গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া কারো কারো অনেকসময় কেমন যেন হতাশার হয়ে উঠে, যখন নিজের কিছু ছোট ছোট চাহিদা পূরণ করাও কষ্টসাধ্য মনে হয় বা সম্ভব হয়ে উঠে না। কোনকোন সময় মনে হতে থাকে জীবনটা মিছেই থেকে গেলো। তারমধ্য যদি লেখাপড়া করে থাকতে হয় বেকার-কর্মহীন তাহলে তো তার মাথার উপর আকাশের বেশিরভাগ ওজনই ভর করে থাকে। এতো বুজা মনে হয় যে গাড় সোজা করাই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। বাবা-মা'র চোখেমুখে হতাশা কেমন যেন বুকের ভিতর আঘাত করে, পাড়াপড়শির আঁড় চোখে তাকানো, মনের মানুষটির কেমন যেন উঁড়ুউঁড়ু ছাড়াছাড়া ভাব, সবকিছু কেমন যেন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠে। সবসময় নিজেকে যুদ্ধ করতে হয় নিজের মনের সাথে। মন তো আর ধনি গরীব সময় অবস্থান বুঝে না, যখনতখন যেখানেসেখানে তার অবাধ বিচরণ।
বেশকিছু দিন যাবৎ মনটার সাথে ভীষণ যুদ্ধ চলছে মিলনের। কিছুতেই বোঝ মানছে না মনটা। মাঝেমাঝে চিৎকার করে কাঁদতে চায় মিলন, পারেনা লোকলজ্জায়। আবার বাবা-মা'র মনের অবস্থা একেবারে সূচনীয় হতে পারে এটাও ভাবায় মিলন'কে। পল্লীচিকিৎসক বাবা'র সামান্য আয়ে তিন ভাই এক বোনকে লেখাপড়া করিয়ে বড় করে তুলতে বাবা-মা'য়ের অনেক কষ্ট ত্যাগী সময় পার করতে হয়েছে। মিলন মেজো ছেলে হলেও তার বাবা'র অভাব অনটনের সংসার চালাতে কষ্ট হয়েছে তা ভালোই টের পাচ্ছে মিলন। বড়ভাই উচ্চশিক্ষিত হয়ে একটা বেসরকারি কলেজের প্রভাষক হয়েছে। তার টিউসনি আর বেতন মিলিয়ে যা পায় তা তার দুই ছেলেমেয়ে বউ নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাবাকে তেমন একটা সহযোগিতা করতে পারেনা। মিলন সবেমাত্র এবার ডিগ্রী পাস করেছে। ইচ্ছে না থাকার পরও তাকে চাকরির জন্য খোঁজাখুঁজি করতেই হয়। ঘরে যুবতী বোন, ছোটভাই এবার দশম শ্রেণিতে। তার প্রাইভেট খরচ না লাগলেও কোচিং খরচ দিতেই হয়, যদিও মিলন প্রাইভেট কোচিং ছাড়াই এপর্যন্ত এসেছে। কিন্তু ছোটভাইয়ের হিসেব আলাদা, তাকে কোচিংয়ে যেতেই হবে বায়না। এদিকে গৃহস্থালি জমি যেটুকু আবাদ করে তা দিয়ে সারাবছর চাউল না কিনতে হলেও মাছ তরকারি ঠিকই কিনতে হয় বাজার খেকে। সবমিলিয়ে মিলনের পরিবারের অবস্থা সচ্ছল হতে পারলো না কোনদিন। মিলনের মাথায় কেমন যেন খুব একটা বেশিই চিন্তা হচ্ছে সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়ে।
ভাবনা মেয়েটি দেখতে শুনতে ভালোই, মিলনের দুই ক্লাস নিচে একই স্কুলে পড়েছে, বাড়িও তাদের কাছাকাছিই। ভাবনা এবার কলেজে উঠেছে। কলেজে গিয়েই ভাবনার আচরণ কেমন যেন পরপর মনে হতে লাগে। আগের মতো দেখা হয় না, কথা হয় না, একদিন পরপর প্রেমপত্রও আর আসে না ভাবনার কাছ থেকে। ওদিকে ভাবনার বয়সের তুলনায় শরীর একটু বেশিই বড়সড় মনে হওয়ায় প্রতিবেশী ও তার বাবা-মা'র মাথায় ভূত চাপছে মনে হয়, ভাবনাকে বিয়ে দিবে বলে কিছুদিন পরপর পাত্র জোগাড় করতে থাকে। এতদিন তো ভাবনার সহযোগিতায় সব বিয়ের আয়োজন পণ্ড করতে পেরেছিল, এবার মনে হয় সেই সুযোগটিও হবে না মিলনের।
উচা লম্বা ফর্সা সুন্দর লিকলিকে যৌবনা ভাবনার জন্য এলাকার ছেলেরাও যে বেশিই পাগল, সবাই দেখেই বাবা-মা বা ঘটক পাঠিয়ে দেয় সোজা ভাবনার বাবার কাছে। একবার সেনাবাহিনীর এক সুদর্শন ছেলে ভাবনাকে দেখে বিয়ে করার জন্য খুব চেষ্টা চালাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছিল। ভাগ্য ভালো সেদিন ভাবনার সাথে দেখা হয়েছিল মিলনের। তাই বুঝি ভাবনার মনে প্রেম জেগেছিল মিলনের জন্য। ছেলেটিকে ফোন করে ডেকে এনে সোজাসুজি বলে দিয়েছিল, 'দেখুন, আমি একজনকে ভালোবাসি, বিয়ে আমি তাকেই করবো। আপনি যদি আমার বাবা মা'কে বুঝিয়ে লোভ দেখিয়ে বিয়ে করেন তারপরও সময় সুযোগ বুঝে আমি সেই ছেলের সাথে ভেগে যাবো। এখন আপনি ঠিক করেন আমাকে বিয়ে করে নিজের জীবনে কলঙ্ক ডেকে আনবেন নাকি আমার ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখাবেন।' যাক, তারপর কাজ হয়েছিল, ছেলেটি আর বিয়ের জন্য এগিয়ে আসেনি। কিন্তু অবস্থাটা খারাপ হয় যখন এই কথা তার বাবার কানে পৌঁছায়। এরপর থেকে ভাবনাকে বিয়ে দেয়ার জন্য তার বাবা পাগলের মতো হয়ে গেছে।
শুনেছি গতকাল নাকি কোনএক প্রফেসর ভাবনার ছবি দেখেই পাগল হয়েছে, খুব দ্রুত বিয়ের জন্য তাগদা দিচ্ছে ঘটকের কাছে। খুব বড়লোক তার উপর উচ্চশিক্ষিত এমন জামাই পেয়ে ভাবনার বাবা-মা'ও যে আর দেরি করবেনা তা ভালোই বুঝতে পারছি। শুধু ভাবনার বাবা-মা'ই নয়, যেকোনো মেয়ের বাবা এমন জামাই পেলে খুশিতে পাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে।
কিন্তু ভাবনা যে মিলনের অন্তর মন জুড়ে, তাকে ছাড়া যে সবকিছুই বৃথা মিলনের! বাঁচবেইনা হয়তো, এমনই মনে হয় মিলনের কাছে। তবে ভাবনা খুব চালাক মেয়ে বটে, এবার আর কোন বনিতা না করে প্রফেসর পাত্রের বউ হওয়ার জন্য মত দিয়েই দিয়েছে শুনেছি কিছুক্ষণ আগে। আতিক এসে বলে গেল 'মিলন ভাই তোমার প্রিয়তমা ভাবনার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়ে গেছে।' কথাটা শুনার পর মিলনের কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, যদিও আতিক ভাবনার দুঃসম্পর্কের কেমন যেন আত্মীয়ই হয়। তবে মারুফা এসে যখন বললো 'মিলন ভাই, ভাবনা আপুর বিয়ে সামনের মঙ্গলবার দিনগত রাত্রে ঠিক হয়ে গেছে।' মারুফা ভাবনার চাচাতো বোন, এক বাড়িতেই থাকে। তার কথা বিশ্বাস না করে পারছেনা মিলন। খুব ভাবনার সাগরে হাবুড়ুবু খাচ্ছে মিলন। কোনকিছু ঠিককরা হয়ে উঠছে না এখন কি করা উচিৎ মিলনের।
বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল, ঘাসের উপর বসে পড়লো মিলন এক আকাশ দুঃখ বুকে, বেদনার কালো মেঘে ঢাকা পড়ছে তার পৃথিবী। কিভাবে স্বার্থপরের মতো ভাবনাকে এতো সুন্দর উপযুক্ত পাত্রের গলায় মালা দিতে করবে বারণ! কি করে বলবে ভাবনা তুমি বিয়ে করো না, আমি বাঁচবো না তোমাকে ছাড়া। আমি তো ভালোবাসা ছাড়া ভাবনাকে কিছুই দিতে পারবোনা। তারা কতো টাকাওয়ালা, ভাবনার কতো চাহিদা, আমি কিভাবে পূরণ করবো সব! তখন তো আমার আরো কষ্ট হবে ভাবনার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে। এদিকে প্রফেসর বর, আছে নামডাকওয়ালা পরিবার। ভাবনার সব চাহিদা পূরণ করেও যে সব চাহিদার সমাপ্তি হবে প্রফেসরের ঘরে। অনেক চিন্তায় মিলনের মাথা কেমন যেন জ্যাম হয়ে যাচ্ছে, কিছুই আর ভাবতে পারছেনা। কখন যে শুয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি, পথের ধারে দুব্বা ঘাসে শুয়ে মিলন হয়তো ঘুমিয়েছেও অনেকক্ষণ। হ্যা, অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে মিলন। আকাশ ফেটে বাজ পড়ার বিকট শব্দে ঘুমভাঙ্গে মিলনের। ঘুম ভেঙেই দেখে চারিধার ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখের সামনে আকাশে জমে উঠা কালো মেঘের ছোটাছুটি। বিজলীর আলোয় মাঝেমাঝে আলোকিত হয়ে উঠছে চারিধার। কতটা রাত হয়েছে তাও ঠাওর করতে পারছেনা মিরন। মাটিতে শুয়ে থাকায় প্রবল বাতাসে ধুলো এসে মিলনের চোখে আঁচড়ে পড়লো। আহ! কিছুই দেখতে পারছেনা মিলন। ধূলো ঝেড়ে কোনরকম মিটমিট করছে চোখের পাতা।
আকাশে মেঘের বিকট গর্জন, পশ্চিমা ঝড়ো হাওয়া বিজলীর ঝিলিকে শুয়ে শুয়েই দেখছে ভাবনাদের বাড়ি। কে যেন মিলনের হাত ধরে টানছে, টেনে তুলতে চাইছে তাকে। ওঠো মিলন ভাই, ঝড় তুফান হবে, এখানে আর থাকা নিরাপদ হবে না তোমার। ভাগ্যিস আমি তখন তোমার সাথে কথা বলে সোজা বাড়িতে গিয়েছিলাম আর জানালা দিয়ে তোমাকে এখানে ধীরেধীরে শুয়ে পড়তে দেখেছিলাম। এখন হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়তেই জানালা খুলে বিজলীর ঝিলিকে তোমাকে দেখতে পাই। ওঠো মিলন ভাই, এভাবে ভেঙে পড়লে তোমাকে চলবে না, তোমাকে যে এখনো অনেককিছু করতে হবে। এভাবে ভেঙে পড়লে যে জ্যাঠা জ্যাঠির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ঠিক যেন বড়ো মানুষের মতো মারুফার মুখে এমন শান্তনা চিন্তার কথা শুনে ঘোর কাটে মিলনের। মারুফার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। বড্ড মন চাইছে মারুফাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে, তা আর করা হল না। নীরবে মিলনের দুচোখ বেয়ে অশ্রুজল ঝরছে আর বোবার মতো মারুফার কথা শুনতে শুনতে উঠতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে মিলনের হাত পা, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও ধপাস করে পড়ে যায় মাটিতে। এবার মারুফা মিলনের একটা হাত তার গাড়ের উপর রেখে মিলনের পাঁজর ধরে উঠিয়েই ফেললো। মিলনের ঘোর যেন কেটে গেলো পুরোপুরি, দাঁড়িয়েই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মিলন। মারুফা চুপ হতে বলছে, চুপ করো মিলন ভাই, কেউ দেখে ফেললে আমার বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে, চলো তোমাকে তোমার ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মাঝেমাঝে বিজলীর আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠে চারিদিক। এখনো বৃষ্টি শুরু হয়নি, চারিদিক চকচকে, তবে খুব তাড়াতাড়িই বৃষ্টি শুরু হবে বুঝা যাচ্ছে। ভাবনার ঘরের জানালা দিয়ে সেই বিকাল থেকেই ভাবনা দেখছিল মিলনকে। বাতাস আর বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলে অনেকবার যেতে চেয়েও সাহস করে যেতে পারেনি ভাবনা মিলনের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়েছে বুকের কাপড়। মিলনের প্রতি মারুফার মনের টান আগেও অনেকসময় কথার ছলে বুঝেছে ভাবনা। কিন্তু এখন মারুফার জড়িয়ে ধরে তুলে এভাবে হেটে যাওয়া একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে মনে করছে ভাবনা। মারুফার প্রতি কেমন যেন একটা হিংসায় জানালাটা বন্ধ করে দিল ভাবনা।
মারুফা মিলনদের বাড়ির সামনে এসে বলছে, 'যাও মিলন ভাই, সোজা তোমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে, আর কোন চিন্তা করবেনা।' মিলন মাথা হেলিয়ে মারুফাকে সম্মতি জানিয়ে ধীর পায়ে নিজের বাংলো ঘরের দিকে হেটে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বুক ভরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মারুফা। যদিও আঁধারে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না, তবুও বিজলীর ঝিলিকে মন মানুষকে আরেকবার দেখার চেষ্টায় মত্ত মারুফার মন, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলনের দিকে....
তোর লাগিয়া 'কান্দেরে মন'
বুঝলিনা তুই মিলন ভাই,
কষ্ট আমার মনেই রইলো
বুঝলেনা আজও বলিনি তাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:১৯