বাজান, গত দুপুরবেলা অল্প কিছু ভাত খেয়েছিলাম দক্ষিণ পাড়ার সোলায়মানদের ঘরে। রাতে বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার কুড়ে ঘরের মেজে পানি, চুলা পানির নিচে। রাতে আর পাক করে খাওয়া হয়নি। বাড়ি ফেরার সময় পথে পাওয়া একটা পানির বোতলে কলিমদের টিউবয়েল থেকে পানি নিয়ে গিয়েছিলাম। তাই পেটপুরে খেয়ে রাত কাটিয়েছি। কতবাড়ি পার হয়ে এলাম, কারো কাছে দু মুঠো ভাত চাইতে সাহস করিনি। এখন বড্ড অসহ্য লাগছে, তাই এখানে বসতে চেয়ে পড়ে যাই, উঠতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শুয়েছিলাম এখানেই। চলে যাচ্ছি বাবা। এই বলে সত্তর ঊর্ধ্ব শীর্ণকায় শরীরের বৃদ্ধটি পাশে থাকা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই আবারো পড়ে যায়। জীবন হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করেও বৃদ্ধ ভিক্ষুকটিকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলো না। পড়ে যাওয়া বৃদ্ধের হাত আর পাজর ধরে কোনরকম তুলে বসায় তার চেয়ারে।
আপনে বসেন বাবা, আমি দেখি আপনাকে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। ক্ষুধার্ত ছলিমউদ্দিনের মুখে সামান্য হাসি অনুভূত হল জীবনের কথা শুনে। জীবন বাড়ির ভিতর গিয়ে তার বউকে বলে কোনরকম একথাল ভাত আর তাদের খেয়েদেয়ে বেশি হওয়া তরকারি নিয়ে বাহিরে এল। জীবনের পিছুপিছু তার মেজো ছেলে একটা বস্তা নিয়ে দাঁড়ায়। জীবন ছেলের কাজে খুশি হয়ে ছেলেকে চুমা দিয়ে বস্তাটি মাটিতে পেতে ভিক্ষুক চাচাকে ধরে সেখানে বসিয়ে বলে, চাচা, আমারা কিছুক্ষণ আগেই খেয়েদেয়ে যা ছিল তাই আপনার জন্য এনেছি। আপনি একটু কষ্ট করে খান চাচা। বৃদ্ধার মুখে হাসি ফোটে উঠে। হ্যা বাবা, খাবো, মন ভরে খাবো, আল্লাহ্ তোমার ভালো করুক। বৃদ্ধ ছলিমউদ্দিন ভাত খাচ্ছে। জীবন আর তার ছেলে পাশে বসে দেখছে। কি ক্ষুধার্ত! মুহুর্তেই একথাল ভাত খেয়ে ফেললো! চাচা, আপনার ছেলে মেয়ে নাই? জীবনের প্রশ্নে ছলিমউদ্দিনের চোখে হতাশার ছাপ, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বাবারে, ছেলেমেয়ে ছিল, এখন নেই!
তারা কোথায় চাচা?
তারা এখন বড় হইছে, শহরে থাকে। একটামাত্র ছেলে আমার। খুব কষ্টকরে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছিলাম। মানুষের বাড়িতে কাজ করে, ভিক্ষে করে ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলাম। ছেলে, খুউব শিক্ষিত হয়েছে। বড় চাকরি করে, শহরে থাকে, গাড়িতে চড়ে। কিন্তু বাবা...! কথাটুকু বলে বৃদ্ধের কেমন যেন উদাসী অবস্থা। চোখে মুখে হতাশার ছাপ, অতৃপ্ত মনের ক্ষোভ দুঃখ যেন চোখবেয়ে নামতে চাইছে। কোনরকম নিজের চোখ মুছে ছলিম উদ্দিন বলে, আর মেয়ে মাশাল্লাহ্ ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। তার জামাই বিদেশে চাকরি করে। মেয়েকেও সাথে নিয়ে গেছে বিদেশে। তোমার চাচী মারা যাবার পর ওই হাওড়ে একজনের পতিত জমিতে কোনরকম একটা শুয়ে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
বৃদ্ধের কথা শুনে জীবন স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলে উচ্চশিক্ষিত, মেয়ে বড়বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, সে আবার অন্যের বাড়িতে মাথাগোঁজার ঠাই পাইছে! জীবনের মাথায় কিছু ঢুকছে না। তাই আবারো প্রশ্ন করে, চাচা, ছেলের বাড়ি যেতে পারেননা?
গিয়েছিলাম বাবা! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
তয়, আপনার এমন পরিস্থিতি কেন? একটু বিস্ময়ের সাথেই প্রশ্ন করে জীবন।
বাবারে, ভাবছিলাম ছেলের চাকরি হলে আমাদের বুড়াবুড়ির কপালে সুখ হইবো, কিন্তু হয় নাই বাবা! আমরা গ্রামের মুর্খ মানুষ, বয়স হয়ে গেছে। আমরা বাসায় থাকলে ছেলের বউয়ের সাথে ছেলের রোজই ঝগড়া বাঁধে। অনেক কটুকথা শুনেও ছিলাম। কিন্তু, যখন আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করলো ছেলে, তখন আর থাকতে পারিনি। বৃদ্ধাশ্রম না গিয়ে ওই গাঁয়ে এসে দুইজনে পুরনো দিনের মতো জীবন কাটাতে থাকি। রোগে শোকে বুড়িটিও আমাকে ছেড়ে চলে গেল গতবছর। আমি আর এখন আগের মতো হাটতে পারিনা বাবা। কেমন যেন অসহ্য লাগে, খুব হাফিয়ে উঠি। সারাদিন মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যা পাই, তা কোনরকম পাকিয়ে খেয়ে শুয়ে থাকি। এখন আর পাকও করতে পারিনা ঠিকমতো। তাই মাঝেমধ্যে না খেয়েই থাকতে হয়। কত মানুষ মরে যাচ্ছে, আমার মরণ আল্লাহ্ কেন দিচ্ছে না বুঝি না! কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ জলে ভরে উঠেছে। চোখ মুছে জীবনের মাথায় হাত বুলিয়ে 'বেঁচে থাকো বাবা, আল্লাহ্ তোমার ভালা করবেন' বলে লাঠিতে ভর দিয়ে চলে যাচ্ছে বৃদ্ধ ছলিমউদ্দিন। বয়স্ক লোকের এমন করুণ কাহিনী শুনে কখন যে নিজের চোখেও জল গড়িয়ে পড়ছে তা টেরই পায়নি, জীবন নীরবে বৃদ্ধের চলে যাওয়া দেখছে, আর মনে মনে ভাবছে.... এইতো জীবন!!
(কল্পনিক, মনগড়া লেখা। ছবির কৃতজ্ঞতা গুগলি সার্চ।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৬