর্থ কিস্তি)

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অণুজীব কর্পোরেট বিজ্ঞাপনগাঁথা সিরিজের তৃতীয় কিস্তিতে আমি আমার সেই কর্পোরেট ওয়ার্কার ব্যাকটেরিয়ার নাম আপানদের বলে ছিলাম যিনি কিনা পরিবেশ দূষণ রক্ষা করার পাশাপাশি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জিন্স এর জন্য নীল রং বা ব্লু ডাই উৎপাদনে পটু। অণুজীব কর্পোরেট বিজ্ঞাপনগাঁথা এর চতুর্থ কিস্তিতে এই ব্যাকটেরিয়া কিভাবে নিজেকে নীল রং তৈরির কাজে দক্ষ ওস্তাদ বানিয়ে ফেলেছে সেই প্রক্রিয়া বর্ণনা করব।






তৃতীয় কিস্তিতে আমি ব্লু ডাই উৎপাদনের জন্য যে ই. কোলি ব্যাকটেরিয়ার কথা উল্যেখ করেছিলাম প্রকৃত অর্থে কিন্তু এই ই.কোলি এর নিজস্ব ক্ষমতা তেমন নেই। এর শরীরের ক্রোমোসমে যখন অন্য একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে ছোট্ট একটি অংশ অর্থাৎ জিন এনে বসিয়ে দেয়া হয় ঠিক তখনই সে নিজেকে ব্লু-ডাই এর কারিগর হিসেবে প্রকাশ করতে পারে।
সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার অধিকাংশ প্রজাতিতে পাওয়া যায় এন এ এইচ ৭ নামে প্লাজমিড যার জিন গুলোর নির্দিষ্ট কলকব্জা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেন নীল রং বানাবার এক মাইক্রোবিয়াল পদ্ধতির। বিজ্ঞানীদের আসল লক্ষ্য ছিলো সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিগুলোতে থাকা এন এ এইচ ৭ নামক প্লাজমিডের কোন্ কার্যকলাপের মাদ্ধমে তারা বিভিন্ন অরগানিক উপাদান যেমন ন্যাপথালিন, টলুইন, জাইলিন এবং ফেনল কেও আর্টিফিসিয়াল কালচার মিডিয়াম অর্থাৎ ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত ব্যাকটেরিয়ার চাষাবাদ করার ক্ষেতগুলোতে কার্বনের চাহিদা পূরণের জন্য কাজে লাগায়। যেখানে সাধারণত সুক্রোজ বা আমাদের খাবার চিনিকেই অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া বেড়ে উঠবার জন্য ব্যবহার করে থাকে!
এই গবেষণা কাজের জন্য জিন প্রকৌশলীরা সিউডোমোনাস এর শরীরে থাকা এন এ এইচ ৭ নামক প্লাজমিডকে বের করে এনে মলিকুলার কাঁচি ( রেস্ট্রিকশন এনজাইম) দ্বারা কেটে সেটাকে আবার পি বি আর ৩২২ প্লাজমিডের ভিতরে মলিকুলার আঠা (লাইগেজ এনজাইম) দিয়ে আটকিয়ে দেন। এরপর এই পি বি আর ৩২২ প্লাজমিডকে ই কোলি এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এতসব কষ্টের কারণ হলো যদি এন এ এইচ ৭ প্লাজমিডকে সরাসরি ই কোলি এর মধ্যে ঢুকানো হত তাহলে ই কোলিতে ঐ প্লাজমিডের জিনগুলোর ফাংশন ঠিকভাবে বোঝা যেতনা। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সিউডোমোনাসের শরীরে থাকা প্লাজমিড এর কার্যকলাপ জানবার জন্য কেন তাকে ই কোলি এর শরীরে ঢুকানো হবে! এর উত্তর হলো ই কোলি হলো মলিকুলার বিজ্ঞানীদের কাছে গিনিপিগ বা ইঁদুর এর মত যা যে কোনো গবেষণাতেই ব্যাবহার করা হয়। আর এই ই কোলি এর চাষাবাদ এবং লালন-পালন করা বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ সহজ। এরপর ই কোলি গুলোতে আসলেই এন এ এইচ ৭ এর জিন নিয়ে পি বি আর ৩২২ প্লাজমিড ঢুকলো কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য অ্যাম্পিসিলিন এবং টেট্রোসাইক্লিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সেন্সিটিভিটি টেস্ট করা হয় ( জিন প্রকৌশলীদের এই টেকনিকগুলো নিয়ে পরবর্তী অন্য কোনো পোষ্টে বিস্তারিত বলব আশা রাখি)।
এরপর সেই রিকম্বিনেন্ট( উপরের প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাকটেরিয়ার শরীরে অন্য কোনো জীব বা ব্যাকটেরিয়ার জিন প্রবেশ করানোকে রিকম্বিনেশন বলে, আর যে ব্যাকটেরিয়ার শরীরে এই কাজটা করা হলো তাকে বলে রিকম্বিনেন্ট ব্যাকটেরিয়া) ব্যাকটেরিয়াকে ক্ষেতের মধ্যে অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল কালচার মিডিয়ামে গ্রো করানো হয়। কিন্তু এই মিডিয়ামে কার্বনের সোর্স হিসেবে চিনি ব্যবহার না করে তেজস্ক্রিয় ন্যাপথালিন ব্যবহার করা হয়। তেজস্ক্রিয় ন্যাপথালিন ব্যবহারের কারণ হলো এই ন্যাপথালিনকে হাইড্রোলাইসিস করে ই কোলি এর দেহে যেসব অনুদ্বায়ী মেটাবোলাইটসগুলো তৈরি হবে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা (ন্যাপথালিন উদ্বায়ী হওয়ায় তা উবে যাবার সম্ভাবনাই বেশি তবুও ই কোলি এর শরীরে কিছু মেটাবোলাইট পাওয়া যায় যেগুলো ন্যাপথালিন হতেই উৎপন্ন)। পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীরা ই কোলি এর এই রিকম্বিনেন্ট স্ট্রেইনকে অবজারভ করে দেখতে পান যে মিডিয়ামে থাকা ন্যাপথালিনগুলো স্যালিসাইলিক এসিডে পরিণত হচ্ছে। আর ঐ মিডিয়ামের আরেকটি উপাদান যখন ট্রিপ্টোফ্যান নামক অ্যামাইনো এসিড ব্যবহার করা হয় তখন কেন যেন সম্পূর্ণ মিডিয়ামই নীলে পরিণত হচ্ছে।
এই নীল রং কে পরবর্তীতে পরীক্ষা করে জানা যায় যে এটা হলো সেই ইন্ডিগো যা দিয়ে কাপড়ে নীল রং করা হয় আর যার কারণে আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে “নীল বিদ্রোহ” হয়েছিলো!
এই মাইক্রোবিয়াল ইন্ডিগো কিন্তু এতো সহজে ই কোলি বানাতে পারে না। সে নিজের শরীরে বেশ জটিল বিক্রিয়া ঘটিয়ে এই নীল উৎপাদন করে। বিক্রিয়ার শুরুতে ই কোলি তার শরীর হতে ট্রিপ্টোফ্যানএজ নামক এনজাইম নিঃসরণ করে, যা মিডিয়ামে থাকা ট্রিপ্টোফ্যানকে ইনডোল এ পরিণত করে।


মিডিয়ামে ইন্ডিগো তৈরি করেছে ব্যাকটেরিয়া


পরবর্তীতে ই কোলি এর শরীরে যে রিকম্বিনেন্ট ডি এন এ অর্থাৎ এন এ এইচ ৭ প্লাজমিড এর জিন নিয়ে পি বি আর ৩২২ এর ডি এন এ ঢুকানো হয়, সেখানকার এন এ এইচ ৭ এর জিন অংশ হতে ন্যাপথালিন ডাই অক্সিজিনেজ নামক এনজাইম তৈরি হয়। ন্যাপথালিন ডাই অক্সিজিনেজ আগের ধাপে উৎপন্ন হওয়া ইনডোল কে সিস-ইনডোল ডাই হাইড্রোডায়োল এ পরিণত করে। এরপর মিডিয়াম হতে ধীরে ধীরে পানি নিঃশেষ হতে থাকে এবং বাতাসের সংস্পর্শে আসলেই এই মিডিয়াম হতে নীল উৎপন্ন হয়।

ট্রিপ্টোফ্যান ---(ট্রিপ্টোফ্যানএজ) -→ ইনডোল

(ন্যাপথালিন ডাই অক্সিজিনেজ)

সিস-ইনডোল ডাই হাইড্রোডায়োল

পানি অপসারণ

ইন্ডোক্সিল

ইন্ডিগো

টি ও এল (TOL) নামক আরেকটি প্লাজমিডকে একইভাবে ই কোলিতে প্রবেশ করানো হলে এখান হতে জাইলিন অক্সিডেজ নামক এক ধরণের এনজাইম উৎপন্ন হয় যা ট্রিপ্টোফ্যান কে ট্রিপ্টোফ্যানএজ নামক এনজাইমের প্রভাবে উৎপন্ন হওয়া ইনডোলকে ডাইরেক্ট ইন্ডোক্সিল এবং পরবর্তীতে ইন্ডিগোতে কনভার্ট করতে পারে।

ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ডাই করা কটন

নীল রং ই কোলি আমাদেরকে তো বানিয়ে দিলো এখন এই ডাই দিয়ে যখন ব্লু জিন্স বানানো হলো তখন দেখা গেলো যে জিন্সের নীল রং এর মাঝে কেমন যেন লালচে ভাব দেখা যাচ্ছে! এরকম নীল জিন্স এর মাঝে লালচে রং থাকলেতো ক্রেতারা ঐ জিন্স কিনবেনা! তাহলে কি ই কোলি এর নীল রং দিয়ে জিন্সকে রাঙ্গানোর এতো কষ্টকর প্রচেষ্টা বৃথা যাবে? না! গবেষকরা তা হতে দেননি। যেই জিন এর কারণে ই কোলি এর কষ্টের ফসল নীল রং এর মাঝে লাল এর ভেজাল থাকার অপবাদ এসেছিল তা কেটে বাদ দেয়া হয় এবং দেখা যায় এবার তাতে আর কোনো প্রকার সমস্যা নেই। ই কোলি নিজেকে নীল রং তৈরির কারিগর হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হলো! এবার পালা তার পুরোদমে কাজ শুরু করবার। ইতিমধ্যেই অবশ্য আশার আলো দেখেছে সে। ডেনিম তাকে দিয়ে ডাই তৈরিতে আগ্রহী হয়েছে এবং কিছুটা উৎপাদন শুরুও হয়েছে। লেভিস জিন্স কোম্পানি এর অর্থায়নে জিনকোর কোম্পানির মাধ্যমে ৪০০,০০০ স্কোয়ার গজ ব্যাকটেরিয়া ডাইড জিন্স ইতিমধ্যে তৈরিও করে ফেলেছে আমার এই অণুজীব ক্লায়েন্টটি!



বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ষোল হাজার টনের অধিক নীল উৎপন্ন করা হয় শুধুমাত্র ডেনিম কোম্পানির জন্য! বর্তমানে ইন্ডিগো এর বার্ষিক বাজার মুল্য প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপর (প্রতি কেজি আট থকে সতেরো ডলার)।
আর এই ইন্ডিগো বা ব্লু ডাই এর চাহিদা পূরণের জন্য তা উৎপাদন করা হয় অ্যানিলিন, ফরম্যাল্ডিহাইড, সায়ানাইড এরকম বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান হতে যা রাসায়নিক বর্জ্য হিসেবে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।এই পরিবেশ দূষণ থেকে আমাদের পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে তাই প্রয়োজন মাইক্রোবিয়াল এবং উদ্ভিদ উৎস হতে নীল এর উৎপাদন নিশ্চিত করা। আমাদের এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা আর কর্পোরেট অণুজীব বন্ধুদের সহযোগিতায় আমরা আবার সুন্দরভাবে গড়ে তুলব এই প্রত্যাশায় অণুজীব দ্বারা নীল রং তৈরির এই বিজ্ঞাপন এখানেই শেষ করছি।










সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:২৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×