somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাক্তার বললেন, " অনুমতি দিলে আপনার বাবাকে এবার মেরে ফেলতে পারি। "

২০ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডাক্তার বললেন, " অনুমতি দিলে আপনার বাবাকে এবার মেরে ফেলতে পারি। "

আমি ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকালাম। আমার দষ্টিতে হয়ত অদ্ভুত কিছু ছিল, তাঁকে দেখলাম একটু থতমত খেয়ে গেছেন। তিনি আমার দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন তাঁর কথাটা আমার কানে গিয়েছে কিনা।

আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা তাঁর কথা আমার কানে গিয়েছে কিনা ! তিনি কি সত্যিই বাবাকে মেরে ফেলার অনুমতি চাইছেন আমার কাছে ? এটা কি করে হয় ! এত বড় একজন ডাক্তার এমন নির্লিপ্ত মুখে কাউকে মেরে ফেলার অনুমতি চাইতে পারেন ! তিনি কি ডাক্তার না খুনি ? না, তিনি তো আমার অনুমতি চাইছেন। আমি অনুমতি দিলেই তিনি বাবাকে মারতে পারবেন। খুনি তো আমি !

আইসিইঊ'র ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে বাবাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। আরেকটা কাচের ক্যাপসুলের মত ছোট্ট একটা খুপড়ির মত বাক্সের ভেতর বাবাকে রাখা হয়েছে। তাঁর সারা শরীরে অসংখ্য নলের ছড়াছড়ি। মুখের উপর বড় একটা মাস্ক। ওটাই কি লাইফ সাপোর্ট ? ডাক্তারি এত ভাষা আমি বুঝি না। গতকালও কি আমি দেখলাম না বাবার বুকটা সামান্য উঠানামা করছিল? নাকি ভুল দেখেছিলাম ? আজ অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি কিন্তু কোনো নিঃশ্বাস নিতে দেখলাম না বাবাকে। এজন্যই কি ডাক্তারটা বাবাকে খুন করতে চাইছে ?

স্ট্রোকের আগে শেষ দিকে বাবার সাথে তেমন একটা কথাই হত না। নাহ, তার সাথে আমার কোনো ঝগড়া ঝাটি, মনোমালিন্য ছিল না। ঝগড়া করার, অভিযোগ করার হয়ত অনেক কিছুই ছিল। আক্ষেপ করে বলতে পারতাম, পরিসংখ্যানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জীবনে কি এমন করতে পারলে তুমি ? আর তোমার ছেলেমেয়েদের বলো এখনো আমরা পড়ালেখার মূল্য বুঝি না ! অথর্ব শিক্ষাব্যবস্থার চরকি তে পড়ে চব্বিশ বছর চলে গেলেও এখনো একটা দু'পয়সার চাকরি জোটাবার মত সার্টিফিকেট জোগাঢ় করতে পারলাম না ! এত শিক্ষা কি দিল তোমাকে ? আমি বলতাম মামা-চাচা ছাড়া আজকাল কোথাও কিছু হয় না। বাবা বলত, নিজের যোগ্যতায় সবকিছু পাবে, যোগ্য হও। তখন আমি ঝগড়া করে বলতে পারতাম, হেহ্‌, অনেক যোগ্য তো তুমিও হয়েছিলে, পেরেছো নিজের স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিছু করে রেখে যেতে ? কিন্তু কখনো বলিনি তো ! আমি হয়ত ঝগড়া করে বলতে পারতাম, তোমার মেয়েকে কলেজে যাবার সময় বাসে-ক্যাম্পাসে ভদ্দরলোকেরা গায়ের ধাক্কা লাগায়, স্মার্ট ছেলেরা ওড়না ধরে টান দেয়। তোমার আদর্শের বুলি আওড়াতে গিয়ে সারাজীবন তো রাজনীতিকে ঘৃণা করতেই শিখেছি, তাই সভ্য প্রতিবাদের ভাষা আমার জানা নেই। হয় তুমি কিছু কর না হয় আমার হাতে একটা অস্ত্র দাও ! ওদের কন্ঠনালীতে গিয়ে একটা গুলি করে আসি।...এসবওতো কখনো বলিনি ! তোমাদের শেখানো মত তোমার মেয়ে সবসময় মাথা নিচু করেই চলাফেরা করেছে, আর আমিও তোমার কথা মত চুপ থেকেছি। কারণ আমরা তো নিতান্তই মধ্যবিত্ত কুকুর ! লাথি খেয়ে, হজম করি।

আমিতো ঝগড়া করে বলতে পারতাম, বাবা ! আমার বন্ধুদের তাদের বাবারা সবাইকে কোনো না কোনো ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছে। কেউ বাবার জোরে চাকরি পাচ্ছে, কাউকে ব্যবসায় ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি এখনো দিন গুনছি একটা সার্টিফিকেটের। কই কখনো বলিনি তো ! কারণ আমি জানি, মা বরাবরি তোমার বেতনের টাকা গুলোর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ভাবে, "এতে কি সারা মাস চলবে !"

তারপরও কেন যেন বাবার সাথে কোনো কথা খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম কি কথা বলব? আমি কি অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম ! নাকি অন্যরাও আমার মত, বড় হয়ে গেলে ভাবে বাবাদের সাথে আর কি কথা বলবে ? আচ্ছা কত বড় হলে বাবার সাথে কথা বলার কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না ? বাবার ইনসমনিয়া রোগ ছিল। রাতে সারা ঘরে হাঁটাহাঁটি করত। প্রায়ই ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে কেটে এনে অর্ধেকটা আমায় দিত বাকিটা বাবা খেতো। মাঝেমাঝে হেসে তাকাতাম, মাঝে মাঝে বিরক্তও হতাম, "উফ এত রাতে কেন এত হাঁটাহাঁটি কর !" আমাকে না দিয়ে রাতের বেলা কখনোতো আপেল খাওনি বাবা ! আমি কি একবারো তোমার জন্য কেটে নিয়েছি ? মনে পড়েনা।

বাবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চারপাশে তাকালাম। প্রতিদিনের মত অবিচল ছায়া নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটমামা। বাবার বড় ভাইটাকে দেখতে পাচ্ছিনা। জ্যাঠু বলতে যাকে গলায় আটকায়। নিশ্চয় দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে এরমধ্যে হিসেব শুরু করে দিয়েছেন। ভিটেমাটির কে কোনদিকে পাবে ! মাকেও দেখছিনা। অপলক ভেজা চোখে আর কত তাকিয়ে থাকবে ওই নিথর দেহটার দিকে ?

ডাক্তার এবার একটু স্পষ্ট করে বললেন, " আপনি অনুমতি দিলে, পেশেন্টের লাইফ সাপোর্টা এবার সরিয়ে নিয়ে পারি। সবার সাথে তো ইতিমধ্যে কথা হয়েছে। তবুও আপনি যেহেতু একমাত্র ছেলে....." তিনি কথাটা শেষ করলেন না। ছোটমামা মাথা নিচু করে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। এবার তার কথা ঠিকই শুনতে পেলাম। প্রথমে আমিই ভুল শুনেছিলাম । আমাদের ডাক্তাররা অনেক ভদ্র সুশীল। "আপনার বাবাকে মেরে ফেলার অনুমতি দিন" টাইপের কথাবার্তা তাঁরা বলেন না।

মামার চোখের দিকে তাকালাম। অসহায় ছলছলে দৃষ্টি ! কি অদ্ভুত এক পরিবেশ ! সবাই গত দুই দিন ধরে বাবাকে ঘিরে অপেক্ষা করছে তার মৃত্যুর জন্য। গত একসপ্তাহ ধরে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররাও এখন নিশ্চিত এই লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজনীয়তাও এখন ফুরিয়েছে। সবাই তাদের মত দিয়ে দিয়েছেন। মা অবশ্য কিছু বলেননি। অপলক চোখে শুধু চোখের পানি ঝরিয়েছে। তাই ডাক্তার সাহেব এখন আমার কাছে এসেছেন আমার অনুমতি নেয়ার জন্য। আমিইতো একমাত্র ছেলে ! আমার কথাই শেষ কথা ! এটা কি অনুমতি নাকি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা যে, আপনার অনুমতিতেই আপনার বাবাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এ সম্পর্কে আপনারা সজ্ঞানে সকলে অবগত !!!

বাবার দিকে আরেকবার তাকালাম। বাবা ! কখনো তোমার কথার সাথে দ্বিমত করিনি তো ! হাজার আক্ষেপ থাকলেও সবাইকে তো বুক ফুলিয়ে সমসময় বলেছি, "আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা "
বন্ধুর শুনে খুব অবাক হত যে, আমার বাবা আমাদের ভাই বোনের সাথে বসে একসাথে নাটক সিনেমা দেখত ! ওরা খুব হিংসে করত যে আমাদের কোনো কাজে তুমি কখনো বাঁধা দাওনি। কোনটা ভুল শুধু সেটা বুঝিয়ে দিয়েছ। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইনি যে, আমি তোমাকেই সবার আগে বলেছি আমাদের ক্লাসের নীল টিপ পড়া মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ। ওরা ভাবতো এটা কি হয় নাকি ! বাবা বুঝি এমন হয় ? আমি তো জানি, আমার বাবাই প্রতি রাতে আপেল কেটে অর্ধেকটা আমার জন্য নিয়ে আসতো !

তাহলে কেন আমাকে এতো বড় শাস্তি দিচ্ছ বাবা ?? আমি এখন ডাক্তারকে কি বলব ? হ্যাঁ, সরিয়ে ফেলুন ওই যন্ত্র। মেরে ফেলুন বাবাকে। আমি তার খুনি ছেলে বলছি, মেরে ফেলুন বাবাকে !!

এও কি হয় বাবা ?? বল, এটাও কি সম্ভব ???



( পাদদীকাঃ আমার পরিবারের খুব কাছের কিছু মানুষ এখন এরকমই একটা অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। সবাই রোগীকে ঘিরে অপেক্ষা করছেন কখন তার মৃত্যু হবে। কি অদ্ভুত ভয়ংকর এক পরিস্থিতি, তাই না ? হাসপাতাল থেকে তাঁকে দেখে এসে এই লিখাটা মাথায় ঘুরছিল। বছর চারেক আগে এধরনের আরেকটা ভয়াবহ সময় পার করলেও আমার এখন বাবা সুস্থই আছেন। তবে এই বাবার প্রায় প্রতিটি বৈশিস্ট্যই আমার বাবার আছে। আমরাও নিতান্তই মধ্যবিত্ত একটি পরিবার। যে পরিবারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাটি থাকেন, যিনি প্রতি রাতে আপেল কেটে নিজে অর্ধেক খান, বাকিটা আমার জন্য নিয়ে আসেন ! )
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২৭
৫৭টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×