প্রচন্ড গরম, দুপুরে পড়ে গেছে সময়, সূর্যটা যেন ঘরের চালের উপরেই মনে হচ্ছে নয়নের, নিচে ধান ভিজে যাচ্ছে শরীরের ঘামে। নূরভাই কালাম ভাই বিছানায় শুয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছে। নয়ন ধানের বেড়ে আটকা পড়ে গরমের শাস্তি ভোগ করছে। মনে মনে ভাবছে আল্লাহ তুমি রহম করো, নূর ভাইকে বাহিরে নিয়ে যাও, আমি একটু এই অসহ্য গরমের হাত থেকে রেহাই পাই, ধান চুরি করার সময় মেলা মিলবো। না কিছুতেই আল্লাহ নয়নের কথা আজ শুনছেন না। নূরভাই আর কালাম ভাই গল্প করেই চলেছে তো চলছেই। ধানের বেড়ের ছিদ্র দিয়ে চেয়ে দেখে কালম ভাই বসে আছে আর নূর ভাই হাতে দেড়ফিট কলমটা পায়ের উপর পা তুলে কলমটা আস্তে আস্তে বাইড়াইতাছে।
শেরপুর শহরে তখন ছয়টি সিনেমার হল ছিল, নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে শেরপুর ছয়টির মধ্যে একটিতে মুক্তি পেতোই, তাছাড়া প্রতিটি হলেই সপ্তাহ সপ্তাহ সিনেমা বদলাইতো, তবুও ভরপুর থাকতো সিনেমার হলগুলো। এতো জনপ্রিয় ছিল সিনেমা দেখা তা এখনকার ছেলেমেয়েরা বুঝতেই পারবেনা। কারণ হলগুলোর অবস্থা দেখলে মনে হয় না পেরে সিনেমা চালায়। ছয়টি হলের মধ্যে এখন মাত্র তিনটি সিনেমার হল তবুও চলেনা ঠিকমত শুনি। অনেকদিন হলে বসে সিনেমা দেখা হয় না, প্রায় ১৯ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে সিনেমার নেশা কেটেছে আমার মনে থেকে। এই ১৯ বছরে মনে হয় চারটি সিনেমা দেখেছি হলে, তবে শেষ ছবিটি কতবছর আগে দেখেছি তাও বলতে পারবো না। অথচ একটা সময় গেছে প্রতিটি সিনেমা দুই তিন বা চারবারও হয়ে গেছে দেখা!!
নতুন একটা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে সত্যবতী হলে, ছবিটি নাকি দারুণ, এমন গল্প শুনে নয়নের আর ভালো লাগছে না কবে দেখবো সিনেমা। কিন্তু পকেটে টাকাও নেই। আম্মার কাছে গতকালই একশ টাকা নিয়েছি, চাওয়াই যাইবো না, নূর ভাইয়ের কাছে চাইলেও না পাওয়ার চান্সই বেশি, কারণ দুই দিন আগেই পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। এখন কি করবে নয়ন, কিভাবে টাকা জোগাড় করবে, মাথার মধ্যে কঠিন চিন্তা।
আব্বা আজ সকাল সকাল শহরে চলে যাওয়ায় নয়ন স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুপুরের দিকে মাচা থেকে ধরা চারেক ধান চুরি করবে এই চিন্তাভাবনা করছে। আম্মা তো দশটার আগেই অফিস চলে যাবে, ছোট ভাই মনি স্কুলে চলে গেছে, নূরভাই ছেম ভাইয়ের বাড়ির দিকে গেছে দেখে স্থির করলো আজই সুযোগ বেড় থেকে ধান চুরি করার। তাই নিজের রুমে শুয়ে ভাবছে নয়ন।
বাহিরে রাস্তায় মন্জুর কথা শুনতে পেয়ে তাকে ঢেকে ঘরে বসে গল্প করছে।
আজ স্কুলে যাবি না নয়ন....? আম্মা অফিসে যাওয়ার জন্য রেড়ি হয়ে বড় ঘরের দরজা চাপিয়ে রেখে উঠোন থেকে বলছে যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে যাইস।
যাবো আম্মা, একটু পরে যাই কেবল দশটা বাজে, আচ্ছা বন্ধ করে যাবোনি। নয়ন নিজের রুম থেকেই উত্তর দিয়ে শুয়ে রইল।
মন্জুর সাথে নয়নের কথা হয়েছে সে ধানটি মাথায় করে কালাম ভাইয়ের দোকানে পৌঁছে দিবে। কিন্তু নয়নকে তার ঘর থেকে বেরে করে তার ঘরের পিছন পর্যন্ত নিয়ে দিতে হবে।
এর মধ্যে আলামিন এসে ঢুকলো ঘরে, কিরে স্কুলে গেলি না আজ, আমিও যাইনি আজ। আলামীনের সাথে গল্প শেষ করে যখন আলামীন চলে গেল তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। নয়ন মনে করছে এখনই কাজটি করে ফেলবে। তাই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বড় ঘরে এসে বস্তা খুঁজছে। মাচার দরজা খুলেই দেখে কয়েকটি বস্তা, নয়ন একটা বেছে নিয়ে মাচার ভিতর ঢুকে পড়লো। মন্জুকে বললো তুই ফিরু ভাবির সাথে আলাপ করতে থাক, দরজাটা চাপিয়ে রেখে যা।
মন্জু দরজা চাপিয়ে রেখে চলে গেল, নয়ন একটা ধান তোলার মত একটা ভোল নিয়ে ধানের বেড়ে নেমে পড়লো। নেমেই ঝটপট বস্তা ভরার কাজে ব্যস্ত। অর্ধেক বস্তা ভরে বস্তার মোখ বেঁধে বেরোতে যাবে এমন সময় উঠনো নূর ভাইয়ের কথা শুনতে পেল, এখন কি করবে নয়ন! নে আসলে শরীরের গাম দেখে সন্দেহ করবে, তারচেয়ে বরং বেড়েই বসে থাকি, কিছুক্ষণ পরতো চলেই যাবে, তখন বেড়িয়ে পরবো।
কিন্তু কপাল যে এতটা খারাপ হবে তা কে জানে, নূরভাই কিছুক্ষণ একা একা শুয়ে থেকে দরজা খুলে বাহিরে গেল, নয়ন ভাবছে যাক বেরিয়ে পড়বো এখন। তখনই আবার কালাম ভাইকে ডেকে আনলো, ঘরে ঢুকে শুয় শুয়ে গল্প করতে থাকে। আমি বেড়ের ফটো দিয়ে তাদের গল্প করা দেখছি, মাঝেমধ্যে কালম ভাই বলছে চল বাইরে যাই, আর মুচকি মুচকি হাসছে দেখে আমার এবার পুরোপুরিই ব্যাপারটা মাথায় ক্যাচ করলো যে নূরভাই কারো কাছে জেনেই ঘরে ঢুকেছে। তখন চিন্তা আরো বেড়ে গেল, এমনিতেই প্রচন্ড গরম, ডরভয় মিলে নয়ন প্রচুর ঘামতে লাগলো। শরীর ভিজে গেছে, লুঙ্গিটাও ভিজে গেছে। একবার ভাবছে বেরিয়ে আসি যা হবার হবে, কিন্তু নূরভাইয়ের হাতে দেড়ফিট কলম দেখে সাহস পাচ্ছি না। কারণ ওটা দিয়ে বারি খেলে অনেক জ্বলবে, তারচেয়ে বরং এখানেই থাকি।
অনেকক্ষণ পরে কালাম ভাই জোর করে নূর ভাইকে বাহিরে নিয়ে যায়, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে নয়ন বেড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ঘর ফাঁকা। নয়ন ধানের বস্তাটা বেড় থেকে নামিয়ে মাচার দরজার কাছে রেখে মাচা থেকে নেমে দরজার ফাঁক দিয়ে উঠোন খালি দেখে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে কালাম ভাইয়ের ঘরের কোনায় দাড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছে। তাছাড়া ঘরের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে তাই সেখানেই দাঁড়িয়ে শরীর ঠান্ডা করছে, আহ! প্রায় দুই ঘন্টা গরমের ভিতর, এখন অনেক শান্তি পাচ্ছে শরীরে। কিন্তু মনে টাকা, বস্তা কেমনে বের করবো, নূরভাই কই গেল এসব ভাবতে ভাবতে নূর ভাইয়ের ঘরে উকি দিয়ে দেখি সে নেই, বাহির গিয়ে দেখি দূরে মন্জু, ওকে ডেকে আনলাম, মন্জু ব্যাপারটা বুঝে ভাগছিল, নূর ভাই কই গেছে, কালম ভাইয়ের দোকানে। কথাটা শুনেই নয়ন এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে মাচার দরজার কাছ থেকে ধানের বস্তা নিয়ে সোজা কালাম ভাইয়ের ঘরে রেখে দরজা বেঁধে চলে গেল কফিল ভাইদের বাড়ির দিকে।
সিনেমা আমাকে দুই ঘন্টা গরমের যে সাজা দিয়েছে তা ভুলতে পারি না আজও। মাঝেমধ্যে মনে হলে একা একাই হেসে উঠি। ধান বেচে সিনেমা আহ গরম! বিশাল শাস্তি হিসেবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৪